বৃহস্পতিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

আমেরিকায় ঘরে থাকার এক মাস

ফারিয়া হোসেন

আমেরিকায় ঘরে থাকার এক মাস

২০২০-এর মার্চের প্রথম সপ্তাহ, কনোনাভাইরাসের মাত্র শুরু। অতটা সিরিয়াস নয় তখনো। ডোনাল্ড ট্রাম্প খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না। আমরা পারিবারিকভাবে একটু অস্থির। আমার বড় ভাই হার্ট অ্যাটাক করে ডালাসের একটি হসপিটালে বেশ সিরিয়াস। আমার মেয়ের middle school G Spring break চলছে। আমরা San Antonio থেকে পাঁচ ঘণ্টা driving দূরত্বে ডালাসে। বড় বোন Houston থেকে ডালাসে। এক ভাই, দুই বোন Canada   থেকে এসেছে সেখানে। এ সময় লকডাউন ঘোষণা করেছে Government। হুলুস্থূল একটা অবস্থা। হসপিটালেও কোনো ভিজিটর অ্যালাউ করা হবে না। ডাক্তার জানালেন এখনই সার্জারি হবে না। কিছুদিন অবজারভেশন, কাজেই আমাদের চলে যেতে হবে। আমরা Houston  রওনা হলাম। মনে হলো একটা যুদ্ধকালীন অবস্থা। বের হতেই দেখা গেল এক দিনে গ্যাসের দাম ৫০ সেন্টস বেড়ে গেছে। ইন্ডিয়ান গ্যাসস্টেশন মালিক সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন, যার কোনো কারণ নেই এবং একেবারে বেআইনি। রাস্তায় অতিরিক্ত জ্যাম, কোথায় যাচ্ছে সবাই?

চার ঘণ্টার ড্রাইভিংয়ে ফোনে ফোনে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথায় বুঝলাম চারদিকে হুলুস্থূল পড়ে গেছে। অফিস নাকি বন্ধ, বাসায় থেকে কাজ করতে হবে। স্কুল next week-এ খুলছে না। হাইওয়ে দিয়ে গেলেও আশপাশে যতগুলো গ্রোসারি দেখা গেল সবকটির সামনে শত শত গাড়ি। তার মানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার ধুম পড়ে গেছে। আমরা একটু ভয় পেয়ে গেলাম। নামলাম Walmart-এ, ভিতরে গিয়ে জিনিস কী কিনব। শপিং কার্টই তো পাই না। ভিতরে জিনিস নেই। হাতে করে নিলেও অস্বাভাবিক লম্বা লাইন। কিছুটা এ রকম অবস্থা দেখেছিলাম ২০০৫ সালে নিউ অরলিন্সে হ্যারিকেন ক্যাটরিনার সময়। সে সময় চালের দাম ডবল হয়েছিল। যাই হোক, ফিরলাম Houston-এ বড় বোনের বাসায়। আমার husband  ছিলেন টেক্সাসের আরেক শহরে, তিনিও husband-এ যাচ্ছেন আমাদেরকে বাসায় নিয়ে আসতে, তাকে বললাম কোনো দোকানে নেমে যদি কোনো স্যানিটাইজার বা ক্লিনিং প্রোডাক্ট কিছু পান, কিনে নিতে। তিনি চার-পাঁচটা দোকানে চেঞ্জ করে একটি  Baby Wipe শুধু কিনতে পেরেছিলেন।

পরদিন ১৩ মার্চ আমরা Houston কয়েকটি বাংলাদেশি, ইন্ডিয়ান, মেক্সিকান স্টোর ঘুরে চাল, ডাল আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে San antonio আমাদের শহরে ফিরে এলাম। ওই দিন অনেক আগে থেকেই আমাদের এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত ছিল, যদিও ৫০ জনের বেশি কোনো জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ওই দিনের দাওয়াতটি রাখা হয়েছিল। আমরা ১০-১২টি ফ্যামিলি একসঙ্গে হয়েছিলাম। সবার চোখেমুখেই একটি ভয়, একটি অনিশ্চয়তা- কী যেন হয়। কী হতে চলেছে, কেউ জানে না। পরদিন ১৪ মার্চ আমরা যে যার মতো প্রকৃত অর্থে Home quarantine হলাম। যে শব্দটি এত দিন আমাদের কাছে অজানা ছিল, সেটি আমাদের নিত্যসঙ্গী হলো, দেশি-বিদেশি News-এ, বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথায়। Social Media-তে শুধু quarantine আর quarantine!

এদিকে মেয়ের school থেকে Email ও ফোনে জানানো হলো স্কুলের বন্ধ এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। এরপর কয়েক ধাপে স্কুল বন্ধ করা হয়েছে 4 May পর্যন্ত, সঙ্গে এও বলা হয়েছে, এবারের স্কুলবর্ষে সম্ভবত স্কুল আর খুলছে না। স্বাভাবিক নিয়মে স্কুল বন্ধ হওয়ার কথা ছিল ২৮ মে। তারও আগে বলা হয়েছে, টেক্সাস স্কুল বোর্ডের পরীক্ষা STAAR TEST যা  April-এ হওয়ার কথা তা হচ্ছে না, কাজেই স্টুডেন্ট এবং গার্ডিয়ানরা যেন চিন্তিত না হন। তবে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে online-এ স্কুল শুরু হয়েছে, প্রতিদিন অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হচ্ছে, প্রয়োজনে টিচারদের সঙ্গে কথা বলা, কনসাল্ট করা যাচ্ছে। এখন যে কোনো ডাক্তার তাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করে অনলাইন, ভিডিওকলে রোগী দেখছেন। খুব সিরিয়াস রোগী ছাড়া। মল, শপিং সেন্টার অনেক আগেই বন্ধ হয়েছে। জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, গ্রোসারি, গ্যাস ছাড়া সব বন্ধ। রেস্টুরেন্ট, ফাস্টফুডের শুধু হোম ডেলিভারি চলছে। No Sitting Available.. তবে খুব অবাক হলেও সত্য, বিউটি স্যালন এবং ট্যাটু সেন্টারের আগে জিম বন্ধ হয়েছে।

আমরা শহরের North Side-এ থাকি, মোটামুটি অভিজাত এলাকা। এখানকার গ্রোসারি স্টোর H.E.B. মানে এলাহি কান্ড, কি নেই তাতে। কি বিশাল তার আয়তন। কিন্তু এখন! সাড়ে ১২টা থেকে ১টার দিকে প্রথম যেদিন গেছি যখন ভিড় কম থাকার কথা। সেলফের পর সেলফ খালি। তাতে আবার লেখা ‘No Photograph Please’ ঘি-দুধ-রুটি কিছুই পেলাম না। ম্যানেজমেন্ট থেকে বলল, প্রতিদিনই তারা প্রোডাক্ট পায়। সকালে... ৮টায় স্টোর খোলে, তবে তার আগে থেকে লাইন শুরু হয়। প্রয়োজনে আগে থেকে লাইন দিতে পারি। যা কিছু প্রয়োজন পেয়ে যাব। তবে Toilet tissue-র কোনো গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না। আর hand sanitizer আসবে না। সেটি এখন শুধু হসপিটালে সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে। গেলাম দু-তিন দিন পর ৭টা ১৫-তে। সকাল বেলা। গিয়ে দেখলাম আমি ১০৩ নম্বর লাইনে! এরপর স্টোর খুলতে খুলতে আমার পেছনে আরও প্রায় ৫০-৬০ জন জমা হয়ে গেছেন। সেদিনের লাইনের ছবি দিয়ে facebook-এ বেশ অনেক লাইকও পেয়েছিলাম। তবে স্টোর খোলার ১৫ মিনিট আগে স্টোর ম্যানেজার এসে জানালেন, দুঃখের খবর আজকে তারা  Toilet paper supply পাননি। যারা এর জন্যই এসেছেন, তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন। আশ্চর্য, বেশ কয়েকজনকে দেখলাম লাইন ছেড়ে চলে গেলেন। ৮টায় লাইন করে স্টোরে ঢুকতে দেওয়া হলো। বলা হলো,stopping cart- গুলো সব sanilize  করে নিতে, hand wash করতে। ওই দিন যা যা প্রয়োজন সবই পেয়েছিলাম। তবে limited নম্বর। একজন এক আইটেম ২ বা ৪ এর বেশি নিতে পারবেন না। যাতে সবাই প্রয়োজনীয় জিনিস পেয়ে যান।

এখন মোটামুটি অভ্যাস হয়ে গেছে। ভ্যানিটি ব্যাগটি একটি পলিথিন ব্যাগের মধ্যে করে নেওয়া। গাড়িতে উঠে গাড়ির চাবি, ক্রেডিট কার্ড, ফোন, গাড়ির স্টিয়ারিং, হাত তো অবশ্যই ভালো করে স্যানিটাইজ করা। গ্রোসারিগুলো বাসায় এনে গ্যারেজে একদিন রেখে দেওয়া। কাঁচা/সবজি/ফল সাবান দিয়ে গরম পানিতে ধোয়া। বাইরের কাপড় আলাদা বাথরুমে রেখে দেওয়া। তার পরও মন খুঁতখুঁত করে কোনো ভুল হচ্ছে না তো?

আমাদের নেইবারহুডে অনেকেই দিনের বেলা হাঁটতে বের হয়। আমিও রাস্তার এক পাশে কাউকে দেখলে অন্য পাশে চলে যাচ্ছি, হাত নেড়ে ‘হাই’ বলছে। সেদিন পার্কিং লটে দেখলাম পাঁচ-ছয় জন মহিলা গল্প করছেন, তারা পরস্পর পরিচিত, অথচ কথা বলছেন নিজেদের মধ্যে দূরত্ব রেখে। প্রতিবেশীরা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। কোনো বন্ধুর জন্মদিনে বা বিশেষ দিনে উইশ করছেন বাসার সামনে গাড়ি ড্রাইভ করে, হর্ন বাজিয়ে, বাঁশি বাজিয়ে, ফোনে ভিডিও করছেন, ছবি তুলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় তা শেয়ার করছেন। ‘সোশ্যাল ডিসট্যানসিং’। কাউকে দূরে রাখতে পারছে না বরং এখন সবাই আরও কাছাকাছি। সব সুন্দর সুন্দর ধারণা, আইডিয়া। কিন্তু এর মধ্যেও ভয়াবহ অনেক ব্যাপার আছে। যা হয়তো অনেকের জানা নেই বা আগে জানতাম না। যখন আমার মেয়ের স্কুল বন্ধ দেওয়া নিয়ে দেরি করছিল... ভাবছিলাম এ রকম একটা পরিস্থিতি অথচ স্কুল কেন বন্ধ দিতে দেরি করছে! তখন স্কুল কর্তৃপক্ষ ভাবছিল অন্য কথা। পাবলিক স্কুলে এমনও অনেক বাচ্চা আছে যাদের দুই বেলার খাবারটি পায় স্কুল থেকে। স্কুল বন্ধ হলে ওই শিশুটি না খেয়ে থাকবে, কাজেই প্রথমে তারা ওদের কীভাবে খাবার পৌঁছাবে তা নিশ্চিত করতে চাচ্ছিল। এই যে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুল বন্ধ। এই সময় স্কুল থেকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে সপ্তাহে দুই দিন করে সারা সপ্তাহের জন্য বাচ্চাদের ফ্যামিলির কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়। এই করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯-এর এই মহামারীর সময় যখন মানুষের জন্য ঘরই সবচেয়েsafe জায়গা। তখন আরও একটি ভয়াবহ বাস্তবতা হচ্ছে, কারও কারও জন্য এই ঘরও নিরাপদ নয়। এখানে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে একটি প্রচারণা দেওয়া হচ্ছে- ‘If you’re stuck at home but home isn’t safe Then call National Domestic Violence Hotline and Emergency call ৯১১-এ কল করতে বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে সারা দিন ঘরে স্বামী-স্ত্রী-বাচ্চা একসঙ্গে থাকতে গিয়ে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানান ধরনের মিমস জোকস ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এ সমস্যাগুলো ক্রমেই সিরিয়াস হয়ে উঠছে এবং উঠবে। এজন্য online-এ নানান ধরনের কাউন্সেলিংয়ের অফার আছে। মানুষকে ধৈর্য ধরতে বলা হচ্ছে। বিভিন্ন চ্যানেল, লাইভ স্ট্রিমিং অ্যাপ ফ্রি এন্টারটেইনমেন্ট অফার দিচ্ছে। এই লকডাউনের সময় হয়তো বাড়ছে, বাড়বে। কিন্তু সময় কেটেও যাচ্ছে, সময় কেটেও যাবে, সময় কেটে যায়। কিন্তু মূল বিষয় সুস্থতার সঙ্গে এই মহামারী থেকে মুক্ত হয়ে আসা। পুরো পৃথিবী আজ একসঙ্গে আক্রান্ত হয়েছে। একসঙ্গেই আবার সবাইকে মুক্ত হতে হবে। উঠে দাঁড়াতে হবে। যদি বেঁচে থাকি আমরা একটি ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছি...

 

               লেখক : প্রবাসী, সান অ্যান্টোনিও, টেক্সাস, ইউএসএ।

সর্বশেষ খবর