বৃহস্পতিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

অন্যরকম রমজান : ইবাদতের অবারিত সময়

মুফতি ওয়ালীয়ুর রহমান খান

করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই এবার মুসলমানদের জীবনে পবিত্র রমজান মাস ছায়া ফেলেছে। এ মাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দিনে রোজা পালন আর রাতে মসজিদে মসজিদে নামাজ ও তারাবিতে অংশগ্রহণ। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা গভীর আগ্রহ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন এ মহিমান্বিত মাসটি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমত লাভের আশায় উদ্যাপনের জন্য। রোজা শেষে সম্মিলিত ইফতার, দলবেঁধে মসজিদে গমন এবং তারাবিতে দাঁড়িয়ে পবিত্র কোরআনের মোহময় তিলাওয়াত শোনা এ যেন এক জান্নাতি আবহে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া। কিন্তু না, এবার এসব কিছু পুরোপুরি হচ্ছে না। কারণ, অন্যরকম এক রমজান যেন আমাদের সামনে সমাগত। বিশ^ব্যাপী করোনা দুর্যোগের কারণে অন্যান্য জনসমাগমের মতো মসজিদসমূহেও সর্বসাধারণের আগমনে বিধিনিষেধ থাকায় মুসলমানদের সম্মিলিত সব ইবাদতেই ছন্দপতন ঘটেছে। তবে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে সুযোগ এসেছে ব্যক্তিগতভাবে মহান প্রভুর দরবারে কাকুতি-মিনতি করে ক্ষমা চাওয়া এবং  বহুমাত্রিক এহেন কঠিন বিপদ থেকে মুক্তি ও তাঁর রহমত লাভের আশায় একনিষ্ঠ ইবাদত করার। ‘আল্লাহ, যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন এটি যাচাই করার জন্য যে, তোমাদের মধ্যে কে আমলে উত্তম।’ সূরা মুলক, আয়াত ২। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সর্বসাধারণকে  নিজ নিজ বাসস্থানে তারাবিসহ সব ধরনের ইবাদত-বন্দেগি সম্পন্ন করার জন্য সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের ফকিহরা নির্দেশনা দিয়েছেন। বাংলাদেশেও এ দুর্যোগে আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুর হার হ্রাস না পাওয়ায় সরকার অতি সীমিতভাবে জুমা ও জামাত চালু রেখে সর্বসাধারণকে ঘরে নামাজ আদায়ের নির্দেশনার পর এখন রমজানের তারাবির নামাজও নিজ ঘরে পড়ার আহ্বান জানিয়েছে। দেশের বিশিষ্ট ওলামা ও মুফতিদের প্রদত্ত ফতোয়ায় করোনাভাইরাসের ঝুঁকি এড়াতে সাধারণ মুসলমানদের ফরজ নামাজ ঘরে আদায়ের অবকাশ দেওয়া হয়েছে। এর আলোকেই তারাবির সুন্নাতে মুয়াক্কাদা নামাজ ঘরে পড়ার জন্য সর্বসাধারণকে সরকারপ্রধান আহ্বান জানিয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত যদি সর্বসাধারণের জন্য সারা মাস মসজিদে আগমনে বিধিনিষেধ বহাল থাকে তাহলে মসজিদের খতিব-ইমাম-মুয়াজ্জিন, খাদেম ও একান্ত মুসল্লিরা ছাড়া অন্যসব মুসল্লিকে বাড়িতেই তারাবি পড়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। ঘরের পরিবেশে একনিষ্ঠভাবে দীর্ঘ সময় ইবাদত করায় আসলে আমরা অভ্যস্ত নই। এটি হবে দেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য এক কঠিন সাধনা ও নতুন অভিজ্ঞতা। এমনকি যারা পূর্ণ রমজান মসজিদে দীর্ঘ সময়ব্যাপী তারাবির নামাজ আদায়ে অভ্যস্ত তাদের জন্যও একাকী ঘরে ২০ রাকাত তারাবি নিয়মিত আদায় করাটা কষ্টকর হবে। মসজিদে জামাত না পেলে ফরজ নামাজ একাকী আদায় করাটা যেমন অনেকের কাছে ভারী মনে হয়, মসজিদে তারাবি পড়ার সুবিধা না থাকলে সাধারণ মুসল্লি বিশেষ করে তরুণদের একটি অংশ অলসতা ও উদাসীনতার কারণে দু-চার দিন আদায়ের পর তারাবি থেকে ঝরে পড়তে পারে। একান্ত সাধনার নিয়তে যারা এই দীর্ঘ নামাজ আদায় করতে সুদৃঢ় থাকতে পারবেন তাদের পক্ষেই সম্ভব হবে এটি পালন করা। কারণ, মসজিদে সমবেত হয়ে ইমাম ও হাফেজদের সুমধুর তিলাওয়াতে মগ্ন হয়ে এ লম্বা নামাজ আদায় করার মধ্যে তেমন কোনো ক্লান্তি বা অলসতা আসে না। মসজিদে যাওয়ার তাড়া না থাকলে সারা দিন রোজা রেখে ইফতারের পর ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর নিয়ে একাকী এশা, তারাবি ও বিতরের নামাজ আদায় করাটা বেশির ভাগ মানুষের কাছেই ভারী মনে হবে। এমনিতেই এসব মানুষ বিধিনিষেধের মধ্যে এত দিন ফরজ নামাজ ঘরে আদায় করে আসছেন। তারাবির এই দীর্ঘ সুন্নাত নামাজ নিজ নিজ ঘরে কতজন পরিপূর্ণরূপে আদায় করবেন তা নিয়ে আলেমসমাজের একাংশ চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন।  তারাবিতে কোরআন খতম করার যে সুন্নাত তা তো সর্বসাধারণের পক্ষে এ বছর পালন করা দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা হোক, তারাবি নামাজ আমাদের দেশের মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জীবনভর তাঁরা রমজানে এ ইবাদতটি সমবেতভাবে পালন করে আসছেন। তাই এ বছর রমজানে একাকী বা ঘরোয়াভাবে নিয়মিত ওই ইবাদতটি পালন করাটা হবে সর্বসাধারণের জন্য বড় সাধনা বা চ্যালেঞ্জ। তথাপি এ অফুরন্ত ফজিলত ও সওয়াবপূর্ণ সাধনায় সফল হওয়ার জন্য সবাইকে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হতে হবে। ভাবতে হবে, আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো আমরা যেন পৃথিবীতে তাঁর দেওয়া নিয়ামত ভোগ করে কেবল একনিষ্ঠভাবে তাঁরই ইবাদত করি। তাই মসজিদে না যাওয়ার যে অপূর্ণতা তা পূরণের চেষ্টা করতে হবে ঘরের ইবাদতের পরিমাণ ও গুণগতমান বাড়িয়ে।

কেবল নামাজ ও তারাবি নয়, এই অফুরন্ত অবসরে আমাদের উচিত বিশ্রাম ও একান্ত জরুরি কাজের পর দিনরাতের পুরো সময়টুকু মহান আল্লাহর ইবাদতে কাটানো। বিশেষ করে রমজানের মাসটিতে আমাদের ঘরবাড়ি যেন হয়ে যায় মসজিদ আর প্রতিটি রাত যেন হয় শবেকদর।  আমাদের সবাইকে মনে করতে হবে যে, আমরা দুনিয়ার ব্যস্ততার কারণে জীবনের কোনো সময়ই মাওলার সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হয়ে তাঁর ইবাদতের হক আদায় করতে পারি না। এজন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে এবারকার এই দুর্যোগময় মাহে রমজানে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লাগতে হবে। মনে করতে হবে, তওবা করে আল্লাহর দিকে ফেরার একটি সুযোগ এসেছে মুসলিম উম্মাহর জীবনে। সব আনুষ্ঠানিকতা ও গণআয়োজন ছাড়া একান্তভাবে প্রত্যেকে নিজ নিজ অপরাধের ক্ষমা চাওয়া এবং মহান আল্লাহর সাহায্য, রহমত ও নাজাত পাওয়ার সাধনায় ফরজ, সুন্নত, নফলসহ সব ধরনের ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার জন্যই হয়তো আল্লাহ এই করোনা মহামারীর সতর্ক ঘণ্টা বাজিয়েছেন। তিনি তো বলেছেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে; যাতে তিনি তাদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ সূরা রুম, আয়াত ৪১। এবারের রমজান আমাদের উত্তম আমলের মাধ্যমে আল্লাহর পথে ফিরে আসার সেই সুযোগ অবারিত করে দিয়েছে।

                লেখক : হাদিস ও ফিকাহবিদ              ইসলামিক ফাউন্ডেশন।

সর্বশেষ খবর