শুক্রবার, ১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

আবাসনশিল্পে করোনার আঘাত ঘুচবে কীভাবে?

ইকবাল হোসেন চৌধুরী

আবাসনশিল্পে করোনার আঘাত ঘুচবে কীভাবে?

চীনের উহান থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯-এর আঘাত হেনেছে বাংলাদেশে। সম্পদের প্রাচুর্য ভুলে মানুষ আজ বাঁচার আকুতি নিয়ে লড়ছেন করোনা জয়ে।

এ লড়াইয়ে ধনী-গরিব ভেদাভেদ নেই। কারণ, যে কোনো অর্থনৈতিক মন্দা বা সংকটের প্রথম আঘাত আসে সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। ফলে আবাসনশিল্পে যে আঘাত এসেছে, তার প্রভাব এ খাতের প্রায় ২৫ লাখ নির্মাণশ্রমিকের ওপরও পড়তে যাচ্ছে। পড়বে দেশের অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের ওপরও। নিম্ন আয়ের মানুষের অর্থনৈতিক অক্ষমতা বিবেচনায় নিয়েই হয়তো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডব্লিউএইচও বলেছে, করোনা রোগে যত মানুষ বিশ্বে মারা যাবে, তার চেয়েও বেশি মানুষ প্রাণ হারাবে না খেয়ে। সংস্থাটি করোনার আঘাতে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে বিশ্বের ২ থেকে ৪ কোটি মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা করছে। মানুষ ও মানবতার এই পৃথিবী এবং কোনো সভ্য দেশে এই প্রাণহানি কারও কাম্য নয়। তাই এই প্রাণহানি রুখতে এখনই শ্রমজীবী ও অভাবী মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়ের নিশ্চিয়তা করতে হবে। এ লক্ষ্যে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্বাভাবিক রাখতে হবে। আবার করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধিও। অর্থাৎ আমাদের করোনার হাত থেকে যেমন সুরক্ষা পেতে হবে, তেমন মানুষের কর্মচাঞ্চল্য ফিরিয়ে এনে স্বাভাবিক জীবন যাপনও নিশ্চিত করতে হবে। সচল করতে হবে অর্থনীতির চাকা।

যদিও করোনার ফলে ইতিহাসের বৃহত্তম অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা করছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিও। সংস্থাটি বলেছে, বিশ্বের প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারীর কারণে ইতিহাসের বৃহত্তম অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। করোনার কারণে চলতি বছরে বাণিজ্য বিনিময় ১৩ থেকে ২৩ শতাংশ কমে যাবে। বিশ্বে শেয়ার বা মুদ্রাবাজারগুলোর পতনের ফলে চলতি বছরে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের চেয়েও বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেবে। বিশ্বে বাণিজ্য ও উৎপাদন বিপুল মাত্রায় কমে যাবে। তারই পরিণতিতে বিশ্বে বেকারত্ব বাড়বে বিপুল হারে। ১৯৩০ সালে ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দা হয়েছিল। কিন্তু আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দা আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা সবার মাঝে ছড়িয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সকল শ্রেণির মানুষ এবং অর্থনীতি রক্ষায় প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করায় জানাই অভিনন্দন। তিনি করোনা সংকটে আগামী তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। এটা আমাদের ব্যবসায়ী সমাজকে আশার আলো দেখিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অর্থনীতি যেন স্থবির না হয়ে যায় এবং গতিশীলতা বজায় থাকে, সেভাবেই সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই অনুপ্রেরণা আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায়। মনে এনে দেয় শক্তি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া এই সাহস ও শক্তি নিয়ে চলমান সংকট উত্তরণে এগিয়ে যাবে দেশের আবাসনশিল্প। এ ক্ষেত্রে আবাসনশিল্পের চলমান জরুরি সংকট ও সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্য।

ইতিমধ্যে আবাসনশিল্প উদ্যোক্তাদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-রিহ্যাব ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ স্বাগত জানিয়ে আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াতে চারটি খুবই জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। এ চার পদক্ষেপ হলো- ক. অবিলম্বে আবাসনশিল্পে বিনিয়োগকারীদের তৎক্ষণাৎ সংকট মোকাবিলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে আবাসন খাতে বরাদ্দ প্রদান করা। খ. আবাসন ব্যবসায়ীদের বিদ্যমান ঋণের সুদ চলতি বছরের আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মওকুফ ও সহজ শর্তে পুনঃ তফসিল করা। গ. বর্তমান পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি সংকট নিরসনে আবাসনশিল্পে ২০০৭-০৮ সালের মতো হাউজিং রি-ফিন্যান্সিং স্কিম পুনঃ প্রচলন অতি আবশ্যক। ঘ. রিহ্যাব, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, এফবিসিসিআই ও এনবিআরের সমন্বয়ে গঠিত ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় বাংলাদেশের আবাসনশিল্পের সমস্যা সমাধান এবং সার্বিক উন্নয়নের নিমিত্ত গৃহীত সুপারিশসমূহ অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা। এ চার পদক্ষেপে আবার ঘুঁরে দাঁড়াবে আবাসনশিল্প। অন্যান্য লিংকেজ শিল্প আবার গতিশীল হবে। অর্থনীতি হবে স্বাবলম্বী। করোনাভাইরাস সংকট কেটে আবার বাড়বে প্রবৃদ্ধি। ভুলে গেলে চলবে না, উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার আবাসন খাতে করোনার আঘাতে ঝুলে গেছে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার বাজার। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত মোতাবেক আবাসন খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৫-১৭ শতাংশ। বছরে চাহিদা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার ফ্ল্যাটের। এ ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তের সংখ্যাবৃদ্ধি, ভূমির রেজিস্ট্রেশন ফি কমানো, ব্যাংক ঋণে ছাড়, সরকারি কর্মকর্তাদের হোম লোন ও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ এ শিল্পে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছিল। এসব কারণে গত অর্থবছরে ফ্ল্যাট বিক্রি ২০ শতাংশের মতো বেড়েছিল; যা করোনার কারণে এখন থমকে গেছে। করোনাভাইরাসের সংকটময় এ পরিস্থিতিতে আবাসন খাতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কা উদ্যোক্তাদের। আর কাজ না থাকায় জীবনযাপনে চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছে সারা দেশের নির্মাণশ্রমিকরা। শ্রমিকের ভবিষ্যৎ এখন অজানা। কনস্ট্রাকশন খাতে প্রায় ৩৫ লাখ ও আবাসন খাতে প্রায় ২৫ লাখ মিলিয়ে যে প্রায় ৬০ লাখ নির্মাণশ্রমিক রয়েছে, তাদের জীবনযাপন ও বেঁচে থাকা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। এই নির্মাণশ্রমিকদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে কাজ দিয়ে। তাই আবাসন খাতকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের নীতিসহায়তা চাই। আবার আবাসন খাতে পদে পদে যেসব হয়রানি হয়, তা থেকেও পরিত্রাণ দেওয়াটা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্প অনুমোদনের সব প্রক্রিয়া সহজীকরণ করতে হবে। নীতিসহায়তার সঙ্গে কর প্রণোদনাও প্রয়োজন। এগুলো সরকার ইতিবাচকভাবে দেখলেই ঘুরে দাঁড়াবে আবাসন খাত। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বিপদগ্রস্ত নির্মাণশ্রমিকরাও রক্ষা পাবে।

লেখক : ইকবাল হোসেন চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেসিএক্স ডেভেলপমেন্টস লিমিটেড ও জেমস ডেভেলপমেন্টস লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর