মঙ্গলবার, ৭ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

বসন্ত এসে গেছে, বিষাদ ছুঁয়েছে মন!

রুমানা রাখি

বসন্ত এসে গেছে, বিষাদ ছুঁয়েছে মন!

বসন্তকাল বসন্তকাল/ আকাশ দেখ সূর্য হাসে/বসন্তকাল বসন্তকাল/জেগে উঠে পৃথিবীকে বল স্বাগত! ব্রিটেনের বাচ্চাদের বসন্তকালে যে ছড়াটি শেখানো হয় তারই বাংলা অর্থ ওপরের লাইনগুলো। প্রতি বছর এমন সব সুন্দর সুন্দর লাইনের গাঁথুনির মধ্য দিয়ে বসন্তকে স্বাগত জানায় ব্রিটেনের লাখ লাখ শিশু। প্রতি বছরের মতো এবারও বসন্ত এসেছে কিন্তু বাচ্চাদের এবার আর এ ছড়াটি শিখতে হয়নি।

ব্রিটেনসহ পুরো ইউরোপ চেরিসহ হরেকরকম ফুলে ছেয়ে গেছে। কিছুদিন আগেও যেখানে ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে সন্ধ্যা নামত, সেখানে এখন সন্ধ্যা নামে ৮টার পরে। বছরের এ সময়ের জন্য অপেক্ষা করে ব্রিটেনবাসী। প্রতি বছরের মতো এবারও বাচ্চাদের স্কুল ছুটি হওয়ার কথা ছিল ৬ এপ্রিল। ছুটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৭ এপ্রিল। এপ্রিল ঠিকই এসেছে। এবার আর বাচ্চাদের প্রতি বছরের মতো ছুটির জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। কারণ বাচ্চাদের ছুটি শুরু হয়ে গেছে আরও ১৫ দিন আগেই। আর তাই বসন্ত বসন্ত আমেজে ওপরের ছড়াটি পড়েনি কোনো বাচ্চা। বছরের যে ছুটিগুলোর জন্য অপেক্ষা করে বাচ্চারা ও অভিভাবকরা। কোনো অপেক্ষা না করেই এবারের বসন্তে অনির্দিষ্টকালীন ছুটি দিয়ে দিল করোনাভাইরাস। তবে এ ছুটি অবকাশ যাপনের নয়, ভয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকার ছুটি। করোনাযুক্ত লন্ডনে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি শুধুই নিস্তব্ধতা। যে পথ ছিল লোকারণ্য সে পথ এখন জনমানবহীন। বার-রেস্তোরাঁ-শপিং মলের কপাট বন্ধ। এ কোন শহর! যে শহরের রেলে ও গাড়িতে চড়ার জন্য লোকে দীর্ঘ লাইন দেয় সময়ের আগে, এখন কোনো তাড়াহুড়া নেই, দীর্ঘ সারি নেই, কেবলই বিজন নির্জনতা। অচেনা, অজানা লন্ডন যেন মনে হয় একটু বাঁচতে চাই, একটু বাঁচাতে চাই। পৃথিবীতে আরও অনেক কিছু আছে দেখার। দেখতে চাই, নিঃশ্বাস নিতে চাই প্রাণ ভরে।

প্রতি বছরই বসন্তে চেরি দেখতে বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটক ভিড় করে লন্ডনে। তবে এবার বসন্তে কেউ চাইলেও চেরি দেখতে পারবে না, বাইরে ঘুরতে পারবে না, অবকাশ কাটাতে কোথাও যেতে পারবে না, পারবে না পরিবার নিয়ে পিজা খেতে বা সিনেমা দেখতে। যুক্তরাজ্যের ট্যুরিজম অ্যালায়েন্সের তথ্যমতে, গ্রীষ্মে প্রতিদিন বিভিন্ন দেশ থেকে ১ হাজার ৮০৩ জনের বেশি ট্যুরিস্ট লন্ডন ঘুরতে আসেন। আর এ ঘুরতে আসাদের প্রতিদিনের খরচ ধরা হয় ৬৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন; যা বছর শেষে হাজার মিলিয়নে গিয়ে পৌঁছে। আর বাইরে থেকে আসা ট্যুরিস্টদের সঙ্গে মেতে ওঠে লন্ডনে বসবাসকারীরাও। বসন্ত ঘিরে বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক বাবা-মা  সন্তানদের সঙ্গে মিলিয়ে ছুটি নেন, শুধু বসন্ত উপভোগ করার জন্য। কিন্তু উপভোগ দূরের কথা মানুষকে দিনে দিনে মৃত্যুর বুকে ঠেলে দিচ্ছে করোনাভাইরাস। বাবা-মা সন্তানদের নিয়ে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছেন ঘরের মধ্যে। দুই দিন আগে ডেইলি মেইলে বিখ্যাত কমপোজার জেমা পিককের একটি আর্টিক্যাল ছাপা হয়। জেমা তার ১৩ বছরের ছেলের একটি কবিতা তুলে ধরেন। যেখানে লেখা আছে- ‘আমাদের ইতিহাস বই এখন কথা বলছে/আমরা আমাদের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি/আমরা ঘরের কাজ করছি/কিন্তু সবই যেন আমরা করছি ভয়ে ভয়ে/আমরা নিঃশ্বাস নিতে চাই...’

জেমা তার আর্টিক্যালটিতে লেখেন, ‘আমার ১৩ বছরের সন্তানটি অনেক সাহসী। কিন্তু এখন আমি বা তার বাবা কোনো প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে চাই, সে আমাদের পথ আগলে ধরে। আমার মনে হয় আমার সন্তানটি ভয়ে ভয়ে তার সাহস হারিয়ে ফেলছে। এভাবে চলতে থাকলে সন্তানরা তাদের মনোবল কতটুকু ধরে রাখতে পারবে তা জানা নেই কারও।’ করোনাভাইরাসের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা হোম কোয়ারেন্টাইন। তবে হোম কোয়ারেন্টাইনের সুফলজনিত আলাপের মাঝে একটা বড় আলাপ এখনো আসেনি, তা হলো হোম কোয়ারেন্টাইনের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা। চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় ইতিমধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে চীনে করা জরিপে দেখা যায়, ৪২.৬ শতাংশ ব্যক্তি করোনার ভয়ে অ্যাংজাইটিতে ভুগছেন। এর আগে সার্স, ইবোলা-জাতীয় মহামারীর সময়ও মধ্যপ্রাচ্য ও কানাডায় মানসিক রোগের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। তাই করোনার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক বাতিল করা যাবে না। গত সপ্তাহে জার্মানির একটি স্টেটের অর্থমন্ত্রী করোনার ভয়ে আত্মহত্যা কিংবা যুক্তরাজ্যের একই পরিবারের চারজনের আত্মহত্যার সংবাদ আমাদের মাঝে মানসিক ভয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। লম্বা সময় ঘরে বসে থাকার একটা মানসিক চাপ আছে। প্রতিদিন অফিসে কাজ করে যারা অভ্যস্ত, দিনের পর দিন বসে থেকে এ কর্মোদ্দীপ্ত মানুষদের এক ধরনের হতাশা তৈরি হবে। সে হতাশা থেকে ধীরে ধীরে হবে ক্রোধ ও বিষণ্নতা।

ইংলিশ রক সিঙ্গার জন লেনন ও তার স্ত্রী ইয়োকো অনো মানবতার জন্য ‘ইমাজিন’ শিরোনামে একটি গান লিখেছিলেন ১৯৭১ সালে। জন লেননের গাওয়া সে গানটি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছিল। সে গান যা এখনো মানুষকে উদ্দীপ্ত করে বিশ্বমানবতার জন্য- ‘মনে কর স্বর্গ নেই/সহজ হবে যদি আরও চেষ্টা করে ভাবো/ আমাদের অতলে কোনো নরকও নেই/ আমাদের আছে শুধু আকাশ/মনে কর, সব মানুষ বেঁচে আছে আজকের জন্য/ ভাবো, পৃথিবীতে কোনো দেশ নেই...’ জন লেননের এ গানটি যে এত বছর পর আমাদের সামনে সত্যি হবে, তা হয়তো জানা ছিল না স্বয়ং লেননের। তবে প্রকৃতি লেননেরই স্বপ্নের পৃথিবী বিনির্মাণের দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে কী নির্মমভাবে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিদিনের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মৃত্যুর সংখ্যা কমার নাম নেই। সাড়ে ৯ কোটি জনবসতির দেশটিতে করোনার ছোবল থামবে কবে, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না। হয়তো থামবে ঠিকই, আবার জনপদে ফিরবে জনতার পদচারণ, প্রাত্যহিক ব্যস্ততায় ডুববে মানুষ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় আঘাতে জর্জরিত লন্ডনে মানুষের আপনজন হারানোর শোক এবং সব ধকল সামলে উঠে বর্তমানের বিষণ্নতার দেয়াল ভাঙতে পারবে কবে, তা এখনো অজানা।

সর্বশেষ খবর