মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় নববর্ষ হলো না, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীর ফাঁসি

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

করোনায় নববর্ষ হলো না, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীর ফাঁসি

আজ বাংলা নববর্ষ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো দিন বাংলা নববর্ষ ধুমধামে পালিত হয়নি এটা কেউ বলতে পারবে না। শহরে ইলিশ আর পান্তাভাত বাংলার নববর্ষ নয়, গ্রামেগঞ্জে মহাজনের হালখাতা, পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, মেয়েরা চমৎকার হলুদ শাড়ি পরে রংবেরঙের ফুলের মতো সারা গ্রাম সারা দেশ রঙিন করে মাতিয়ে তোলা পয়লা বৈশাখের এক অনন্য উপাদান। সেই পয়লা বৈশাখ সারা বিশ্বে করোনার প্রাদুর্ভাবে যথাযথ পালন করা গেল না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে, মানুষের জীবন রক্ষা করতে সরকার বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে যথাযথ সাড়া দিয়ে বাংলা নববর্ষ পালন থেকে বিরত থাকা এও এক সংগ্রাম, এও এক যুদ্ধ। করোনার এ বালা-মুসিবত কেটে গেলে নিশ্চয়ই আমরা অন্যবারের চাইতে আরও অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বাংলা নববর্ষ পালন করতে পারব, পালন করতে পারব জাতির পিতার শততম জন্মদিন অথবা জন্মশতবর্ষ। সবার আগে বেঁচে থাকা প্রয়োজন, মানুষকে বাঁচানো প্রয়োজন।

ঘরে বসে আছি কত দিন। দিন যেন আর যায় না। করোনার প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব আজ জেরবার, নাস্তানাবুদ পরাশক্তি। শক্তিমানরা এক দেশের মানুষ মারতে আরেক দেশকে অস্ত্র দেয়। আজ অস্ত্র দেওয়া দেশও যেমন, অস্ত্র পাওয়া দেশও তেমন অসহায়। সবার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। করোনা ধরা পড়েছে প্রায় চার মাস। আজও কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। যারা আক্রান্ত হচ্ছে তারা যে সবাই মারা যাচ্ছে তেমন নয়। আক্রান্ত হওয়া অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠছেন। কিন্তু কেন যেন সর্বত্র এক মহাহাহাকার। সব যেন শেষ হয়ে গেল। বিশ্বমানবতার রক্ষা নেই- এ যেন কিয়ামতের পূর্বাভাস। এর মধ্যেও আমাদের দেশে হেলাফেলার শেষ নেই। সেদিন সৈয়দ বোরহান কবীরের ‘সব ঠিক আছে’ লেখাটি পড়লাম। দারুণ লিখেছেন। বোরহানের চিন্তা-চেতনা-চৈতন্য এক অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছেছে। সময় থাকতে আমরা যে কোনো কিছুই করি না তার উজ্জ্বল প্রমাণ বোরহানের লেখা। ছোট-বড় সবার কোনো জবাবদিহি নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভা, সে এক দেখবার মতো জিনিস। ত্রাণমন্ত্রী, সাভারের রানা প্লাজা ধসে যে মালপানি পেয়েছেন তাতে যে তার ১৪ বছর যাবে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সাভারের কাউকে জিজ্ঞাসা করলে খুব বেশি প্রশংসা শোনা যাবে না। কিন্তু তিনি এখন ত্রাণমন্ত্রী! চ্যানেলে এসে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের স্থলে চিকিৎসার কথা বলেন। ডাক্তার হিসেবে কোনো রোগী কোনো দিন দেখেছেন কিনা কেউ জানে না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অক্লান্ত পরিশ্রম কিছু চোর-চোট্টা নিমিষেই মাটি করে দিচ্ছে। এখনো যদি চুরির কথা মাথায় আসে তাহলে সে তো দাজ্জালের চাইতেও খারাপ। আমার বাবা একজন আইনবিদ। ছেলেবেলা থেকে বেশকিছু চোর-ডাকাত দেখেছি। অমাবস্যার রাতে চুরি করতে না পারলে চোরেরা নাকি নিজের ঘরের পাতিল-হাঁড়ি এদিক-ওদিক নাড়াচাড়া করে। ত্রাণ বিতরণে কিছু চোর কি তাদের অভ্যাস বজায় রাখছে? মানুষকে লকডাউন বা ঘর থেকে না বেরোতে এর চাইতে বেশি চাপাচাপি করবেন না। বাংলাদেশের মানুষ আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভার চাইতে মারাত্মক, কখন ফুঁসে ওঠে আগে থেকে বোঝা যায় না। বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবেসে যা করা যায় কামান-বন্দুক চালিয়ে তার একবিন্দুও করা যায় না। তাই সব সময় শঙ্কায় থাকি। বেশি চাপাচাপি করতে বারণ করি। ছোটখাটো ভুলে যাতে কোনো বিস্ফোরণ না ঘটে। আমার টাঙ্গাইলে শ্রমিকনেতা আমিন কমিশনার ছোট থাকতে ভালো ছিল। মিরনের কর্মী বলে আদরযতœ করতাম। এই নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় দোয়া করে ১৫০০ টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন রাস্তায় মানুষদের বেদম প্রহারে আমিনের প্রতি বড় বেশি ঘৃণা জেগেছে। একজন কমিশনার কেন মানুষের গায়ে হাত তুলবে? আমার তো এখনো হজ করার সৌভাগ্য হয়নি। আমিন হজ করেছে। তার পরও অন্তরের পশুটি এখনো বুকেই আছে। তাহলে হজের কী প্রয়োজন। আমাদের দেশের মানুষ হজ করতে যাওয়ার আগে পরিচিত সবার কাছে মাফ-মুক্তি নেয়। আমিনও হয়তো নিয়েছিল। তার পরও এত রাগ এত ক্ষোভ কেন? মানুষের মধ্যে আল্লাহ বিরাজ করেন, সেই মানুষের গায়ে আঘাত করলে আল্লাহ কখনো খুশি হতে পারেন না, হনও না। কোনো কোনো জায়গায় পুলিশ বড় ভালো করছে। আবার কেউ কেউ পাওয়ার দেখাচ্ছে। যারা পাওয়ার দেখায় তারা করোনায় আক্রান্ত না হলেও আল্লাহর কাছে অবশ্যই ধরা পড়বে। কেউ কেউ বলছে দেখামাত্র গুলি। আমার তো মনে হয় সেনাবাহিনী, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর কাছে ১৮ কোটি গুলি নেই। যোগ্য-দক্ষ কোনো শাসক শুধু শক্তির ওপর ভর করে না, তার বল-ভরসা মেধা, বুদ্ধি ও বিবেচনার ওপর। কত ভুলভ্রান্তি করছি আমরা। মানুষ একবার ভয় পেয়ে গেলে খুব সহজে তাদের সাহসী করা যাবে না। তাই কাউকে অযথা ভয় পাইয়ে দেওয়া ঠিক নয়। ১০০-২০০-৫০০-১০০০ করোনায় আক্রান্ত হলে আমরা যদি সাহস হারিয়ে না ফেলি কী হবে? করোনায় আক্রান্ত শতকরা ৮০-৮৫ জন তো এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। বাকি শতকরা ১৫-১৬ জন তাদেরও প্রায় ৮০ ভাগ ভালো হয়। আর যেইমাত্র প্রতিষেধক বেরিয়ে যাবে তখন নিশ্চয়ই আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব। তাই এটা সহনশীলতার সময়, ধৈর্যের সময়। সবার একমত একপথ হয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় এবং সেই একমত একপথে চলার নেতৃত্ব দিতে হবে সরকারকে, দেশের নেতা শেখ হাসিনাকে। দুই দিন আগে হোক আর পরে হোক, এটা তাকে করতেই হবে। করোনা নিয়ে এত দিনে যা বুঝেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া সরকারে আর কেউ নেই কিছু নেই। সেদিন আমার বাসার দক্ষিণে একজন শ্বাসকষ্টে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেই চরম উত্তেজনার সময় তাকে কেউ শ্বাসকষ্টের ওষুধ এগিয়ে দিতে পারেনি। পুলিশ এসে মুমূর্ষু লোকটিকে মেডিকেলে নিয়ে যায়। ছড়িয়ে পড়ে করোনার খবর। করোনার করুণায় এলাকা লকডাউন। বাড়িতে তালা। সে যে কী যন্ত্রণা কাউকে বোঝানো যাবে না। গতকাল শুনলাম তার কোনো করোনা-টরোনা হয়নি। শ্বাসকষ্টে অসুস্থ হয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন। এটা সত্য, বাঙালির অনেক গুণ, মেধা, সাহস। কিন্তু হুজুগে বাঙালি- এ থেকে মুক্তি নেই। মানুষ সারা জীবন চায় মৃত্যুতে যেন মর্যাদা পায়। করোনার জন্য সেই মর্যাদাও কেমন যেন হয়ে গেছে। দোয়া-দরুদ পড়ে ফরজ গোসল করিয়ে পরম যতেœ লাশ দাফন করব- এটা মুসলমানের ঐতিহ্য। আমার মা যেদিন মারা যান, লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়ার আগে-পরে প্রায় এক ঘণ্টা তাঁর পা বুকে চেপে রেখেছিলাম। মৃত্যু থেকে কবর দেওয়া পর্যন্ত কোনো অনাদর হয়নি। বারবার মনে হয়েছে, আমি অসুস্থ হলে মা আমার জন্য কত কী করেছেন। সেই মা চলে গেলেন, তাকে সামান্য যতœও করতে পারব না? আজ করোনার দুর্বার আক্রমণে আমাদের ধর্মীয় বোধশক্তিও বিলুপ্ত হতে চলেছে। আমরা তো সবাই মরব- তাহলে ভয় কেন? ঠিক আছে, একটা ভাইরাস এসেছে, এখনো আমরা তাকে চিনতে পারিনি। একদিন না একদিন চিনতে পারবই। সেদিন গলা টিপে ধরব করোনাভাইরাসের। উহ্-আহ্ টু-টা করতে দেব না। হাড়ে হাড়ে জবাব আদায় করব- এত মানুষ জীবন হারাল কেন? তার জবাব কী। আমরা মানুষ, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। আমরা দিশাহারা হয়ে অমানবিক আচরণ করব, এটা আমাদের কি মানায়? মোটেই মানায় না।

দুনিয়া সৃষ্টির কৌশল আমরা কেউ জানি না। আল্লাহ সব জানেন সব বোঝেন। আমরা আল্লাহর ইচ্ছা-অনিচ্ছা কিছুই জানি না, কিছুই বুঝি না। ছোটবেলা থেকে কত ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এসেছি। শুনেছি, আমার যখন আড়াই-তিন বছর বয়স তখন আষাঢ়ে বাড়ির পালানে পড়ে গিয়েছিলাম। গ্রামের মা সে যে কী, গ্রামে না জন্মালে কেউ বুঝতে পারবে না। গ্রামে তখন অবস্থাপন্নদের বাড়িতে দুটি উঠান থাকত। একটা বাইরে, আরেকটা ভিতরে। হাঁস-মুরগির মতো এটা-ওটা বলতে বলতে আমি বাইরের উঠানে হাঁটাচলা হামাগুড়ি দিচ্ছিলাম। মা ভিতরবাড়ি থেকে আমার কেও কেও শুনছিলেন। হঠাৎ আওয়াজ বন্ধ হলে মা বাইরবাড়ি ছুটে আসেন। ইঁদারার পাড়ে দক্ষিণের পালানে আমাকে হাবুডুবু খেতে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে নেন। আর দু-চার মিনিট দেরি হলে আমার জীবন আয়ু সেদিনই শেষ হয়ে যেত। এই মায়াময় পৃথিবী দেখা হতো না। এত ঝড়-ঝাপটাও সইতে হতো না। এরপর কত ঝড়-ঝাপটা, তুফান গেছে কী করে যে সব পেরিয়ে এসেছি! ’৭০-এর নির্বাচনে আমার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী কালিহাতী থেকে এমপি হয়েছিলেন। দেশের সব সিট পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। আমরা রাত-দিন পরিশ্রম করেছিলাম। মনে হয়েছিল এই বুঝি শুভদিন এলো। কিন্তু কোথায় শুভদিন! ইয়াহিয়া-ভুট্টো টালবাহানা করে আমাদের আবার নরকে পাঠান। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ পাকিস্তান হানাদাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর। ৩ এপ্রিল দখল করে নেয় টাঙ্গাইল। হানাদাররা টাঙ্গাইলে পা দিয়েই আমাদের বাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। তার আগে আমরা মির্জাপুর সাটিয়াচরায় হানাদারদের বাধা দিয়েছিলাম। আকস্মিক বাধায় তারা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গোড়ান-সাটিয়াচরা আর কালিহাতী আকস্মিক হামলায় হানাদারদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তেমন আর কোথাও হয়নি। আমি ছিলাম সাধারণ ছাত্রদের একজন। দেশপ্রেম গলার ফাঁসের মতো মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব এসে পড়েছিল আমার হাতে। বিষয়টা খুব সহজ ছিল না। অমানুষিক পরিশ্রম দিন-রাত প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে পাল্লা দিয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে বেঁচে থাকা। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে সেখানেও জয়ী হয়েছিলাম। ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল হানাদারমুক্ত, ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজির আত্মসমর্পণ- সবখানেই আল্লাহ আমাকে হাজির করেছিলেন। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে ফিরেই ফোন করেছিলেন। ১১ তারিখ সকাল ৭টা-সাড়ে ৭টায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম দেখা। তিনি কোলে তুলে নিয়েছিলেন। অনেক কথা, অনেক আনন্দ-বেদনা। কদিন পর আমাদের অস্ত্র চাইলে এক কথায় নেতার পায়ের কাছে সব অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিলাম। দিন মোটামুটি চলছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরাজিত শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না। আমাদের স্বাধীনতা ছিল তাদের পরাজয়। কোনোভাবে দিন কেটে যায়। বঙ্গবন্ধু রাত-দিন চেষ্টা করেন দেশকে বাঁচাতে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে। ষড়যন্ত্রকারীরা আবার পাকিস্তান বানাতে পাটকল, ফেরি এটা-ওটা একের পর এক ধ্বংস করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। তার ডাকে যেমন অনেকেই সাড়া দেয় তেমনি শত্রুরা প্রমাদ গোনে। তারা শেষ অস্ত্র হিসেবে নেতাকে হত্যার পদক্ষেপ নেয়। আমরা অনেকেই তাঁকে বললেও বিশ্বাস করাতে পারিনি। কোনো বাঙালি শেখ মুজিবের বুকে বন্দুক ধরতে পারে- এটা তাঁর বিশ্বাস ছিল না। আমাদেরও অনেকের ছিল না। যা হওয়ার তাই হয়েছিল। ১৫ আগস্ট শুক্রবার মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনির সঙ্গে ধানমন্ডির ৩২-এ কারবালার নির্মমতা নেমে এসেছিল। দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলাম। করোনায় যখন দেশ হাবুডুবু খাচ্ছে তখন হঠাৎই বঙ্গবন্ধু হত্যার সাজাপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মাজেদ মিরপুরের রাস্তায় এক রিকশাযাত্রী হিসেবে ধরা পড়ে। এও আল্লাহর এক মহাকৌশল। ১৫ তারিখ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার দিকে এই মাজেদ আমার বাবর রোডের বাড়িতে এসেছিল। টেলিভিশনের ওপর আমার কোলে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর মেয়ে রিয়া ও অন্যদের ছবি দেখে উন্মাদের মতো গালাগাল করতে করতে আমার মা-বাবা কোথায় খুঁজছিল। লাথি মেরে টেলিভিশন ভেঙে বেশ গর্ব করছিল। যেভাবে এসেছিল এটা-ওটা ভেঙে ১০ মিনিটের মধ্যে চলে গিয়েছিল। খুনিদের সে কী দাপট। আমরা যারা দেশ স্বাধীন করেছিলাম তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। আর বর্ণচোরারা পিতাকে হত্যা করে লাফালাফি করছিল। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে বলেছিলাম, ‘খুনিরা কামাল-জামাল-রাসেলকে হত্যা করতে পারলেও বঙ্গবন্ধুকে নির্বংশ করতে পারে নাই। আমি কাদের সিদ্দিকী তার চতুর্থ সন্তান। যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ পিতৃহত্যার বদলা নেবই নেব।’ গড়ে তুলেছিলাম প্রতিরোধ যুদ্ধ। তারই প্রথম অভিযান যমুনার নিশ্চিন্তপুর চরে মেজর ডালিম এবং এই ক্যাপ্টেন মাজেদের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন হেলিকপ্টার নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আসলে তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখে নাই। চায়ের কাপে মুক্তিযুদ্ধের ঝড় তুলেছে। তাই আমাদের অস্ত্রের ধার তাদের জানা ছিল না। নিশ্চিন্তপুর চরে হেলিকপ্টার নিয়ে একেবারে আমাদের কাছাকাছি হলে আমরা গুলি চালাই। আমাদের গুলিতে ওদের ক্যাপ্টেন খালেদসহ আট-নয়জন আহত নিহত হয়। আমার ডান পাশে গা-ঘেঁষা বগুড়া জেলা যুবলীগ সভাপতি আবদুল খালেক খসরু শহীদ হয়। তাকে আমরা কবর দিতে পারিনি। পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। সে দুঃখ আজও আমি বয়ে বেড়াই। তবে সেদিন অলৌকিকভাবে ডালিমসহ মাজেদ বেঁচে গিয়েছিল। হেলিকপ্টারের পাইলট ছিল প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের ছেলে হাসান ফারুক। যাদের বাড়িতে ১৫ আগস্ট সবার আগে গিয়ে উঠেছিলাম। যার ভাই ইকবাল হাসান মন্টি লতিফ ভাইয়ের গাড়ি করে জামালপুর ফেরিঘাট পর্যন্ত দিয়ে গিয়েছিল। কত হবে বড়জোর ২০-৩০ গজ দূরে হেলিকপ্টারের ককপিটে হাসান ফারুকের করুণ মুখ দেখেছিলাম। তাই হেলিকপ্টারে বা তাকে গুলি করতে পারিনি। দু-তিন মিনিটের মধ্যেই উড়ে গিয়েছিল তাই বেঁচে গিয়েছিল। আমার এবং আমাদের জীবন হয়েছিল চরম উৎকণ্ঠার চরম কষ্টের। একদিন খেয়ে, একদিন না খেয়ে থেকেছি। সীমান্তে যখন সোজা হয়ে দাঁড়ালাম তখন ভারতের সরকার পরিবর্তন হলো। মহীয়সী নারী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর স্থলে কংগ্রেসকে হারিয়ে ক্ষমতায় এলো জনতা পার্টির সরকার। নেতা হলেন মোরারজি দেশাই। ইন্দিরাজির সঙ্গে যার সাপে-নেউলে সম্পর্ক। আমাদের দুর্যোগের যেন শেষ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বোন শেখ হাসিনাও তখন দিল্লিতে। অনেক কষ্ট করে তাকে দেখে এলাম। গেলাম পাটনায়। জয়প্রকাশ নারায়ণ আমাদের সমর্থন দিলেন। মোরারজি দেশাইর তলোয়ারের নিচ থেকে বেঁচে গেলাম। কিন্তু আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেলাম না। এদিকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে ৮৩ দিন ক্ষমতায় থেকে জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে ব্যাংককে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে নানা সরকারি সুবিধা ভোগ করে দূতাবাসে চাকরি করে সুখের জীবন কাটাতে থাকে। শুনছি ক্যাপ্টেন মাজেদ নাকি একসময় ভারতে চলে আসে এবং সেখানে দীর্ঘ সময় কাটায়। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ একেবারেই অযোগ্য, দুর্বল। কী বললে খুশি হবে সরকারকে তারা তাই বলে, আসল জানেও না, বলেও না। করোনার ভয়ে ক্যাপ্টেন মাজেদ পালিয়ে আসায় র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ে গত পরশু তার দ- কার্যকর হয়। ক্যাপ্টেন মাজেদের বাড়ি ভোলায়। আমার বাড়ির জিনিসপত্র যেমনি ভেঙেছে, হয়তো ভোলায় ’৬৯-এর গণআন্দোলনের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদের ঘরবাড়িও ভেঙেছিল। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পেয়ে কর্নেল তাহের বলেছিল, ‘ওটাকে কবর দেওয়া হলো কেন? শেখ মুজিবের লাশ সমুদ্রে ভাসিয়ে দিল না কেন?’ ক্যাপ্টেন মাজেদকে ভোলায় কবর দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার হোসেনপুর গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে। সেখানেও ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ কর্মীরা কবর উঠিয়ে নিতে বলছে। করোনা না থাকলে আমিও যেতাম। আমি কোনো প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করি না। তার পরও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাংলার মাটিতে দাফন করে দেশের মাটি কলঙ্কিত করা আমারও বুকে বাঁধে। এ রকম মানুষের দাফন হওয়া সত্যিই কষ্টকর, মাটি পাওয়া কষ্টকর। বঙ্গবন্ধুর বুকে যখন ওরা গুলি চালাচ্ছিল আমি সব সময় ভাবী তখন বঙ্গবন্ধুর আত্মা কেমন ছটফট করছিল। নারী-শিশুদের ওপর এই সিমাররা যখন গুলি চালিয়েছিল তখন তাদের কি একবারও মনে হয়নি একদিন না একদিন তাদের কপালেও দুর্যোগ নেমে আসবে, হয়তো দেশের মাটি ভাগ্যে হবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বোন শেখ হাসিনা সময় অনেক পার হয়ে গেছে। এই খুনিদের যেখানে সেখানে কবর দেওয়া ঠিক না। এদের জন্য আলাদা একটা কবরের জায়গা করুন। যেখানে গিয়ে সাধারণ মানুষ তাদের ঘৃণা ব্যক্ত করতে পারত। তা কিন্তু হলো না। দন্ডের পরে কেউ নিজেদের পারিবারিক গোরস্থানে, কেউ আবার শ্বশুরবাড়িতে।

এটা কোনো ভালো কথা না। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, মাজেদের নাতি ছাত্রলীগ নেতা। এতে আবার অবাক হওয়ার কী আছে? মাজেদ, ফারুক, রশীদ, ডালিমরা বঙ্গবন্ধুকে প্রত্যক্ষভাবে বুলেটের মাধ্যমে শারীরিকভাবে হত্যা করেছে আর মতিয়া চৌধুরীরা তাকে তিলে তিলে রাজনৈতিক, সামাজিকভাবে হত্যা করেছে। সেই মতিয়া চৌধুরী ও অন্যরা যদি দাপটে নেতাগিরি করতে পারে, তাহলে বঙ্গবন্ধুর খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদের নাতির ছাত্রলীগ নেতা হতে দোষ কোথায়?

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর