বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে ভারতের লড়াই মাঠপর্যায়ে কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে?

শৈলজা চন্দ্র

কভিড-১৯ যখন বিশ্বকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তখন ভারতের প্রান্তিক অঞ্চল ও ঘনবসতিপূর্ণ শহরাঞ্চলে এ রোগের বিস্তার সম্পর্কে খুব কমই তথ্য মেলে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এটি কীভাবে সামলানো হচ্ছে। ভারতের পরিণতি কি চীন, ইতালি ও ইরানের মতো বা আরও খারাপ হতে যাচ্ছে? ১৩০ কোটি মানুষের দেশে, যা প্রায়ই দুর্বল ও বিশৃঙ্খল, স্বাস্থ্য সুবিধাহীন এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে জনবলের অভাবসম্পন্ন দেশ বলে পরিচিতি পায় সেখানে এর ফল কী হবে? সম্ভবত ভারতের প্রশাসনের দক্ষতা এবং এ সংকটের প্রতি জনস্বাস্থ্যের প্রতিক্রিয়াই কোনো অলৌকিক প্রতিষেধকের বদলে ভারতের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভারতের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ গ্রামীণ। প্রায় ৭২৮টির বেশি জেলার ৬ লাখ ৫০ হাজার গ্রামে তাদের বসবাস। ৩১ মার্চ সন্ধ্যা অবধি দেশজুড়ে ২৪ ঘণ্টায় ১৪৬টি নতুন সংক্রমণসহ ১ হাজার ৩৯৭ জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে এবং মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫। মানুষ এ রোগের ভয়াবহতা আঁচ করার অনেক আগেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও সংক্রমণের চিত্র এমন।

জেলা ও রাজ্য পর্যায়ে স্বাস্থ্য সংকট ব্যবস্থাপনা : ভারত শুরুতেই ভারতীয় নাগরিকসহ বিদেশিদের আগমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং সমস্ত অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল বাতিল করেছিল। ভারতীয় রেলপথ, যা বছরে সমগ্র বিশ্বের জনসংখ্যার সমপরিমাণ যাত্রী বহন করে, তা চলাচলের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২৫ মার্চ দেশব্যাপী একটি লকআউট আরোপ করা হয়, যেখানে কেবল একান্ত প্রয়োজন ও ওষুধ ছাড়া একাধিক ব্যক্তির বাইরে যেতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। ভারতীয় সংবিধানের অধীনে স্বাস্থ্য রাজ্য স্তরে পরিচালিত হয়। তবে মহামারী নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশাবলি অবশ্যই সমস্ত রাজ্যের পালন করতে হবে। জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৫ কার্যকরের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে, যেহেতু সব রাজ্যই ঝুঁকির মাত্রাটা বুঝতে পেরেছে।

ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় রাজ্যগুলোকে জেলায় ভাগ করা হয়েছে, যার প্রতিটি কয়েক হাজার গ্রাম নিয়ে গঠিত এবং বিশ্বের কোথাও এ ধরনের সাংগঠনিক কাঠামো পরিচালনার নজির নেই।

জেলা প্রশাসন ব্রিটিশ আধিকারিকদের দ্বারা পরিচালিত ঔপনিবেশিক সরকার থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত যারা একসময় ঘোড়ায় চড়ে জেলা ভ্রমণ করতেন। ঘোড়াগুলো অদৃশ্য হয়ে গেলেও প্রশাসনিক কাঠামোটি এখনো দেশজুড়ে রয়েছে। এখন এটি ডিজিটালি দক্ষ, সুনির্দিষ্ট এবং দ্রুত (অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংকটময় সময়ে)।

প্রতিটি জেলার নেতৃত্বে একজন জেলা প্রশাসক বা কালেক্টর থাকেন যিনি বেসামরিক প্রশাসনের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং দুর্যোগের সময় তার এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় যে কোনো ব্যক্তিকে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

কীভাবে জেলা কর্তৃপক্ষের একটি একক লাইন কর্ম সম্পাদনে সহায়তা করে : এ রকম সময়ে, জেলা প্রশাসকের ক্ষমতা প্রশ্নাতীত এবং নিরঙ্কুশ। তারা খালি ভবন, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন পরিবহন, হোটেল এমনকি জনবলও অধিযাচন করার ক্ষমতা রাখেন এবং সমস্ত চলাচল বন্ধ বা পরিবর্তনের আদেশ দিতে পারেন। তারা বাড়ি পরিদর্শন এবং ডকুমেনটেশন ও রিপোর্টিং সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। এ কার্যক্রম লাইন বিভাগ দ্বারা কার্যকর এবং পুলিশ দ্বারা প্রয়োগ করা হয়, যারা নিজেরাই জেলা প্রশাসককে প্রতিবেদন দেয়। অন্য কোনো দেশের এমন কোনো নেটওয়ার্ক নেই যেখানে প্রশাসনিক ব্যবস্থাগুলোকে এত দ্রুত সক্রিয় করতে পারে এবং এটি গ্রাম-শহর, ধনী-দরিদ্র প্রতিটি বাড়িতে পৌঁছাতে পারে। রোগের প্রাদুর্ভাবের সময়, কম কার্যকর কিন্তু এখনো নির্ভরযোগ্য জনস্বাস্থ্য সেবাদানকারীরা সক্রিয় হন এবং প্রয়োজন বোধে সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী, সহায়ক নার্স ও মিডওয়াইফ এবং বহুমুখী পুরুষ কর্মীদের বাড়ি বাড়ি পাঠানো হয়। জেলা কর্তৃপক্ষ তার একক লাইনের কারণে (যা বিপর্যয়ের সময় রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নির্ভর করে না, অন্য সময় যা ধীর এবং প্রতিক্রিয়াহীন প্রশাসন হিসেবে দেখা হয়) অবিশ্বাস্য দক্ষতার সঙ্গে সংকটকালীন পরিস্থিতিগুলোয় সাড়া দেয়। এভাবেই ভারত বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো পুনর্বাসনের পাশাপাশি পোলিও নির্মূল, এইচআইভি/এইডস এমনকি প্লেগ সংক্রমণ রোধ করেছিল। গুটিবসন্তের কথা তো বলাবাহুল্য, প্রশাসনের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্ত।

রাজস্থানের ভিলওয়ারাতে যেভাবে কভিড-১৯ সংকট মোকাবিলা করা হচ্ছে : মাঠপর্যায়ে কীভাবে কভিড-১৯ মোকাবিলা করা হচ্ছে তা বুঝতে রাজস্থানের ভিলওয়ারা জেলাটিকে বিবেচনা করুন (মোট জনসংখ্যা ২.৭ মিলিয়ন), যা কভিড-১৯ সংক্রমিত বেসরকারি হাসপাতালের একজন ডাক্তার ও ১২ কর্মচারীর কারণে খবরে প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের অন্যতম দরিদ্র রাজ্যের বৃহৎ গ্রামীণ জেলা ভিলওয়ারা কেবল টেক্সটাইল ও স্ক্রল পেইন্টিংয়ের জন্যই পরিচিত ছিল। যেসব ডাক্তার ও কর্মচারী আক্রান্ত হয়েছিলেন তারা সবাই বিচ্ছিন্ন বা আইসোলেটেড হয়েছিলেন। ভিলওয়ারা (যাকে বিবিসি ‘ভারতের সম্ভাব্য ইতালি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল) কীভাবে এতে সাড়া দিয়েছে? ২৬ মার্চের মধ্যে, জেলার ২ মিলিয়নের অধিক লোককে (যা জনসংখ্যার ৮৮ শতাংশ) ঘরে ঘরে গিয়ে জরিপ করা হয়েছিল।

২৮ মার্চ নাগাদ জেলা প্রশাসক শতভাগ জরিপ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন। এটি সত্যিই করা হয়েছিল এবং জেলার মোট ২৬ লাখের বেশি মানুষকে যাচাই-বাছাই করে কয়েক শ। পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করা এবং তাদের ফোনে ও ব্যক্তিগতভাবে নজরদারির আওতায় রাখা হয়েছে।

জেলার নগর অঞ্চলের তৃতীয় জরিপের পাশাপাশি গ্রামীণ অঞ্চলের একটি দ্বিতীয় জরিপ চলমান রয়েছে। হোটেল, রিসোর্ট, বোর্ডিং লজ ও জেলা হাসপাতালে প্রস্তুত করা শয্যাগুলোর একটি তালিকা আমাকে তৎক্ষণাৎ সরবরাহ করা হয়েছিল।

প্রথম জরিপে শহরাঞ্চলে ২ হাজার ৫৭২ জনের শরীরে ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় লক্ষণ পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু দ্বিতীয় নগর জরিপে এ সংখ্যাটি কমে দাঁড়িয়েছে ৮৪২-এ। সংক্রমিত ব্যক্তিদের পরীক্ষায় কভিড নেগেটিভ ফল আসা শুরু হয়।

জাতীয় অভিবাসন ও রেল কর্তৃপক্ষের তথ্য কার্যকরভাবে ব্যবহার করা : অন্য রাজ্যগুলোর কী অবস্থা? ২০১৮ সালে ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন সূচকে ভারতের ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড় ও উড়িষ্যা সর্বনিম্ন সংখ্যার রাজ্যে স্থান পেয়েছে। তিনটি রাজ্যেই প্রথম সারির স্বাস্থ্যকর্মীরা দিনরাত সঙ্গনিরোধে থাকা মানুষদের দেখতে যান। প্রতিটি সন্দেহভাজনকে অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার রিপোর্ট তৈরি না হওয়া পর্যন্ত সন্দেহভাজন ও তার পরিবারকে পৃথক রাখা হয়। এ তিনটি রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিবরা নিশ্চিত করেছেন যে এটি প্রতিদিন অব্যাহত থাকবে। জাতীয় অভিবাসন ও রেল কর্তৃপক্ষের রেকর্ড এবং ইশতেহার ব্যবহার করে কেসগুলো প্রথম চিহ্নিত করা হয়েছিল। জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র কর্তৃক পরিচালিত ইনটিগ্রেটেড ডিজিজ সার্ভিল্যান্স প্রোগ্রামটি ২০১০ সালে এইচ-১ এন-১-এর প্রাদুর্ভাবের সময় প্রচলিত একটি কল সেন্টারভিত্তিক রিপোর্টিং সিস্টেমের মাধ্যমে হটস্পটগুলো শনাক্ত করে। জেলা প্রশাসন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সচল রয়েছে।

শুধু স্বাস্থ্য খাতেই, চারটি দল কাজ করে : আন্তরাজ্য স্তরে, জেলাগুলোর মধ্যে, সংলগ্ন জেলাগুলোর মধ্যে এবং রাজ্যগুলোর স্বাস্থ্য সচিব ও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সচিবের মধ্যে- এর পুরোটা সম্পন্ন হয় ফোনে। দিল্লিতে হঠাৎ হাজার হাজার অভিবাসী তাদের গ্রামে ফিরে যাওয়ার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তারা হেঁটে বা কোনো চলমান বাহনে ভ্রমণ করেছিল। তবে সুসংবাদ হলো, এদের চিহ্নিত করা হচ্ছে, পৃথককৃত ও পরীক্ষা করা হচ্ছে। এমনকি খাদ্য ও আশ্রয় দেওয়া হয়েছে ১ হাজার নয়, বরং হাজারে হাজারে।

কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে ভারতের লড়াইয়ে প্রচুর মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার ব্যবহার : বিপুল মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা ব্যবহার করে অন্য দেশগুলোর কাছে অজানা এক উপায়ে ভারত সক্রিয়ভাবে কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

কেন্দ্র, রাজ্য ও জেলাগুলো বৈদ্যুতিকভাবে সংযুক্ত এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রতিদিন ভিডিও কনফারেন্স পরিচালনা করেন। নগদ হস্তান্তর, খাদ্য, পেনশন, রান্নার গ্যাস ইত্যাদি সুবিধাসংবলিত একটি উদার অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে দরিদ্রদের জন্য। সব স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য সরকারি খরচে বীমা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষুধার্তদের জন্য লঙ্গরখানা চালু হয়েছে। দিল্লিতে ১ এপ্রিল থেকে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে চাহিদা অনুসারে খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা শুরু হবে।

এতক্ষণে পরিস্থিতি সামলে নেওয়া যাবে বলে মনে হলেও তাতে জল ঢেলে দিয়েছে দিল্লির নিজামুদ্দিনের একটি সমাবেশের সংবাদ, যার অনেকেই কভিড-১৯ দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে। দর্শনার্থীরা অন্যান্য দেশ থেকে ভারতে এসেছিলেন এবং সংক্রমিত লোকেরা বিভিন্ন রাজ্যে ভ্রমণ করেছেন। দেশব্যাপী লকডাউন কার্যকর হওয়ার অনেক আগেই, দিল্লিতে ১৩ মার্চ থেকে ৫০ জনের বেশি লোকের যে কোনো সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এটি পুরোপুরি অনিয়ন্ত্রিত একটি সমাবেশ ছিল।

ভারতীয় প্রশাসন চেষ্টার কোনো কমতি রাখবে না : আবারও জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিভাগ চিরুনি অভিযান শুরু করেছে যাতে কেবল সমাবেশে অংশ নিয়েছিল এমন ব্যক্তিদেরই নয়, তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি ও তাদের যোগাযোগের ব্যক্তিদেরও চিহ্নিত করা হবে। এদের খুঁজে বের করা আবারও জনস্বাস্থ্যের একটি ক্ষুদ্র বিভাগের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল; যার সাফল্যের পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে। কভিড-১৯ সংকট অবশ্যই আরও খারাপ হবে। তবে সবার জন্য এটা আশাজনক যে, আমাদের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা সংস্থা, সবচেয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলো একত্রিত হয়ে কাজ করার পরও, ভারতীয় প্রশাসনিক এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশাবলি অনুসারে সংক্রমণ শনাক্তকরণ এবং সেটাকে মোকাবিলায় কোনো প্রকার কমতি রাখবে না। আমাদের অবশ্যই এসব লোককে কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে যারা এটিকে সম্ভব করছেন। আমাদের কৃতজ্ঞ থাকতে হবে যে ভারতের এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব, দক্ষতা ও অঙ্গীকার আছে। কাউকে সমালোচনার সময় নয় এটি, অন্তত সমস্ত রাজ্য ও জেলাকে তো নয়ই।

সর্বশেষ খবর