শুক্রবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাযুদ্ধ এবং আমাদের রাজনীতিকরা

মহিউদ্দিন খান মোহন

করোনাযুদ্ধ এবং আমাদের রাজনীতিকরা

বলা হয়, রাজনীতিকরাই আমাদের অভিভাবক। কেননা, তারাই আমাদের দেখেশুনে রাখেন। অন্তত তারা এ রকমই বলেন। তাই বিপদাপদে, ভালো-মন্দে তারা আমাদের পাশে থাকবেন এটাই জনপ্রত্যাশা। আমাদের এ দেশটি সময়ে সময়ে নানা ধরনের সমস্যা-সংকটে পড়েছে। ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা-খরা, সাইক্লোন-টর্নেডোর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে এ দেশ। এসব সংকটে আমরা আমাদের রাজনীতিকদের কখনো পাশে পেয়েছি, কখনো সেভাবে পাইনি। যদিও রাজনীতিকরা সর্বদা ওয়াদা করে থাকেন, তারা সুখ-দুঃখে জনগণের পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মতোই থাকবেন। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় তাদের এ ধরনের আশ্বাসবাণী সাধারণ মানুষের কর্ণযুগলে মধুসম বর্ষিত হয়। তবে বাস্তবতা হলো, সেসব মধুর বাণী বাতাসে ভেসে বেড়ালেও জনগণের কাছে সোনার হরিণের মতো অধরাই থেকে যায়। নির্বাচন পেরিয়ে গেলে জনসাধারণ তাদের সেভাবে আর পায় না। এ না পাওয়ার বেদনা অন্তরে পুষেই এ দেশের ভাগ্যবিড়ম্বিত জনগণকে ভোট দিতে হয় সেসব নেতাকেই। অবশ্য গত দুটি সাধারণ নির্বাচনে জনগণ সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। ভবিষ্যতে কী হবে তা এখনই বলা মুশকিল।

এ মুহূর্তে বিশ্ব অতিক্রম করছে এক ভয়ঙ্কর দুঃসময়। বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশও করোনা নামের এক অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধরত। চোখে দেখা না যাওয়া সেই শত্রুর সঙ্গে শক্তিমত্তায় পেরে উঠছে না মানুষ। বড় বড় শক্তিধর রাষ্ট্র, যারা বর্তমান বিশ্বের মোড়ল হিসেবে পরিচিত, তারাও হিমশিম খাচ্ছে করোনা নামের অদৃশ্য শক্তিকে পরাস্ত করতে। তিলে তিলে গড়ে ওঠা এ মানবসভ্যতা একটি অতিক্ষুদ্র জীবাণুর কারণে বিপর্যস্ত হতে বসেছে। বৈশ্বিক এ দুর্যোগে কেউ কারও পাশে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে দাঁড়াতেও পারছে না। কারণ সবাই আজ আক্রান্ত। ‘ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি’ রব উঠেছে  বিশ্বজুড়ে। নিজের দেশকে বাঁচাতে ব্যস্ত সবাই।

যদিও এখন পর্যন্ত করোনা আমাদের তেমন কাবু করতে পারেনি। তবে সামনের দু-তিনটি সপ্তাহ আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। সঠিকভাবে প্রতিরোধ করা না গেলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে, এ আশঙ্কা সবাইকে চিন্তিত করে তুলেছে। করোনা শুধু স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেই ঝুঁকি সৃষ্টি করেনি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তার প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে দেশের সব অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বন্ধ রয়েছে গণপরিবহনও। ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক ভয়ানক পরিস্থিতির। নিম্ন আয়ের মানুষ, যারা দৈনিক শ্রমভিত্তিক জীবিকা নির্বাহ করে তারা পড়েছে সবচেয়ে সংকটে। অবশ্য সরকার চেষ্টা করছে জনগণকে এই দুঃসময়ে সাহায্য করতে। পোশাক-শ্রমিকদের বেতনের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ আর্থিক সহায়তা ছাড়াও উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ। সব মিলিয়ে এ সংকট থেকে বের হয়ে আসতে সরকার সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। তবে এসব উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করছে যাদের মাধ্যমে এগুলো বাস্তবায়ন হবে তাদের ওপর।

করোনার ধাক্কা মোকাবিলায় সরকারের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ দৃশ্যমান হলেও এই সময়ে আমাদের রাজনীতিকরা কী করছেন তা নিয়ে কথা উঠেছে। তারা কি কোথাও হারিয়ে গেলেন? অতীতে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তারা কি জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন? জনগণ কি তাদের পাশে পাচ্ছে? ভোটের সময় যেসব নেতাকে ঘর্মাক্ত কলেবরে মাঠেঘাটে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়, এখন তাদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না কেন? স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকবার তাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ বিপদের দিনে জনগণের পাশে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও আমরা তাদের তেমনভাবে দেখতে পাচ্ছি না। জনগণের ভোট নিয়ে যারা জনপ্রতিনিধির তকমা গায়ে লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করেন এখন তাদের কেন দেখা যাচ্ছে না? তারা কি সেলফ কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন? যদি তাই হয়, তাহলে আমরা আশা করব, রাজনীতির অঙ্গন থেকেও তারা কোয়ারেন্টাইনে চলে যাবেন দয়া করে। যাতে সত্যিকার মানবদরদি ব্যক্তিরা রাজনীতির মাঠে জায়গা পায়। প্রসঙ্গক্রমে এখানে একজন জনপ্রতিনিধির(!) দায়িত্বশীলতার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। রাজনীতিক পিতার সন্তান তিনি। পিতা ছিলেন দেশের বরেণ্য একজন রাজনীতিক। আরোহণ করেছিলেন রাষ্ট্রের সবচেয়ে শীর্ষ চেয়ারটিতেও। তার ইমেজ কাজে লাগিয়ে পুত্র মহাশয় রাজনীতির আসরে কলকে পেয়েছেন ভালোই। একাধিকবার সংসদ সদস্যও হয়েছেন। অবশ্য সেজন্য তাকে ছাতা বদল করতে হয়েছে বারদুয়েক। তো সেই এমপি মহোদয় করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে নিজের নির্বাচনী এলাকায় সভা করে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০০ শয্যার একটি অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করবেন। এজন্য তার পরিকল্পনার কথাও জানালেন। নির্বাচনী এলাকার বিত্তবানদের নিয়ে তিনি মিটিং করে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবেন। এলাকাবাসী অধীর আগ্রহে উন্মুখ হয়ে থাকল এমপি সাহেবের কর্মোদ্যোগের চাক্ষুষ সাক্ষী হতে। কিন্তু হা হতাস্মি! সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও তার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। কেউ জানে না তিনি কোথায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানা গেল, হাসপাতাল তৈরির ঘোষণা দেওয়ার দু-তিন দিন পরই তিনি হাওয়াই জাহাজে চড়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় অবস্থান নিয়েছেন। জনসেবা বা জনগণের পাশে থাকার কি অপূর্ব দৃষ্টান্ত! এলাকাবাসী এখন বলাবলি করছে, এমপি মহোদয়ের পরিকল্পনার ‘পরি’ তার হাওয়াই জাহাজের সঙ্গেই উড়ে গেছে। এখন পড়ে আছে শুধু ‘কল্পনা’। কেউ আবার একটু বেড়ে বলছেন, এমপি সাহেবের হাসপাতাল তৈরির ঘোষণা ‘পাতালে’ তলিয়ে গেছে, আর ‘হাঁস’ এখন আড়িয়ল বিলের পানিতে জলকেলি করছে। উল্লেখ্য, দুর্নীতি দমন কমিশন ওই এমপি সাহেবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ১৩২ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ তদন্ত করে দেখছে। না, আমি এটা বলছি না যে, সব এমপি বা জনপ্রতিনিধি ওই রকমের। কেউ কেউ ইতিমধ্যেই নেমে পড়েছেন ত্রাণকাজে। সংবাদমাধ্যমে তা খবরও হচ্ছে। আবার কাউকে দেখা যাচ্ছে যৎসামান্য ত্রাণ দিয়ে তার ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে নিজেকে ফেমাস করার চেষ্টা করতে। এ রকম আত্মপ্রচারের ক্ষেত্রে রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইরাদত আলী সৃষ্টি করেছেন অনন্য দৃষ্টান্ত। ৮ এপ্রিল একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বিরাট আকারে বিজ্ঞাপন দিয়ে দেশবাসীকে জানিয়েছেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি ১২ হাজার হতদরিদ্র মানুষকে সাহায্য দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় তার এ মানবসেবায় আত্মনিয়োগ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু সেই সেবার কথা এভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করা কেন? তিনি কি প্রচার পাওয়ার জন্যই ত্রাণ সাহায্য দিয়েছেন? এ ধরনের প্রচারে যে সেবার মাহাত্ম্য কমে যায় তা অনুধাবন করার ক্ষমতা বোধকরি তার নেই।

করোনা সংকটে রাজনীতিকরা কী করছেন এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সেদিন একজন বললেন, ‘আরে ভাই! তারা যে এখনো করোনা নিয়ে বাকযুদ্ধ শুরু করে দেননি, সেটাই তো ভাগ্যের ব্যাপার! এখনো যে আওয়ামী লীগ-বিএনপি করোনার দায় একে অন্যের কাঁধে চাপানোর লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়নি সেজন্য তাদের অন্তত একটা ধন্যবাদ দিন।’ এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, অতীতে নানা সংকটে রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দলের মধ্যে পরস্পরকে দায়ী করে বাক্যাক্রমণ শানানোর অনেক নজিরই আছে। সেসব দৃষ্টান্ত স্মরণে এনেই ভদ্রলোক উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন এটা বোঝা যায়। এটা ঠিক, করোনা আমদানির জন্য বিএনপি সরকার তথা আওয়ামী লীগকে কিংবা আওয়ামী লীগ বিএনপিকে দায়ী করে কোনো কথা এখন পর্যন্ত বলেনি। তবে এ সমস্যাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাদের পরস্পরের প্রতি বাক্যবাণ নিক্ষেপ কিন্তু বাকি থাকেনি। এখানে সেই বাগ্যুদ্ধের কিছু উদাহরণ তুলে ধরলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এ সংকট মোকাবিলায় বিরোধীদের কাজে লাগাতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।’ পরদিন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বললেন, ‘বিএনপির উদ্দেশ্য সরকারকে সাহায্য করা নয়, সরকারের ভুল ধরা।’ ওইদিনই সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দলের ত্রাণ উপকমিটির বৈঠকে বললেন, ‘শুধু করোনা নয়, বিভেদের ভাইরাসও জাতির জন্য মারাত্মক।’ আর বিভেদের জন্য অবধারিতভাবে তিনি দায়ী করলেন বিএনপিকেই।

এটাও ঠিক যে, সরকারের বাইরে রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিকদের জাতির এ দুর্দিনে তেমন একটা নড়াচড়া করতে দেখা যাচ্ছে না। বিরোধী দলগুলো বিবৃতি আর অনলাইন ব্রিফিংয়ে প্রস্তাব জানিয়েই তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করার ঢেঁকুর তুলছে, তার বেশি কিছু নয়। কেন? সারা দেশে তাদেরও তো কর্মীবাহিনী রয়েছে। তাদের নিয়ে তারা কেন ত্রাণকাজে নেমে পড়ছে না? সরকারের ডাকের আশায় কেন তারা বসে থাকবে? তারা তো মানুষের জন্যই রাজনীতি করে, নাকি? তাহলে সেই মানুষকে বাঁচানোর জন্য তারা এগিয়ে আসছে না কেন? তারা যদি মনে করে, যেহেতু তারা সরকারে নেই, তাই জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা নেই তাহলে ভুল হবে। কেননা, সমস্যা-সংকটে কে কোন দায়িত্ব পালন করল জনগণ তা মনে রাখে। সরকারের বিরোধিতা আর রাজনৈতিক বিবৃতির গন্ডিতে আবদ্ধ থেকে যে জনগণের রাজনৈতিক দলে পরিণত হওয়া যায় না, এটা তাদের বুঝতে হবে।

মহাবিপদের এই সময়ে মানুষ রাজনীতিকদের ইতিবাচক মনোভাব প্রত্যাশা করে। তারা চায় তাদের সেবকরা এই দুঃসময়ে সংকীর্ণতার বেড়াজাল ছিন্ন করে পরস্পর হাত ধরে যুদ্ধে শামিল হবেন, জাতিকে নেতৃত্ব দেবেন। কারণ মানুষের জন্যই রাজনীতি, রাজনীতির জন্য মানুষ নয়।  কিন্তু নির্মম সত্য হলো, আমাদের রাজনীতিকদের উপলব্ধিতে তা একেবারেই নেই। আর তাই জনসাধারণের সে প্রত্যাশার সূর্য কাক্সিক্ষত আলো কখনোই ছড়ায় না। বোধকরি রাজনৈতিক সংকীর্ণতা তাদের বোধবুদ্ধিকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, তারা বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছেন না।

                লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর