শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

সৈয়দ রেজাউল হায়াতকে যেমন দেখেছি

কারার মাহমুদুল হাসান

সৈয়দ রেজাউল হায়াতকে যেমন দেখেছি

আজ ১৬ এপ্রিল, ২০২০ সাল- প্রয়াত সৈয়দ রেজাউল হায়াতের অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল ভোরবেলায় তিনি তার স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও অগণিত শুভাকাক্সক্ষীকে ছেড়ে এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন পরম করুণাময়ের সান্নিধ্যে। দেখতে দেখতে আটটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল, অথচ মনে হয় এই সেদিনও আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি, হরেকরকম অভিজ্ঞতা, আনন্দ-দুঃখ-বেদনার কাহিনিমালা বলে গেছি, শুনে গেছি। সে সবই আজ স্মৃতি।

এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার দুই দিন আগেও আমরা একসঙ্গে বসে অফিস করেছি। তার জীবনের শেষ অফিস ছিল চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব লজিস্টিকস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট, (CILT)  বাংলাদেশ কাউন্সিল যার কেন্দ্রীয় অফিস লন্ডনে অবস্থিত, যা স্থাপন করা হয়েছিল ১৯১৯ সালে। আমি তখন ওই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট, সেই সঙ্গে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছিলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) এম এইচ খান, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নৌবাহিনী প্রধান।

আন্তর্জাতিক পরিবহনসংশ্লিষ্ট (নেট, বিমান, সাপ্লাই চেইন ইত্যাদিসহ) চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব লজিস্টিকস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট, সংক্ষেপে CILT-এর পৃথিবীতে ৩০টির বেশি দেশে এর ব্রাঞ্চ ছিল। বাংলাদেশে এ ব্রাঞ্চটি স্থাপিত হয় ১৯৯৯ সালে।

আন্তর্জাতিক এ প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ ব্রাঞ্চের প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রায় দুই-আড়াই বছর দায়িত্ব পালন শেষে ২০১২ সালের ১৪ এপ্রিল আমাদের শেষবার বলে গেলেন, ‘আগামী কয়েকদিন তিনি অফিসে আসবেন না, কারণ তিনি তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী, যা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরপরই শুরু করেছিলেন, তার মাত্র কমবেশি অর্ধেক তিনি সম্পন্ন করে এনেছেন, বাকি অর্ধেক এখন শেষ করতে চান, তাই সময় থাকতে তিনি এদিকটা একটু গুছিয়ে আনতে চান যত দ্রুত সম্ভব। কিন্তু তিনি ইচ্ছা পূরণ করতে পারেননি।

সৈয়দ রেজাউল হায়াতের CILT-তে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রথম যখন তাকে প্রস্তাব দিই তখন তিনি এ প্রতিষ্ঠানে দেশের জন্য কাজ করার কোনো সুযোগ আছে কিনা জানতে চান। আমি বললাম সিআইএলটি একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান, পাঁচ-সাত বছর পর এটি তার শতবাষির্কী পূর্তি অনুষ্ঠান পালন করবে। বললাম, সিআইএলটি যেহেতু মূলত সড়ক-মহাসড়ক, রেলওয়ে, মেরিটাইম, সিভিল এভিয়েশন বিষয়াদিসহ এতদ্সংশ্লিষ্ট শিক্ষা-প্রশিক্ষণধর্মী কার্যাদি সম্পাদনে সদাসচেষ্ট ও নিয়োজিত এবং যেহেতু যোগাযোগ, রেলওয়ে, সেতু এবং এতদ্সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণসংশ্লিষ্ট দায়িত্ব ও কার্যাদি সম্পাদনে দীর্ঘকাল গৌরব ও সুনামের সঙ্গে অনেক বছর নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং এতদ্সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহে অনেক বছর অত্যন্ত দক্ষতা ক্ষিপ্রতা ও গৌরবের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের উজ্জ্বল রেকর্ড আপনার আছে সেহেতু আপনার মেহেরবানি করে সিআইএলটির বাংলাদেশ কাউন্সিলের দায়িত্ব গ্রহণ করলে তবে দেশের ট্রান্সপোর্টসংশ্লিষ্ট সেক্টরের জন্য পরামর্শমূলক অনেক বড় মাপের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সুযোগ পাবেন।

ওই রাতেই ২ ডিসেম্বর, ২০০৯ হায়াত স্যার ফোন করে আমাকে বললেন, কাবার ঈওখঞ ওয়েবসাইট আমি ভালোভাবে দেখেছি এবং আমার দৃঢ়ভাবে মনে হয়েছে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া এবং সার্বিকভাবে ট্রান্সপোর্ট সেক্টরের জন্য কাজ করার সুযোগ যেন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অতি বড় আশীর্বাদ। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে এত বছর পরও এমন কয়েকটি কথা বলে আরও বললেন, ‘আমি দু-এক দিনের মধ্যে সিআইএলটি অফিসে আসছি এবং আপনাদের সম্মতি নিয়ে সিআইএলটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে আপনাদের পাশে থেকে দেশের ট্রান্সপোর্ট সেক্টরের জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করতে চাই।’ আমি শুকরিয়া আদায় করলাম এবং বললাম, আপনি দ্রুত আসুন, আমরা আপনার অপেক্ষায় রইলাম।

পরদিন হায়াত স্যার বাংলামোটর চৌরাস্তায় অবস্থিত এম এইচ খান টার্মিনালে সিআইএলটি অফিসে চলে এলেন, ঘুরে ঘুরে অফিসটি দেখলেন, অফিসের সমৃদ্ধ লাইব্রেরির বিভিন্ন বই হাতিয়ে দেখলেন, সহকারীদের সঙ্গে কথা বললেন এবং সবশেষে তার জন্য রক্ষিত রুমে এসে বসে সবার সঙ্গে চা-পানে অংশ নিলেন। এরপর পরবর্তী দুই দিনের মধ্যে তার বায়োডাটা প্রস্তুত করে মূলত ট্রান্সপোর্ট সেক্টরে তার জীবন ও কর্ম, অভিজ্ঞতা, তার অবদান, সেই সঙ্গে যমুনা সেতু, পাকশী সেতু, রূপসা সেতু, ভৈরব সেতু, দাউদকান্দি ও বুড়িগঙ্গা সেতু, গাবখান সেতু, বিশেষত উত্তরবঙ্গের শত শত কিলোমিটার বিশ্বব্যাংক সহায়তায় নির্মিত সড়ক-মহাসড়ক ইত্যাদির কিছু কিছু বিবরণ উল্লেখ করে CILT membership বিষয়ে অনুমোদন প্রার্থনা করার অনধিক দুই সপ্তাহের মধ্যে  CILT- -এর  সর্বোচ্চ গ্রেড Fellow হিসেবে ওই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য পদ প্রদান করা হয়। তার মতো ভদ্র, সজ্জন, গুণী, অভিজ্ঞ ও উঁচুমাপের অভিভাবক পেয়ে বাংলাদেশ সিআইএলটি পরিবার ধন্য হলো, সমৃদ্ধ হলো। সৈয়দ রেজাউল হায়াত বাংলাদেশ প্রতিদিনে নিয়মিত কলাম লিখতেন। এ পত্রিকায় ‘চল চল ইয়াঙ্গুন চল’ শিরোনামে সর্বশেষ কলামটি লিখেছিলেন ২৮/০৩/১২ তারিখে। এটি ছিল অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। পাঠক! কষ্ট করে এ কলামটি পড়ে দেখতে পারেন।

                লেখক : সাবেক সচিব

 Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর