শুক্রবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

শুভ জন্মদিন তোয়াব খান

এম. নজরুল ইসলাম

শুভ জন্মদিন তোয়াব খান

সম্পাদকদের সম্পাদক তিনি। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ‘সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান’ বলতে যা বোঝায়, তার শেষ সলতে তিনি। সাংবাদিক হিসেবে সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য কর্মজীবন তাঁর। দেশের সংবাদপত্র জগতের প্রিয়মুখ। ২০১৬ সালে একুশে পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে তাঁকে। একই বছর ডিসেম্বরে বাংলা একাডেমি সম্মানিত ফেলো হিসেবে নির্বাচিত করেছে। অগ্রজপ্রতিম সাংবাদিক হিসেবে দেশের সব সংবাদকর্মীর মনে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনটিও তো জাতীয় প্রেস ক্লাবের এই আজীবন সদস্যের দখলে। এই নির্মোহ-নির্লোভ মানুষটির নাম তোয়াব খান। নামটি উচ্চারিত হওয়া মাত্র যে মানুষটির চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তাঁকে একবার দেখে ভিতরের মানুষটিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। আপাতগাম্ভীর্যের আড়ালে যে সংবেদনশীল মানুষটির বাস, তাঁকে আবিষ্কার করা সহজ নয়। এর জন্য সময় ও শ্রম দিতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তোয়াব খান নিজে কজনের কাছে উšে§াচিত করেছেন নিজেকে? গুরুগম্ভীর তোয়াব খানের আড়ালে যে স্নেহময় মানুষটি লুকিয়ে, তাঁকে কি তিনি প্রকাশ করেছেন সবার সামনে? তবে আপাতগম্ভীর এই মানুষটির সাহচর্য যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা জানেন, ওই গাম্ভীর্যের খোলস খসে পড়তে খুব বেশি সময় লাগে না। আর সে কারণেই বলা যেতে পারে একজন তোয়াব খানকে আবিষ্কারই করতে হয়। এই আবিষ্কারের আরেকটি গূঢ় কারণ হচ্ছে, তাঁর জীবন তো কোনো মামুলি জীবন নয়। চলমান এক ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনকালে শুরু যে পথের, তা আজও বহমান। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পট পরিবর্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে সঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এজন্যই তিনি সমসাময়িক। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে ‘তোয়াব খান’ নামটি উচ্চারিত হয় পরম শ্রদ্ধায়।

ইতিহাসের সাক্ষী তিনি। সেই কবে থেকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখছেন সময়ের বয়ে চলা ও পরিবর্তন। জম্ম ব্রিটিশ ভারতে। এরপর পাকিস্তানি শাসন পেরিয়ে আজকের বাংলাদেশ। সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেছেন। দেখেছেন একাত্তর। ধারণ করে চলেছেন একাত্তরের চেতনা। অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে, একজন বিপ্লবী কলম সৈনিক হিসেবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত হতো তাঁর ‘পিন্ডির প্রলাপ’। তাঁর জীবনকে কোনো মামুলি জীবন বলা চলে না। ইতিহাসের সাক্ষী হতে হতে তিনি আজ নিজেই তো এক ইতিহাস। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পট পরিবর্তন আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে নানা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এক মানুষ তিনি। তাঁর জীবন খাতার পাতাগুলোও তো কম বর্ণিল নয়। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে তিনি এক উজ্জ্বল তারকা। সাংবাদিকদের সাংবাদিক তিনি- এতে কোনো সন্দেহ নেই। পেশাগত জীবনে ছয় দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসে আজ তিনি নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। সব সময়ে সমসময়ের প্রতিনিধি। তাই যথার্থ আধুনিক। সেই আধুনিকতার প্রতিফলন তাঁর পেশা ও ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি পরতে। একালের গায়ক নচিকেতার গানে আছে, ‘অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন/শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন’। সাড়ে আট দশক পেরিয়ে আসা মুখর জীবনে মিডিয়ার মহিরুহপ্রতিম এই মানুষটির পথচলাও যেন অন্তবিহীন। ব্যক্তিজীবনে যেমন স্মার্ট আর স্টাইলিশ তিনি; তাঁর লেখনীও তেমন নির্মেদ আর তীক্ষè। যদিও পাঠক হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, তিনি লিখেছেন কম, লিখিয়েছেনই বেশি। তিনি এক অসাধারণ গল্পকথক। অনুপুঙ্খ বলে যান আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে। দীর্ঘ সময়ের প্রতিটি ঘটনা তাঁর নখদর্পণে। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগই নেই। তাঁর চেতনায় একাত্তর, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। সাংবাদিক হিসেবে তিনি পরিবর্তনগুলো যেমন দেখেছেন, তেমনি সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবেও দেখেছেন খুব কাছ থেকে। খুব কাছে থেকে স্বাধীনতার মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছেন। ১৯৭৩-৭৫-এ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুই বেছে নিয়েছিলেন তাঁকে। ছিলেন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রেস সচিব। ১৯৮০-৮৭-তে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা। পালন করেছেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্বও। জš§ ও বেড়ে ওঠা তাঁর সাতক্ষীরার রসুলপুরে। পড়েছেন সাতক্ষীরার সার্ধশত বছরের বেশি পুরনো পিএন (প্রাণনাথ) স্কুলে। স্কুলের পাট চুকিয়ে ঢাকায় কলেজে পড়তে আসা। বছর না ঘুরতেই ভাষা আন্দোলনে উত্তাল দেশ। ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় হলেন। এর পর থেকেই ভিতরে ভিতরে একটা পরিবর্তনের হাওয়া। অজান্তে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দীক্ষা। বদলে যায় জীবনের গতিপথও। ক্রমেই শিকেয় উঠছে পড়াশোনা। পেয়ে বসে বিপ্লবের নেশা। ১৯৫৩ সালে কে জি মুস্তফার সঙ্গে বের করেন সাপ্তাহিক ‘জনতা’। এর মধ্য দিয়েই হাতেখড়িও হয়ে যায় তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন সংবাদে। ’৬১ সালে সংবাদের বার্তা সম্পাদক। ’৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে বার্তা সম্পাদক হিসেবেই। ’৭২ সালে দৈনিক বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ‘সত্যবাক’ নামে দৈনিক বাংলায় শুরু করেন ‘সত্যমিথ্যা, মিথ্যাসত্য’ শিরোনামে বিশেষ কলাম। এ কলামে উঠে আসে একটি স্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক চিত্র। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে একেকটি মাইলফলক রচিত হয়েছে তাঁরই নেতৃত্বে। প্রথম চাররঙা সংবাদপত্র এর মধ্যে একটি। ‘সবসময়েই পাঠকরাই আমার প্রাইমারি কনসার্ন’, এ কথা সব সময় বলেন তিনি। তাঁর একমাত্র বই ‘আজ এবং ফিরে দেখা কাল’। অগ্রসর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সাংবাদিকতাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন তিনি। সাংবাদিকতা এক সৃজনশীল পেশা। সেই সৃজনযজ্ঞে ব্রতচারীর ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। বহুদর্শী মানুষটি নামের পেছনে ছোটেননি কখনো। অদ্ভুত আড়ালচারিতা তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে লড়াই এখনো চলছে, সে লড়াইয়ে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তোয়াব খান।  আজ তাঁর জম্মদিন। শুভ জš§দিন তোয়াব ভাই। আপনার স্নেহচ্ছায়ায় আরও অনেকটা পথ হাঁটতে চাই আমরা।

লেখক : সর্বইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়াপ্রবাসী মানবাধিকারকর্মী, লেখক ও সাংবাদিক।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর