শুক্রবার, ১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

পয়লা মে, করোনা ও আখিরাতের জীবন

সুমন পালিত

পয়লা মে, করোনা ও আখিরাতের জীবন

পয়লা মে শ্রমিকরা বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল অসীম সাহসিকতায়। ১৮৮৬ সালের পয়লা মে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামে আমেরিকার শিকাগোর হে মার্কেটের শ্রমিকরা। মালিকদের হয়ে পুলিশ গুলি চালায় শ্রমিকদের ওপর। রাস্তায় পড়ে থাকে বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের লাশ। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয় মাত্র চারজন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে। আহতের সংখ্যা ৬০। এ হত্যাকান্ডের পর উল্টো শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় সাত শ্রমিককে। আরেকজনের ১৫ বছরের কারাদ-। পরে দুজনকে মৃত্যুদন্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। বহাল থাকে পাঁচজনের মৃত্যুদন্ড। এর মধ্যে লিঞ্জ নামের এক শ্রমিক কারাগারে বোমা বিস্ফোরণে আত্মহত্যা করেন। অন্য চারজন শ্রমিক অধিকারের গান গেয়ে ওঠেন ফাঁসির মঞ্চে।

শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের স্মৃতিম-িত পয়লা মে প্রথমবারের মতো সারা দুনিয়ায় পালিত হচ্ছে নীরবে। কারণ করোনাকালে হাজির হয়েছে এ দিনটি। সবার জানা, করোনাভাইরাস যেন এক মৃত্যুদূতের নাম। মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইল কিংবা মৃত্যুদূত যমের চেয়েও সে সাক্ষাৎ আতঙ্ক দুনিয়াজুড়ে। মানুষ যখন মরণকে জয় করার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল, সে স্বপ্নসাধে ছন্দপতন ঘটিয়েছে করোনার আবির্ভাব। এত সাহসী মানুষও দুনিয়াজুড়ে ঘরবন্দী হয়ে পড়েছে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের ভয়ে। কখন যে কার মৃত্যু হবে সে আতঙ্কে ভুগছে সবাই। সব মানুষের কামনা এই সুন্দর পৃথিবীতে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকা। অনন্তকাল বাঁচার বাসনাও  পোষণ করেন কেউ কেউ। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। মরিতে চাহি না এ সুন্দর ভুবনে- ইচ্ছা পোষণ করা সহজ হলেও মরণকে এড়ানো সম্ভব নয়। বিজ্ঞান অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করলেও মৃত্যুকে জয় করার মতো কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। তাই বলে বিজ্ঞানীরা যে সে চেষ্টা বিসর্জন দিয়েছেন তাও নয়। মধ্যযুগের খ্রিস্টধর্মের মূল কথা ছিল- ‘মরিয়া অমর হও’। পুরোহিতদের বিশ্বাস ছিল, দেহের বিনাশ সাধন করে আত্মময় জীবনযাপনই মানুষের কর্তব্য হওয়া উচিত। তাদের বিশ্বাস ছিল, দেহ ও আত্মা পরস্পরবিরোধী। কাজেই দেহের ধ্বংস সাধন করেই আত্মাকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। প্রবৃত্তির কবলমুক্ত জীবনকেই তারা কাক্সিক্ষত বলে মনে করতেন। ইসলামের সুফিবাদীরা ইহকালকে দুই দিনের মুসাফিরখানা হিসেবে ভাবেন। তাদের মতে পরকালই হলো আসল জীবন। যে জীবনে রয়েছে অমরতা। ইহকালে পুণ্যের কাজ করলে পরজীবনে স্বর্গ বা জান্নাতে ঠাঁই পাওয়া যায়। অর্জন করা যায় অমরতা। পাপীদের জীবনও অমরতায় ভরা। তবে তা যেমন ভীতিকর তেমন গ্লানিময়; যা কারও কাম্য হতে পারে না।

মানুষ মাত্রই মরণশীল- এ ধারণা এখনো সুপ্রতিষ্ঠিত। মানুষ দৈহিক মৃত্যুকে মেনে নিলেও সেটি নাকি শেষ কথা নয়। পৃথিবীর সব ধর্মে আত্মার অমরতার কথা বলা হয়েছে। মরণশীল মানুষের জন্য এ এক সান্ত্বনা। বলা হয়, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জড়দেহের পতন ঘটে। আত্মা দেহত্যাগ করলে আসে মৃত্যু। বিশ্বের অন্যতম তিনটি প্রধান ধর্মমত মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিরা মৃত ব্যক্তির সৎকারে কবর দেওয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করে। বলা হয়, কবর দেওয়ার পদ্ধতি মানুষ শিখেছে কাকের কাছ থেকে। এ তিনটি ধর্ম অনুসারে দুনিয়ার প্রথম মানব-মানবী আদম-হাওয়ার দুই পুত্র ছিলেন হাবিল ও কাবিল। প্রেমঘটিত ঈর্ষার কারণে কাবিল হত্যা করেন হাবিলকে। ভাইয়ের মৃতদেহ নিয়ে তিনি মহাসমস্যায় পড়েন। এমন সময় দুটি কাকের মধ্যে ঝগড়া বাধে। সংঘর্ষে মারা যায় একটি। জীবিত কাকটি ঠোঁট দিয়ে মাটি খুঁড়ে তার সাথীকে মাটিচাপা দেয়। কাবিলও অনুসরণ করেন একই পদ্ধতি। মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদিরা মৃত ব্যক্তিকে কবর দেয় বিশেষ সম্মানের সঙ্গে। মৃত ব্যক্তিকে সসম্মানে কবর দেওয়ার পদ্ধতি চালু ছিল প্রাচীন মিসরেও। ফেরাউন বা রাজ পরিবারের সদস্যদের কবর দেওয়ার পদ্ধতি ছিল অন্য রকম। মিসরের শাসক পরিবার ফেরাউন বা ফারাওরা নিজেদের দেবতা বলে দাবি করতেন। মিসরীয়দের বিশ্বাস ছিল, দেবতারা অবিনশ্বর। মৃত্যুর দ্বারা লোকান্তরিত হলেও তা শুধু এ জগৎ থেকে পরজগতে যাওয়া। পরজগতে ফারাওদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নিশ্চিত করতে তাদের লাশ দাফনকে কেন্দ্র করে চলত হরেক আনুষ্ঠানিকতা। লাশে যাতে পচন না ধরে সেজন্য রাসায়নিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে মমি করা হতো। যে মমি রাখা হতো পিরামিডের ভিতর।

পিরামিড তৈরি হতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। মিসরীয়রা তাদের রাজা বা রাজ পরিবারের সদস্যদের লাশ শুধু মমি করে তাদের দেহকে অমরত্ব দান করত তা নয়, পরজীবনে তাদের সেবার জন্য শত শত দাস-দাসীকে হত্যা করে একসঙ্গে কবর দিত। জৈবিক প্রয়োজন মেটাতে দেওয়া হতো সুন্দরী নারী। হতভাগীদের হত্যা করে তাদের লাশ দাফন করা হতো। কবরে দেওয়া হতো খাদ্যদ্রব্য, কাপড়-চোপড়, মণি-মুক্তা, ধন-সম্পদ। এমনকি অস্ত্রশস্ত্র। ১৯৯৭ সালে চীনে আবিষ্কৃত একটি প্রাচীন কবরস্থান প্রমাণ করেছে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে তৎকালীন মিসরীয়দের বিশ্বাসের সঙ্গে চীনাদের ধ্যান-ধারণার মিল ছিল। মিসরীয়দের মতো চীনারাও বিশ্বাস করত কবর দেওয়ার পর দেহ ছেড়ে যাওয়া আত্মারা যদি ফিরে আসে, তখন জীবিত লোকদের মতো মরদেহেরও ভোগবিলাসের চাহিদা থাকবে। চীনের হুনান প্রদেশে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ বছর আগের একটি করবস্থান আবিষ্কৃত হয়েছে। যেখানে অন্তত ১ হাজার কবর ছিল। এর প্রতিটি কবরে অস্ত্র, গহনাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র দেওয়া হয় বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

মানুষ মৃত্যুর পর জাগতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে চলে যায়। মৃতের প্রতি সম্মান দেখানো ইসলামের একটি অলঙ্ঘনীয় প্রথা। কিন্তু কখনো কখনো এ নিয়মেরও ব্যতিক্রম ঘটে। উমাইয়াদের পর আব্বাসীয়রা মুসলিম খেলাফতের হাল ধরে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে তারা নারী-পুরুষনির্বিশেষে প্রায় সব উমাইয়াকে হত্যা করে। এমনকি কবর খুঁড়ে তাদের লাশও অবমাননা করা হয়। আব্বাসীয় খলিফা আবুল আব্বাস ও আল মনসুর এ কর্মকান্ডে উৎসাহী ভূমিকা পালন করেন। আল মনসুরের মৃত্যুর পর তার কবর যাতে কেউ চিহ্নিত করতে না পারে সেজন্য গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। তার জন্য খোঁড়া হয় ১০০ কবর। যার একটিতে অতি গোপনে বাগদাদের এই খলিফার শেষশয্যা পাতা হয়। ইসলাম মৃতদেহ বা কবরের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ অনুমোদন করে না। কিন্তু আধুনিককালেও এ ধরনের বর্বরতা কম ঘটেনি। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে শাহেন শাহ রেজা শাহ পাহলভির পতন ঘটে। ক্ষমতায় এসে মোল্লারা শাহের পিতার মাজারকে পাবলিক ল্যাট্রিনে রূপান্তর করেন। শোনা যায়, শিয়ারা হজ পালনকালে একসময় খলিফা হজরত ওমর (রা.) ও হজরত ওসমান (রা.) প্রমুখের কবরের ওপর আবর্জনা ফেলার চেষ্টা করত। তাদের দৃষ্টিতে এটি নাকি মহাপুণ্যের কাজ। উগ্র সুন্নিরা এখনো হজরত আলীর (রা) মাজারে হামলা চালানোকে পুণ্যের কাজ মনে করে। মমি করার পদ্ধতি চালু হয় আড়াই থেকে ৫ হাজার বছর আগে। মিসরীয়দের মমি প্রথা এখনো কালের সাক্ষী। লাতিন আমেরিকার ইনকা সভ্যতায়ও লাশ মমি করে রাখার রেওয়াজ ছিল।

আধুনিক এই যুগেও লাশ মমি করে রাখার ঘটনা খুব একটা কম নয়। রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবের নায়ক ছিলেন ভøাদিমির ইলিচ লেনিন। লেনিন মারা যান ১৯২৪ সালে। মস্কোর রেড স্কয়ারে তাঁর লাশ কাচের এক চৌকো বাক্সে মমি করে রাখা হয়। লাশ রাখা হয় এমনভাবে যা দেখলে মনে হবে হয়তো মাত্র লেনিন ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমিয়ে আছেন কোট-প্যান্ট পরা অবস্থায়। সোভিয়েত আমলে রেড স্কয়ারের লেনিন মিউজিয়াম ছিল প্রকৃত অর্থে কমিউনিস্টদের এক তীর্থকেন্দ্র। প্রতিদিন দেশ-বিদেশের হাজার হাজার লোক লেনিনের লাশ দর্শন করত। রাশিয়ায় কমিউনিজমের পতনের পরও লেনিন মিউজিয়াম দেখায় লোকের ভিড় এখনো খুব একটা কমেনি। লেনিন ছিলেন মননে-মগজে নিরীশ্বরবাদী। সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকে থাকা অবস্থায় তাঁর সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা জানানো হতো সমাজতন্ত্রী নেতা হিসেবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা ও লেনিনবাদী তত্ত্বের জনক হিসেবে। তবে এখন পারলৌকিকতায় বিশ্বাসী অনেকেই তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা করেন। চীনা নেতা মাও সে তুংয়ের লাশও রাখা হয়েছে মমি করে। চীন মাওয়ের কট্টর সমাজতন্ত্রী পথ থেকে সরে এলেও তাঁর প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধের অবসান ঘটেনি। যে কারণে প্রতিদিনই মাও সে তুংয়ের মমি দেখতে হাজারো লোকের ভিড় জমে।

বিশ্বের এ যাবৎকালের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ বীর হিসেবে ধরা হয় চেঙ্গিস খানকে। ১২১৭ সালে ৬৫ বছর বয়সে প্রাণ হারান এই মোঙ্গল বীর। প্রতিপক্ষের হাতে চেঙ্গিসের সমাধির অবমাননা হতে পারে এই ভয়ে তাঁকে কবর দেওয়া হয় গোপনীয়ভাবে। তাঁর লাশের সঙ্গে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, রাষ্ট্রীয় দলিলের পান্ডুলিপি, বিভিন্ন শিল্পকর্ম ও সোনার তৈরি জিনিসপত্রও কবর দেওয়া হয়। প্রচলিত আছে, চেঙ্গিস খানের সঙ্গে ৪০ জন সুন্দরী রমণীকে এবং তাঁর পছন্দের ঘোড়াগুলোকে কবর দেওয়া হয়। পশ্চিম চীনের জিজিয়া প্রদেশ অবরোধের সময় তিনি ঘোড়ার পিঠে থাকা অবস্থায় মারা যান। গোপনীয়তার জন্য তাঁর লাশের শেষকৃত্য শোভাযাত্রার সামনে যাকে পাওয়া গেছে তাঁকেই হত্যা করা হয়। তবে চেঙ্গিসের এক উত্তরাধিকারী মোঙ্গল শাসক মংকের রেকর্ড আরও জাঁকালো; যার শবযাত্রায় ২০ হাজার লোককে প্রাণ হারাতে হয়। মোঙ্গলদের বিশ্বাস ছিল, এসব লোক এবং জ্যান্ত কবর দেওয়া প্রাণীগুলো পরজীবনে সম্রাটের সেবা করবে। চেঙ্গিস খানের সমাধি আবিষ্কারের চেষ্টা কম হয়নি। এ প্রচেষ্টায় এ যাবৎ কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ব্যবহৃত হয়েছে বিমান, হেলিকপ্টারসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি। প্রতœতাত্ত্বিকরা এজন্য যে কসরত করেছেন তার তুলনা নেই। মজার ব্যাপার হলো, মোঙ্গলরা চেঙ্গিস খানের সমাধিস্থল আবিষ্কারের চেষ্টাকে কখনো ভালো চোখে দেখেনি। এ ব্যাপারে তাদের কাছ থেকে বিদেশিরা কার্যত কোনো সহযোগিতা পায়নি। তাদের বিশ্বাস, চেঙ্গিসের সমাধিস্থল আবিষ্কৃত হলে মোঙ্গলদের ওপর মহাদুর্যোগ নেমে আসবে। তারা মনে করে, যত চেষ্টাই চলুক কারও পক্ষে এই গ্রেট খানের সমাধি আবিষ্কার করা সম্ভব হবে না। মিসরীয়দেরও বিশ্বাস ছিল ফেরাউনদের কবর বা মমি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি একটি অভিশপ্ত কাজ। ফারাওয়ের অভিশাপে অনেক আবিষ্কারক জীবন হারিয়েছেন- এমন কুসংস্কারও রয়েছে।

পারলৌকিকতায় যাদের আস্থা নেই তারা মৃত্যুর পর লাশ সৎকারের বিষয়টিকে গুরুত্বহীনভাবেই দেখেন। ভারতের পশ্চিম বাংলার জনপ্রিয় কমিউনিস্ট নেতা কমরেড জ্যোতিবসু ছিলেন তাদেরই একজন। তিনি মৃত্যুর আগে উইল করে যান তাঁর লাশ যেন গবেষণার কাজে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের দান করা হয়। জ্যোতিবসু নাস্তিকতায় বিশ্বাসী হলেও তাঁর ব্যবসায়ী পুত্রের আস্থা ছিল আস্তিকতায়। বাবার ইচ্ছাকে মূল্য দিতে তিনি তাঁর লাশ হাসপাতালে দান করেন। বাংলাদেশের কোনো কোনো ইহলৌকিকবাদীও মৃত্যুর পর তাঁদের লাশ হাসপাতালে দান করার নজির রেখেছেন। তাঁদেরই একজন ড. আহমদ শরীফ। গবেষক হিসেবে যার তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক সারা জীবন প্রাচীন পুঁথিসাহিত্য সম্পর্কে গবেষণা করেছেন। অন্ধকার থেকে পাদপ্রদীপের নিচে এনেছেন মধ্যযুগের অমূল্য সম্পদ মুসলিম সাহিত্যকে। ড. আহমদ শরীফ মৃত্যুর পর তাঁর লাশ চিকিৎসকদের গবেষণার জন্য দান করার সিদ্ধান্ত নেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ঘনিষ্ঠজনদের মজা করে বলতেন, ধর্মান্ধদের ভয়ে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর ভয় ছিল, মৃত্যুর পর গবেষণাধর্মী লেখা পড়ে মোল্লারা হয়তো তাঁকে বড় কোনো পীর ভেবে বসবে। হয়তো তাঁর কবরকে ওরা মাজার বানিয়ে ব্যবসাও ফাঁদবে। সে দুর্গতি থেকে রেহাই পেতেই মৃত্যুর পর লাশ যাতে দাফন করা না হয় সে উইল নাকি করে যান।

হিন্দুধর্মে লাশ সৎকারে দাহ করা হয়। বৌদ্ধ ও শিখদের মধ্যেও চালু রয়েছে অভিন্ন রীতি। পারসিকদের লাশের সৎকারে রয়েছে বিচিত্র নিয়ম। উঁচু টাওয়ার অথবা পাহাড়ের ওপর তারা রেখে দেয় মৃতদেহ। শেষ পর্যন্ত তা শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়। মৃতদেহ সৎকারে কবর দেওয়া, শ্মশানে নিয়ে পোড়ানো কিংবা টাওয়ারে রেখে শকুন দিয়ে খাওয়ানো- যে পদ্ধতিই অবলম্বন করা হোক না কেন তার আসল উদ্দেশ্য জীবিতের দৃষ্টি থেকে মৃত ব্যক্তিকে আড়াল করা। এ ক্ষেত্রে কবরের মাটি কিংবা শ্মশানের আগুনের কাজটি অভিন্ন।

আমরা কেউ মরতে চাই না। তবু মৃত্যু এক অনিবার্য সত্য। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানবদেহের বিলীন ঘটে। ধর্মীয় বিশ্বাসমতে, দেহের বিলীন ঘটলেও আত্মার মৃত্যু ঘটে না। মানুষের মানবিক অবদানেরও রয়েছে অবিনশ্বর সত্তা। জীবদ্দশায় যারা মানুষের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করেন, তারা লাভ করেন অমরতা। মৃত্যুর পরও তাদের উপস্থিতি অনুভব করে প্রতিটি মানুষ। মানবজীবনের আসল অমরতা সেখানেই।

বলছিলাম পয়লা মের কথা। করোনাভাইরাসকালের কথা। সাক্ষাৎ আজরাইল হয়ে এ ভাইরাস প্রতিদিনই বিষ নিঃশ্বাস ফেলছে হাজার হাজার মানুষের ঘাড়ে। মানবজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কাও দানা বেঁধে উঠেছে অনেকের মনে। তবে কয়েক হাজার বছরের মানবসভ্যতা সাক্ষ্য দেয়, রোগব্যাধি-ভাইরাস যত ভয়ঙ্করই হোক তার কোনোটিই অপরাজেয় নয়। বিজ্ঞানের এই যুগে কোনো ভাইরাস দীর্ঘদিন ধরে মানুষের ওপর ছড়ি ঘোরানোর সক্ষমতা দেখাবে- তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। নভেল করোনা নামের অদৃশ্য দানবের পতনও তাই সময়ের ব্যাপার। মানুষ যে অবিনশ্বর কোনো সত্তা নয়, তা দিবালোকের মতো সত্য। তবে মানুষ এমন এক জীব যারা সহজে হার মানতে রাজি নয়। বিশ্বাস করতে চাই, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত মানুষের জয় হবেই। আবিষ্কার হবে ভ্যাকসিন, ওষুধ। গুটিবসন্ত ও প্লেগের মতো এ ভাইরাসের ঠাঁই হবে ইতিহাসের পাতায়।              লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর