রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

ডাক্তার বাঁচলে দেশ বাঁচবে

হাবীব ইমন

করোনাভাইরাসের লাশের মিছিলে যোগ হলেন একজন বীর যোদ্ধা চিকিৎসক। গরিবের ডাক্তার নামে তিনি পরিচিত। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন মারা গেছেন। তিনি পিপিই ছাড়া তার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আমরা দেখেছি, কত সাধারণ মানুষ পিপিই পরে চলাফেরা করছে। অথচ একজন ডাক্তারকে তার দায়িত্ব পালন করতে হলো পিপিই ছাড়াই। এ ব্যর্থতা, লজ্জা, অক্ষমতার দায় আমাদের সবার। এ কলঙ্ক আজীবনের।

সারা পৃথিবীতে ডাক্তারদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সর্বোচ্চ হার বাংলাদেশে। কেন? পিপিইর বদলে রেইনকোট সাপ্লাই দেওয়া হয়েছে। কারা করে এ দুর্নীতি? একটা আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের জন্য তিনি আকুতি জানিয়েছিলেন। ডা. মঈনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটা অ্যাম্বুলেন্সও পাওয়া গেল না। কেন?

বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন বলছে, ৩৩ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত। একজন চিকিৎসক করোনায় মৃত। আরও ৯৪ জন চিকিৎসক কোয়ারেন্টাইনড হওয়ার খবর জানা গেছে। সরল অঙ্কে প্রতি ৪০০ রোগীতে প্রায় ১২০ জন চিকিৎসক ওয়ার্ক ফোর্সের বাইরে চলে যাচ্ছেন। সে হিসাবে ১ লাখ রোগী হলে এমনিতেই ৩০ হাজার চিকিৎসক মাঠের বাইরে চলে যাবেন, যা মোট চিকিৎসকের তিন ভাগের এক ভাগ। সরকারি চিকিৎসকের সংখ্যা সব মিলিয়ে ৩০ হাজার হবে হয়তো। সেদিন চিকিৎসার ফ্রন্টলাইনে কারা থাকবে?

অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, যে সার্জারি ইউনিটে করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গিয়েছিল, সেই ইউনিটের চিকিৎসকদের কোয়ারেন্টাইনের আবেদনের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। চিকিৎসকরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ঢাল-তলোয়ার ছাড়া যুদ্ধে নামিয়ে দিয়ে এখন জীবনবিমা আর ইনসেনটিভ ঘোষণা করাটাকে বড্ড বেমানান লাগছে!

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বিরাট অংশ জীবন সংকটে নিপতিত। আক্রান্তদের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা সবচেয়ে জরুরি। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধা হিসেবে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী প্রমুখকে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর মুখে পতিত হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে সেবা দিতে হচ্ছে। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে অসীম মানবিক কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করার ভিতর দিয়ে এসব মানুষ সমসাময়িককালের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে স্বীকৃত হবেন। সাহসের সঙ্গে তারা তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের এ সাহসী কাজে তাদের পাশে সমগ্র জনগণকে দাঁড়াতে হবে। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া যেমন যুদ্ধে শত্রুকে মোকাবিলা করা যায় না, তেমনি যথাযথ সুরক্ষা ছাড়াও করোনাভাইরাস সৃষ্ট কভিড-১৯ রোগের চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। তাই ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের মাস্ক, পিপিই, স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা, সংক্রামক থেকে সুরক্ষার সরঞ্জামাদি, উপযুক্ত বাসস্থান ইত্যাদি থাকাটা অপরিহার্য। সর্বস্তরে সুরক্ষাসহ এ ধরনের যাবতীয় ব্যবস্থা সর্বাগ্রে গ্রহণ করা জাতির স্বার্থে প্রয়োজন। এসব ব্যবস্থা না করেই তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সেবা আশা করা যায় না। তাই তাদের জন্য বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। ধমক, চাকরিচ্যুতি, ভয়ভীতি প্রদর্শন করে যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে লড়াইয়ে যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করা যায় না। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ও জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণে সরকার অবহেলা ও বিলম্ব করছে। সরকারকে এ ত্রুটি দ্রুত সংশোধনের দাবি জানাচ্ছি। আমরা ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের জানাতে চাই- আমরা তাদের পাশে আছি। যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনের এসব সৈনিককে জাতীয় বীরের মর্যাদা দিয়ে জাতি তাদের অবদান চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। মনে রাখতে হবে, ‘ডাক্তার বাঁচলে দেশ বাঁচবে’।

ডাক্তারদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। একই সঙ্গে আমি ধন্যবাদ জানাব তাদের পরিবারকে। আপনারা চিকিৎসক পরিবারের অংশ হওয়ার জন্য এ মুহূর্তে উচ্চ ঝুঁকিতে পড়ে গেছেন। বিশেষ করে সেসব বয়োবৃদ্ধ পিতা-মাতা, যারা আপনাদের চিকিৎসক সন্তানের কন্টাক্টে আসছেন, তবু আপনারা ধৈর্য ধরে আছেন, সন্তানকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন। সম্পূর্ণ সমাজ, প্রশাসনিক যন্ত্র যখন ডাক্তারদের বিরুদ্ধে চলে গেছে, আপনারাই একমাত্র তাদের বেঁচে থাকার এবং অন্যদের বাঁচানোর প্রেরণা। আর যারা গোপনে, একান্তে দান করে যাচ্ছেন, মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, ধন্যবাদ দিয়ে আপনাদের পুণ্যকাজগুলো ছোট করতে চাই না। হয়তো সত্যজিৎ রায়ের ‘গণশত্রু’ মুভি সিনেমাওয়ালা অনেক মানুষ দেখে থাকবেন। এক ডাক্তারকে ঘিরে এ সিনেমা। এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয় ডাক্তারকে সবাই খুব সম্মান করেন। হঠাৎ তিনি দেখতে পান তার চেম্বারে প্রচুর কলেরা, ডায়রিয়ার রোগী আসতে শুরু করল। তিনি খোঁজ নিয়ে, এলাকায় ঘুরে বুঝতে পারেন এলাকার যে বড় ও বিখ্যাত মন্দির আছে, সেই মন্দিরে যারা পুজো দিতে যাচ্ছেন, যারা সেই মন্দিরের জল প্রসাদ হিসেবে খাচ্ছেন, সেসব পূজারিই রোগী হয়ে আসছেন তার চেম্বারে। তিনি উদ্যোগ নিলেন এ প্রাদুর্ভাব দূর করার। এলাকার গণ্যমান্য সবাইকে বললেন মন্দির বন্ধ করে দেওয়া দরকার এখন।

রাজনৈতিক লোকেরা ভাবলেন, মন্দির ঘিরেই সেই এলাকার অর্থনীতি ঘুরছে, মন্দিরের পূজারিদের ভোটের ভাগ তারাও পান। তার চেয়ে বড় কথা, মন্দির বন্ধ করলে স্বাভাবিকভাবে তাদের ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে!

পুরোহিতরাও ভাবলেন, মন্দির বন্ধ হলে তাদের আয় বন্ধ। এটা কিছুতেই বন্ধ হতে দেওয়া যাবে না।

রাজনীতিবিদ, পুরোহিত এবং অন্য গণ্যমান্যরা মিলে সাধারণ মানুষকে বোঝালেন, ডাক্তার ধর্মবিরোধী। তার নিজের ধর্ম নেই, বাকি সবার ধর্ম নষ্ট করাই তার উদ্দেশ্য। এ কুমতলব কিছুতেই সফল হতে দেওয়া যাবে না, ডাক্তারকে প্রতিরোধ করা লাগবে।

মানুষজন প্রভাবশালীদের কথায় কনভিন্সড হয়। মিছিল নিয়ে ডাক্তারের বাসায় আক্রমণ করে, তাকে ব্যাপকভাবে হেনস্তা করে। সেই মিছিলের প্রায় সবাইকেই ডাক্তার সাহেব সারা জীবন ধরে সেবা দিয়ে এসেছিলেন। এ হেনস্তা, অপমান ডাক্তারকে এক গভীর বিষাদে ডুবিয়ে ফেলে, তিনি সপরিবারে এলাকা ছেড়ে চলে যান। জনহিতৈষী ডাক্তার হয়ে ওঠেন ‘গণশত্রু’! ডা. মঈনকে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হোক।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগরী।

সর্বশেষ খবর