বৃহস্পতিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা ভাবনা

তসলিমা নাসরিন

করোনা ভাবনা

করোনাভাইরাস সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীরা দেন না। তাঁরা বলেন, এই ভাইরাস নতুন, আমরা এখনও গবেষণা করছি, সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। কিন্তু তারপরও কিছু অনুমান তো করা যায়। কেন দক্ষিণ এশিয়ায় করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাটা ইউরোপ আর আমেরিকার মৃত্যুর সংখ্যা থেকে কম? বেশ কিছু অনুমান হাওয়ায় ভাসছে। এক, বিসিজি টিকা। এখানকার মানুষকে যক্ষ্মা প্রতিরোধক বিসিজি টিকা ছোটবেলাতেই দেওয়া হয়। চোখে পড়ছে যেসব দেশে বিসিজি টিকা দেওয়া হয়, সেসব দেশের মানুষ তুলনায় কম আক্রান্ত হচ্ছে, কম মারা যাচ্ছে। দুই, ইউরোপ আর আমেরিকায় আক্রমণ করছে করোনাভাইরাস এ এবং সি, আফ্রিকা এবং এশিয়ায় যে ভাইরাসটি আক্রমণ করছে, সেটি করোনাভাইরাস বি। বি ভাইরাসটি যে কোনও কারণেই হোক এ এবং সি’র মতো ভয়ংকর নয়। তিন, দক্ষিণ এশিয়ায়, ইউরোপ আর আমেরিকার চেয়ে তরুণ তরুণীর সংখ্যা বেশি। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বয়স্কদের চেয়ে ভালো। তারা হয় আক্রান্ত হচ্ছে না, আক্রান্ত হলেও সেরে উঠছে। গরম আবহাওয়ার কারণে কি কম ছড়াচ্ছে রোগ? বিজ্ঞানীরা নাকচ করে দিয়েছেন এই সম্ভাবনা। গবেষণা যেহেতু এখনও চলছে, ভাইরাস বিবর্তিত হচ্ছে, সুতরাং কোনও অনুমানকেই সঠিক উত্তর বলে ধরা যাবে না।

কোভিড-১৯ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ যদি বেশির ভাগই এ যাত্রা বেঁচেও যায়, ভাইরাসের দ্বিতীয় আক্রমণে বাঁচবে কিনা বলা যায় না। ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি যাঁরা ভালো জানেন, সেই গবেষকরা আমাদের প্রস্তুত থাকতে বলছেন দ্বিতীয় আক্রমণের জন্য। ওটি এটির চেয়েও প্রচন্ড ভয়াবহ হবে। প্রথম মহাযুদ্ধে এক লক্ষ ১৬ হাজার লোক মরেছিল, আর এই করোনাভাইরাসে এক লক্ষ সাতাত্তর হাজার আটশ’ জন মারা গেছে। তারপরও নাকি এটি কিছুই নয়। বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা বলছেন, আমরা এখনও করোনাভাইরাসের আসল চেহারাটি দেখিনি, দ্বিতীয় আক্রমণে ভাইরাস তার বীভৎস চেহারা দেখাবে। ভাইরাস এত বারবার বিবর্তিত হচ্ছে যে গবেষকরা আশংকা করছেন এটি ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো কোনও একটি সময়ে প্রতি বছর উদয় হবে। এবার আমেরিকা যে দুরবস্থা দেখেছে, সামনের শীতে নাকি এর চেয়েও বেশি দেখবে।

আমার ভয় লাগছে, দেশে দেশে কীভাবে মানুষ অস্থির হয়ে উঠছে আগের জীবনে ফিরে যেতে। তারা আর ঘরে বসে থাকতে চাইছে না। অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে, বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, উৎপাদন বন্ধ, কারখানা বন্ধ। তারা সরকারকে চাপ দিচ্ছে সবকিছু আবার খুলে দেওয়ার জন্য। খুলতে তো হবেই, ভাইরাসের সংগেই আমাদের বসবাস করতে হবে, যে মরবে সে মরবে, যে বাঁচবে সে বাঁচবে থিওরিতে। ভাইরাসে মৃত্যুর ঝুঁকি মানুষ নিতে চাইছে, কিন্তু অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকি একেবারেই নিতে চাইছে না। বয়স্কদের বাঁচাবার জন্য তরুণদের যে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, সম্ভবত তরুণরা সেই উপদেশকে আর গ্রহণ করতে চাইছে না। যারা মারা যাচ্ছে, তারা পরিবার পরিজনকে একবার চোখের দেখা না দেখেই মারা যাচ্ছে। শুনেছি দূর থেকেও বিদায় জানাতে কেউ যাচ্ছে না। সরকারি লোকেরা সৎকারের ব্যবস্থা করছে।

আগের জীবন কি সত্যিই আমরা কোনও দিন ফিরে পাবো না? বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে জীবনটি পাবো, সে এক নতুন জীবন, মোটেও আগের জীবনের মতো নয়। ভাবতেই কী রকম হু হু করে ওঠে বুকের ভেতর। বিমানে ট্রেনে বাসে ভ্রমণ, দর্শনীয় স্থানগুলোয় ঘুরে বেড়ানো, গ্রাম শহর চষে বেড়ানো, সিনেমায়, থিয়েটারে যাওয়া, রেস্তোরাঁয় খাওয়া, ভিড়ের বাজারে হাঁটা, বিয়েবাড়ি, পার্টি, কনসার্ট সব কি স্মৃতির এলবামেই রয়ে যাবে? ফিরে পাবো না? সৌহার্দ্য প্রকাশ করতে শারীরিক নৈকট্যের দরকার হয়। দূর থেকে কী করে ভালোবাসবে মানুষ? তাহলে কি মানুষ প্রেম করবে না, মা তার সন্তানকে জড়িয়ে ধরবে না, বন্ধুরা আলিঙ্গন করবে না? মানুষের জীবন থেকে কি সত্যিই উঠে যাবে ধরা ছোঁয়া, চুম্বন, আলিঙ্গন? কিছুই জানিনা। বিজ্ঞানীরা কোনও আশার বাণী শোনাচ্ছেন না, বলছেন অন্তত ২০২২ পর্যন্ত মানুষের সংগে দূরত্ব বজায় রেখো। কারণ তো একটিই, সর্বনাশা ভাইরাস পৃথিবী থেকে বিদেয় হয়নি। এই ২০২২কে হয়তো বছর বছর বদলাতে হবে। ২০৩৩ পর্যন্ত, ২০৪৪ পর্যন্ত। মানুষের সঙ্গ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে রাখতে মানুষ হয়তো বিচ্ছিন্ন থাকতেই এক সময় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। যারা পারবে না নিয়ম মানতে, তারা মরে যাবে। হয়তো প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ আক্রমণে পৃথিবীর অর্ধেক অথবা তারও চেয়ে বেশি জনসংখ্যাই বিয়োগ হয়ে যাবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অর্থনীতি চালু করতে চাইলে সবাইকে পরীক্ষা করতে হবে, হ্যাঁ সব মানুষকে। ৭৮০ কোটি মানুষকে। কার শরীরে ভাইরাস আছে, কার শরীরে নেই, তা দেখতেই হবে। বিজ্ঞানীরা তো আমেরিকাকে বলেই দিয়েছেন, যদি শহর বন্দর খুলেই দিতে চাও, তবে দিনে পাঁচ লক্ষ টেস্ট করাও, যাদের শরীরে ভাইরাস আছে তাদের আলাদা করো। এ না হলে খুব বড় ঝুঁকি নেওয়া হবে। ঝুঁকি মানুষ নিতেই চায়। ঝুঁকি নিয়েই চেনা জীবনে ফিরতে চায়। এখনও আমরা জানিনা কী হতে যাচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা যখন বলেন, আরও ভয়ংকর আঘাত হানবে এই ভাইরাস, তখন আমি ভাবি, এর চেয়ে বড় আঘাত আর কী হতে পারে, এর চেয়ে ভয়ানক বিভীষিকা আর তো কিছু হতে পারে না। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ মরে যাচ্ছে, মানুষের শ্বাস প্রশ্বাস থেকে ছড়াচ্ছে ভাইরাস, ভাইরাস পড়ে আছে এমন যে কোনও জায়গা স্পর্শ করলেই হাতে লেগে যাচ্ছে ভাইরাস, সেই ভাইরাস ফুসফুসে ঢুকে গিয়ে ফুসফুস অকেজো করে দিচ্ছে। হৃৎপি-ও বন্ধ করে দিচ্ছে, মস্তিষ্কেও ক্ষরণ ঘটাচ্ছে। এর চেয়ে ভয়ানক, মারাত্মক, মৃত্যুময় তো আর কিছু হতে পারে না। তখন ভাবি এর চেয়ে মারাত্মক একটিই হতে পারে, বাতাসে ভাইরাস ভাসবে। অসুস্থ মানুষের কাশি থেকে এক মিটার বা সাত মিটার দূরের বাতাসে নয়, সমস্ত বাতাসে! তখন হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ছাড়া মানুষের আর উপায় থাকবে না।

আমি একা ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছি, সংগে পোষা বেড়াল। এভাবে দরজা জানালা বন্ধ করে কতদিন মানুষ টিকে থাকতে পারে? এ জীবনে আনন্দ নেই, কিন্তু বেঁচে থাকা আছে। বেঁচে থাকার জন্য ভাইরাস যেমন যে কোনও পরিস্থিতিতে নিজেকে পাল্টে যোগ্য করে নেয়, মানুষও তেমন। মানুষ তেমন বলেই এত দুর্যোগে বিপর্যয়ে আজো টিকে আছে। আমি তো ভাবছি টিকা নেওয়ার দিন দরজা খুলবো, তার আগে নয়।

ভাইরাসের সংগে সম্মুখ সমরে এখন মানুষ। কে হারবে, কে জিতবে কেউ জানিনা। তবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভাইরাসকে দ্রুত হারানো সম্ভব। কিন্তু সেটা একেবারেই হচ্ছে না। আমেরিকা চীনকে দোষ দিচ্ছে, চীন আমেরিকাকে। আমেরিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে টাকা দেবে না জানিয়ে দিয়েছে। ওদিকে চীন তাদের ‘ভেজা বাজার’ আবার খুলেছে, যে বাজার থেকে ভাইরাস উঠে এসেছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল। চীনকে ওই বাজার বন্ধ করতে কি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে? না বলেনি। কেন বলেনি কেউ আমরা জানিনা। এই দুঃসময়ে এইসব রাজনীতি সবাইকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার মতো মনে হয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে জানতাম তারা ইউরোপের মঙ্গলের জন্য তৈরি। ইউরোপের এক দেশের বিপদে ইউরোপের অন্য দেশ দাঁড়ায় জানতাম। কিন্তু ইতালি আর স্পেনে যখন ভাইরাসের হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল, ইউরোপের কটি দেশ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওদের সাহায্য করতে? যে সময় জাতীয়তা ভুলে বিশ্বের এক হওয়ার কথা, পরস্পরকে সহযোগিতা করার কথা, দেশগুলো তখন মেতে আছে ঝগড়াঝাঁটিতে। মানুষের এই চরম দুর্দিনে কোনও নেতা নেই হাল ধরার, কেউ নেই যে আশা দেবে, আশ্বাস দেবে। দেশগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ভাইরাসের কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে। বিজ্ঞানীরাও দেশে দেশে বিচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করছেন। কিন্তু এই মারণ ভাইরাসকে রুখতে হলে সব দেশকে এক হয়ে কাজ করতে হবে, সব বিজ্ঞানীকে এক হয়ে ওষুধপত্র এবং টিকা আবিষ্কার করতে হবে। তা না হলে একটি জিনিসই আমরা আরও বেশি দেখতে থাকবো, মানুষের মৃত্যু। এই মহামারি যদি বিশ্বকে এক করতে না পারে, তবে কিছুই পারবে না।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর