শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাকালে সিয়াম সাধনা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

করোনাকালে সিয়াম সাধনা

আত্মশুদ্ধি আর আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অসীম রহমত ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে হিজরি ১৪৪১ সনের নবম মাস রমজান আমাদের মাঝে সমুপস্থিত। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব যখন করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবিলায় প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় তখন একটি অভাবিত ও অনির্বচনীয় পরিবেশে রমজানের শুভ সূচনায় সবাইকে আন্তরিক অভিবাদন।

মাহে রমজানে রোজা পালন বা সিয়াম সাধনাকে শারীরিক সুস্থতা অর্জনের মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ ও আত্মোপলব্ধি অর্জনের জন্য ফরজ বা অবশ্যপালনীয় বিধান ইসলামের। আত্মশুদ্ধি ও বিধাতার নৈকট্য লাভের জন্য কৃচ্ছ্রসাধন ইবাদত হিসেবে শুধু ইসলামে পরিপালনীয় নয়, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মিক নির্বাণ লাভের এ সাধনা বিদ্যমান। করোনাক্লিষ্ট সময় ও সমাজে এবারের সিয়াম সাধনা মূলত শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক নিরাময়-শান্তি সন্ধান ও আত্মশুদ্ধির উপায় ও উপলক্ষ হিসেবে প্রতিপালিত হওয়ার তাৎপর্য বহন করে।

ইসলামের পাঁচ প্রধান পালনীয় বিধানের মধ্যে মাহে রমজানে রোজা পালন অন্যতম। কেননা মাহে রমজানেই ‘ফুরকান’ (ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য নির্দেশকারী) হিসেবে আল কোরআন অবতীর্ণ হয়। কাজেই ‘তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে যেন অবশ্যই এ মাসের রোজা পালন করে।’ তবে মাহে রমজানে রোজা পালনের আবশ্যিক এ বিধান এ মাসে ‘অসুস্থ’ আর ‘মুসাফির’দের জন্য শিথিল করে দিয়ে বলা হয়েছে, অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটিও ‘যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হবে, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করবে।’ আল্লাহ রব্বুল আলামিন সিয়াম সাধনার এ সুযোগকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য ‘সহজ করতে চান’। তিনি কোনো জটিলতা কামনা করেন না। কেননা, এ রোজা পালনের মধ্যে রয়েছে ‘অধিকতর কল্যাণ’। সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৪। আত্মিক, শারীরিক, মানসিক, সর্বোপরি সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিতকারী এমন কল্যাণপ্রদ পরিপালনীয় বিষয় আর নেই। সাহরি, ইফতার এবং তারাবি রোজার তিন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহরি খাওয়াকে মুস্তাহাব বা খুবই পছন্দনীয় কাজ বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাও। সাহরি খাওয়ায় নিশ্চয়ই বরকত রয়েছে।’ তিনি বলেছেন, ‘যে লোক রোজা রাখতে চায়, তার কিছু খেয়ে সাহরি পালন করা কর্তব্য।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘মুসলমানদের ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের রোজা রাখার একটি পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া। অর্থাৎ মুসলমানরা সাহরি খেয়ে রোজা রাখে আর অমুসলমানরা সাহরি না খেয়ে রোজা থাকে।’ রসুলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তার গুনা মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে। ওই রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে। তবে ওই রোজাদারের সওয়াবে কোনো কম করা হবে না।’ করোনা মোকাবিলায় মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যে অচলায়তন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে সমাজের অধিকাংশ মানুষের রোজার শেষে ইফতারি ও সাহরি সম্পাদনের সামর্থ্যে টান পড়বে। সামর্থ্যরে শামিয়ানার নিচে আনতে হলে সবাইকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। সচরাচর ইফতারি আয়োজনে অতিশয় অপব্যয়ের যে বহর দেখা যায় তাতে রাশ টেনে ধরতে পারলে এটা সম্ভব। গত কয়েক বছর রাতের শেষ প্রহরে ঘটা করে বড় হোটেল-রেস্তোরাঁয় সাহরি খাওয়ার অপব্যয়জনিত মহোৎসব এবার বন্ধ হওয়ার সুযোগ স্বয়ং করোনাই এনে দিয়েছে। এটা অস্বীকার করা চলে না, যে কোনো ব্যাপারে মাত্রাতিক্রমণের বা সীমালঙ্ঘনের প্রতিকার প্রতিবিধানেই করোনার মতো মহামারীর প্রাদুর্ভাব।

করোনা মোকাবিলায় সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণের যে আহ্বান ইথারে অবিরত উচ্চারিত-উৎসারিত হচ্ছে তাতে আশা করা যায়, রোজাদারের জীবনযাপনপ্রণালি শৃঙ্খলাম-িত হয়ে উঠবে। রমজানের রাতে ইমান ও সতর্কতাসহকারে যে বিশেষ নামাজ আদায় করা হয় তা তারাবির নামাজ। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারাবি নামাজ পড়েছেন কিন্তু তা রীতিমতো প্রতি রাতে পড়েননি। তারাবি নামাজ জামাতে পড়া প্রসঙ্গে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। তারাবি নামাজ সিয়াম সাধনার একটি অন্যতম অঙ্গ। আরাম ও আয়েশ প্রবণতাকে সংযত করতে তারাবি একটি ট্রেনিংবিশেষ যার মুখ্য উদ্দেশ্য রোজাদারের জীবনযাপনকে শৃঙ্খলাম-িত করে তোলা। জীবনে সংগ্রাম ও কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প নেই। সারা দিন রোজা রাখার পর রাতে বিশ্রাম গ্রহণের অনিবার্য আকাক্সক্ষাকে অবদমিত করে তারাবি নামাজ পাঠ করা হয়- কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের এটি একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রক্রিয়াও বটে। বিশ্রাম ও আরাম-আয়েশ প্রবণতাকে সচেতনভাবে হ্রাস করার মাধ্যমে একজন রোজাদার মুসলমান ব্যক্তিগত জীবনে কঠোর পরিশ্রমের দীক্ষা লাভ করতে পারে। করোনাকালে যুক্তিযুক্ত কারণেই অর্থাৎ ‘সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টির অনিবার্যতা’ সামনে রেখেই দলগতভাবে নয়, বাসায় তারাবি নামাজ আদায়ের আহ্বান জানানো হয়েছে।

করোনা মোকাবিলায় গোটা বিশ্বের মানুষ আজ স্বাস্থ্য সুরক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত। অসুস্থ ও সফররত ব্যক্তিদের রোজা পালন প্রসঙ্গে আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘(রোজা ফরজ করা হয়েছে) হাতে গোনা কয়েক দিনের জন্য। (তার পরও তোমাদের) কেউ যদি অসুস্থ হয়ে যায় কিংবা কেউ যদি সফরে থাকে, সে ব্যক্তি সমপরিমাণ দিনের রোজা (সুস্থ হয়ে গেলে অথবা সফর থেকে ফিরে এলে) পরে আদায় করে নেবে। এর পরও যাদের জন্য রোজা রাখা একান্ত কষ্টকর বলে মনে হবে তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করবে। যে ব্যক্তি খুশির সঙ্গে সৎকর্ম করে; যদি রোজা রাখ তবে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার।’ সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৪। তার জন্য তা কল্যাণকর হয়। আর অসুস্থতার কারণে কিংবা ভ্রমণরত অবস্থায় রোজা পালন করা কষ্টদায়ক হলে সে ক্ষেত্রে অন্য সময়ে অনুরূপ সংখ্যক (অর্থাৎ যে কটি রোজা পালন করা সম্ভব হয়নি) রোজা অবশ্যই পালন করার কথা বলা হয়েছে। সে রোজা পালনও সম্ভব না হলে ফিদায়া হিসেবে গরিব মিসকিনকে খাদ্যদানের মাধ্যমে তা পূরণের সুযোগ রয়েছে। রোজার ব্যাপারে ইসলামের প্রধানতম সংস্কার হলো এর বাস্তবিকতা এবং ধারণাগত পরিবর্তন। বস্তুত রোজা পালনের মাধ্যমে রোজাদার যাতে সজীবতা, হৃদয়ের পবিত্রতা ও চিন্তা ধারার বিশুদ্ধতা অর্জনসহ রুহানি তৃপ্তি, নতুন উদ্যম ও প্রেরণা লাভ করে সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। যে কোনো বিশেষ রোগব্যাধির উল্লেখ করে অসুস্থ ব্যক্তির রোজা কাজা করার নির্দেশের পরিধিকে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়নি। যে কোনো রোগ যাতে রোজা রাখা তার জন্য দুরূহ হয়ে যায় সে ক্ষেত্রের জন্য এ অনুমতি।

সিয়াম সাধনায় আত্মশুদ্ধির চেতনা জাগ্রত হয়। কর্মফলের দ্বারা আল্লাহ-প্রদত্ত নিয়ামতের স্থায়িত্বের হ্রাস-বৃদ্ধি প্রসঙ্গে আল কোরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণা অনুধাবন ও উপলব্ধির মধ্যে আত্মশুদ্ধির চিন্তা-চেতনা পরিশীলিত হতে পারে। সূরা আনফালের ৫৩ নম্বর আয়াতে ঘোষিত হচ্ছে, ‘যদি কোনো সম্প্রদায় নিজের অবস্থার পরিবর্তন না করে, তবে আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তাদের যে সম্পদ দান করেন তিনি তা পরিবর্তন করবেন; এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ সূরা আর রাদের ১১ নম্বর আয়াতে আরও স্পষ্টভাবে ইরশাদ হচ্ছে, আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে। কোনো সম্প্রদায়ের সম্পর্কে যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন তবে তা রদ করবার কেউ নেই এবং তিনি ছাড়া তাদের কোনো অভিভাবক নেই।’

আল্লাহর নিয়ামত স্থায়িত্বের যে নিয়ম বা মূলনীতি তা হলো কোনো ব্যক্তি বা জাতিকে যে নিয়ামত দান করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা ফিরিয়ে নেওয়া হয় না, যে পর্যন্ত না নিজের বা নিজেদের অবস্থা ও কার্যকলাপকে পরিবর্তিত করে আল্লাহর আজাবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এখানে অবস্থা পরিবর্তনের অর্থ হলো ভালো ও সৎ অবস্থা বা কর্মের পরিবর্তে মন্দ অবস্থা ও কার্যকলাপ অবলম্বন করা কিংবা আল্লাহর নিয়ামত আগমনের সময় যেসব মন্দ ও পাপ কাজে লিপ্ত ছিল নিয়ামতপ্রাপ্তির পর তার অধিক মন্দ কাজে লিপ্ত হওয়া। নিয়ামত -প্রাপ্তির পর তার জন্য শুকরিয়া আদায় করা, সচেতন দায়িত্ব পালনের দ্বারা এর মর্যাদা রক্ষা করা এবং নিজেদের মধ্যে সংশোধনীয় বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়।

কোনো কোনো সময় আল্লাহ তার নিয়ামত এমন কোনো কোনো লোক বা সম্প্রদায়কে দান করেন, যে তার নিজের বা নিজেদের আমল বা কর্মের দ্বারা তার যোগ্য নয়, কিন্তু প্রদত্ত হওয়ার পর যদি সে নিজের আমল বা কর্মধারা সংশোধন করে কল্যাণের দিকে ফেরানোর পরিবর্তে মন্দ কাজের দিকে আরও বেশি উৎসাহী হয়ে পড়ে, তখন প্রদত্ত নিয়ামত তার বা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

আল্লাহ মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি ও ভালো-মন্দ জ্ঞানসহ সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের হেফাজতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতারা পাহারায় নিযুক্ত থাকে। তাঁর প্রিয় বান্দা বিপথগামী হয়ে তাঁর অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত হোক এটা তিনি চান না, তদসত্ত্বেও কেউ সঠিক ও কল্যাণের পরিবর্তে মন্দ ও অভিশপ্ত পথ নির্বাচন এবং তথায় অনড় অবস্থান করলে আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও তাঁর আনুগত্য ত্যাগ করে কুকর্ম, কুচরিত্র ও অবাধ্যতার পথ বেছে নিলে তার পরিণতি হয় দুঃখজনক। যে গজব নেমে আসে তা থেকে আত্মরক্ষার কোনো উপায় থাকে না। কোনো ব্যক্তি বা জাতির জীবনে কল্যাণকর পরিবর্তন ততক্ষণ পর্যন্ত সূচিত হয় না, যতক্ষণ এই কল্যাণকর পরিবর্তনের জন্য নিজেদের অবস্থা সংশোধন করে নিজেদের তার যোগ্য করে না তোলা হয়। এবারের সিয়াম সাধনায় সবার মধ্যে এ উপলব্ধি জাগ্রত হোক।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর