শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

দুর্যোগে সবাই কৃষকের পাশে দাঁড়াই

শাইখ সিরাজ

দুর্যোগে সবাই কৃষকের পাশে দাঁড়াই

সবাইকে মাহে রমজানের শুভেচ্ছা। এ মুহূর্তে সারা পৃথিবীর ৭৫০ কোটি মানুষ সংকটে রয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীতে মানবিক বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে পৃথিবী। করোনাভাইরাস আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা, গবেষণা সবকিছুকে ব্যর্থ করে দিয়ে মানবকুলের বিপদের দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করছে। আজকের এই বিপর্যয়কালে আল কোরআনের কয়েকটি আয়াতের কথা আমার স্মরণ হচ্ছে। সূরা আহজাবের ৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলছেন, ‘...আর তারপর আমি তোমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে পাঠিয়েছিলাম এক ঝঞ্ঝাবায়ু এবং এক বাহিনী। এমন এক বাহিনী যা তোমরা চোখে দেখতে পাওনি।’

সূরা আনয়ামের ৪২ নম্বর আয়াতে আছে, ‘তারপর আমি তাদের ওপর রোগব্যাধি, অভাব, দারিদ্র্য, ক্ষুধা চাপিয়ে দিয়েছিলাম, যেন তারা আমার কাছে নম্রতাসহ নতিস্বীকার করে।’

সূরা বাকারার ২৬ নম্বর আয়াতে আছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মশা কিংবা এর চাইতেও তুচ্ছ বিষয় দিয়ে উদাহরণ বা তাঁর নিদর্শন প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করেন না।’

মহান আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। আমাদের মাফ করুন। পৃথিবীর মুসলিম সম্প্রদায় প্রবেশ করেছে মাহে রমজানের রহমতের দিনগুলোয়। মহান সৃষ্টিকর্তার অসীম রহমতে এ বিপদ থেকে মানুষ যেন রেহাই পায়।

যা হোক, দিন দিন করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। পরিস্থিতি যে কোনো দিকে আমাদের নিয়ে যাবে, তা অনুমান করা কঠিন হয়ে পড়ছে। কভিড-১৯-এর অভিঘাত কত বেশি বিস্তৃত হতে পারে সে সম্পর্কেও ধারণা করে ওঠার মতো কোনো গবেষণা বা রিপোর্ট আমার চোখে পড়েনি। এদিকে সারা বিশ্বে মহামারী আকারে বিস্তার লাভ করা করোনাভাইরাসের প্রভাবে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে হুঁশিয়ার করছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। সংস্থাটি বলছে, উন্নয়নশীল ৩০টি দেশে এ দুর্ভিক্ষ সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। সংস্থাটির প্রধান ডেভিড বিসলির বরাত দিয়ে দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, এ মহামারীর কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিতে পারে। প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষপীড়িত হতে পারে, যা হবে বর্তমানের দ্বিগুণ। বিশ্বের প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি মানুষ এখনো ক্ষুধাপীড়িত। চলতি বছর নতুন করে ১৩ কোটি মানুষ তীব্র ক্ষুধার্তের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশে দেশে চলছে লকডাউন। খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। গোটা বিশ্বই মুখোমুখি হতে যাচ্ছে খাদ্য সংকটের দিকে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোয় নানামুখী বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো খাদ্যের ব্যাপারে সিংহভাগ আমদানিনির্ভর। আজকের বাস্তবতায় তাদের অবস্থাও করুণ।

আজ আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক সমীক্ষার দিকে তাকানোর সময় নয়। আমাদের সম্ভাব্য বিপর্যয় ও খাদ্যাভাব থেকে বাঁচতে কৃষির দিকেই সবচেয়ে মনোযোগ দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। সরকারিভাবে যে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে, তা আজকের প্রয়োজন মেটানোর জন্য কতটুকু কাজে আসবে তাও গভীরভাবে ভাবতে হবে। যারা সহায়তা পাবেন, তারা কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় তা গ্রহণ করবেন, তাও দেখার বিষয়। আমাদের সিংহভাগ কৃষক বর্গচাষি। এই সময়ে তারা কীভাবে এ প্রণোদনা সহায়তার আওতায় আসতে পারেন, তা ভাবা সবচেয়ে জরুরি।

মনে রাখতে হবে, লোকসান ও ক্ষতির শিকার হয়ে কৃষক যদি কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে আর তাকে মাঠে ফেরানো যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর শেষে শিল্প খাতে মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ২৬ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৫৪ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। দেশের সব খাতে যখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে তখন কৃষি খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমছে। গত অর্থবছর শেষে কৃষি খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা, আগের অর্থবছরে যা ছিল ৫ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ১ হাজার কোটি টাকা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা যায়।

বাস্তব চিত্র হচ্ছে অন্য সব খাতের বিবেচনায় কৃষি আরও বেশি গুরুত্ব দাবি করে। কৃষি আরও বেশি বিনিয়োগ দাবি করে। আজ সারা পৃথিবীর এক কঠিন সময়ে কৃষিই আমাদের সামনে এক ভরসার জায়গা। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে যতটা সম্ভব কৃষির দিকে মনোযোগী হওয়ার আর বিকল্প নেই। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার কৃষিতে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। বলা হচ্ছে, তরুণ প্রজন্মকে কৃষিতে আত্মনিয়োগ করতে। আমি মনে করি এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসে গেছে তরুণ প্রজন্ম কীভাবে কৃষিতে নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে পারে, সে বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়ার। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উচিত শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের কৃষিমুখী প্রকল্পে বিনিয়োগ করা। তাদের নানাভাবে প্রণোদনা দিয়ে কৃষিতে ধরে রাখা। তাহলেই তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভাবতে পারবে।

গত চার দশক কৃষকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বারবারই মনে হয়েছে যত দিন সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ কৃষিমুখী না হচ্ছে তত দিন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার শক্ত একটি জায়গা তৈরি হবে না। আজ এ বিপর্যয়ের দিনে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকেই ডাকা হচ্ছে কৃষির দিকে। আমি ১১ বছর আগে তরুণ শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানিয়েছিলাম ‘ফিরে চল মাটির টানে’। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীকে মাঠে নিয়ে গিয়েছি। তারা ফসল উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে কাজ করেছে। চারা রোপণ থেকে সব কাজই তাদের করতে বাধ্য করেছি। এ কাজগুলোর উদ্দেশ্যই ছিল আমাদের শিক্ষিত প্রজন্ম জানুক কৃষিই আমাদের মুক্তির জায়গা। কৃষিই আমাদের টিকে থাকার জায়গা।

যখন হাওরাঞ্চলসহ সারা দেশেই করোনা পরিস্থিতিতে শ্রমিক সংকট দূর করতে কৃষকের পাশে আমাদের শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ছুটে যাচ্ছেন, তা যেন ফিরে চল মাটির টানের সেই উদ্দীপনার কথাই নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। সত্যিই এটি বড় এক জাগরণ। দেশের বিভিন্ন জেলার চিত্র আমরা দেখছি। হাওরাঞ্চলে কৃষকের সঙ্গে ধান কাটতে হাতে কাঁচি তুলে নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এ বড় আশার চিত্র।

এদিকে সরকারি নির্দেশ মেনে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর বাসভর্তি শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে দেশের হাওরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায়। এর পাশাপাশি আবার এ চিত্রও আছে, শ্রমিকের অভাবে দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষক খেতের ধান কাটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে।

আমাদের দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, বিশেষ করে যারা অর্থশালী, যাদের নিজেদের শহরে বাসভবন রয়েছে, এমন মানুষ ছাদকৃষির মাধ্যমেই আমাদের অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী করেন। অধিকাংশ ছাদকৃষক বহুদিন ধরেই নিজেদের পুষ্টি চাহিদা নিজেরাই পূরণ করেন। এটি যে কত দরকারি, আজকের দিনে তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হচ্ছে। বলা বাহুল্য, সারা পৃথিবীতেই এ করোনা পরিস্থিতিতে কৃষি-অনুরাগীরা বাসভবনের ভিতরেই কীভাবে কৃষিকাজ করা যায়, সে চেষ্টা করে চলেছেন। ঘরের ভিতর আটকে থেকে তরতাজা সবজি ফসল করে নিজেদের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অন্যদের কাছে পৌঁছেও দিচ্ছেন নানাভাবে। এদিকে পৃথিবীব্যাপী কৃষি ও খামার পর্যায়ে লোকসানের হিসাব বেড়েই চলেছে। এতে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়তে যাচ্ছে আমদানিনির্ভর দেশগুলোকে। আর যারা উৎপাদক তারাও বিশ্ববাজারের চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে।

রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল বিশ্ববাজারে ২০২৪-এর মধ্যে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের পোলট্রি রপ্তানি। সে লক্ষ্য ভেস্তে যেতে বসেছে। ব্রাজিলে ভোক্তা পর্যায়ে মুরগির মাংস ও ডিমের দাম বেড়ে গেলেও করোনা পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে রপ্তানি বাণিজ্যে। বহু কর্মী বেকার হয়ে পেড়েছেন। এমন প্রভাব মেক্সিকো, ইউক্রেন, চীন সবখানে। স্থানীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণের প্রশ্নেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। রপ্তানি বাণিজ্যে তো বড় প্রভাব রয়েছেই। কর্মী সংকটে ভয়ানক বিপর্যয়ে পড়েছে ফ্রান্সের কৃষি। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে সরবরাহ অবকাঠামোর ওপর। অভিবাসী শ্রমিক আসতে বাধা না থাকলেও এ পরিস্থিতিতে পোল্যান্ড থেকে শ্রমিক আসছে না। তা ছাড়া বাজারে সবজি ফসলের মূল্যও কমে গেছে। সব মিলিয়ে এক করুণ পরিস্থিতি। নিজেরা ফসল তুললেও বাজার পরিস্থিতি অনুকূল না থাকায় অনেক ফসল নষ্টও হচ্ছে।

রমজানে আমাদের দেশের বাজারে এক ধরনের পরিবর্তন আসে। সবজির প্রাচুর্য থাকে বেশি। বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা ও দাম বেড়ে যায়। এবার করোনা মহামারীর ভিতর বাজার চিত্র ভিন্ন। গ্রামীণ বাজার পর্যায়ে এখনো পাইকার যেতে পারছে না তেমন একটা। গেলেও বাজারমূল্য কমিয়ে দিয়েছেন তারা। মানুষের নিত্য চাহিদায়ও এক ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। তবে বাজারে সামাজিক দূরত্ব মানছেন না ক্রেতা ও ভোক্তারা। এটি ভয়ের কারণ। এদিকে প্রশাসন বা স্থানীয় সরকারের নজর দিতে হবে।

করোনা মহামারী গোটা পৃথিবীর জীবনযাত্রায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। অধিকাংশ মানুষ ঘরে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। এর মধ্যেও মানুষের জীবন থেমে নেই। মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য নিয়ম করে খেতে হচ্ছে, নিত্যকার কাজকর্মও করতে হচ্ছে। এই সময়ে বিশ্ব মুসলিমের মাঝে এসেছে রমজান মাস। কোরআন নাজিলের পবিত্র মাস। গুনা মাফ হওয়ার মাস। যতটা সম্ভব সাবধানতা ও সচেতনতা অনুসরণ করে আমাদের সুস্থ থাকতে হবে। প্রার্থনা করতে হবে। যারা আক্রান্ত হয়েছেন, অস্থির না হয়ে ভেঙে না পড়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। কঠিনভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নিজেকে সুস্থ করে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। নিজেকে সুস্থ রাখাই এই সময়ে অন্যদের নিরাপদ রাখার মূলমন্ত্র। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর