রবিবার, ৩ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

কৃষকের পেশাগত স্বাস্থ্যঝুঁকি ও খাদ্য নিরাপত্তা

শাইখ সিরাজ

কৃষকের পেশাগত স্বাস্থ্যঝুঁকি ও খাদ্য নিরাপত্তা

এ লেখাটি লিখতে বসেছি মহান মে দিবসের প্রারম্ভে। শ্রমিক অধিকার আদায়ের প্রশ্নে ভাস্বর একটি দিন। এ যাবৎকালের অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এবারের মে দিবসের তাৎপর্য ভিন্ন। কারণ করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বে অচলাবস্থার সবচেয়ে করুণ শিকার হয়েছে শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী। আইএলও মনিটরের তথ্য হচ্ছে, প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজনের বেশি শ্রমিক করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শতকরা হিসাবে বিশ্বের মোট শ্রমশক্তির ৮১ শতাংশই করোনার কবলে বিপর্যস্ত। পূর্ণ বা আংশিক বন্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে ৩৩০ কোটি শ্রমিক আংশিক বা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আইএলওর বিবেচনায়, করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি বেকার হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়। আরব দেশগুলোর মোট শ্রমঘণ্টার ৮ দশমিক ১ শতাংশ নষ্ট হচ্ছে, যা প্রায় ৫০ লাখ ফুলটাইম শ্রমিকের কর্মঘণ্টার সমান। অর্থাৎ আরব বিশ্বে প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। যার বড় একটি অংশ আমাদের প্রবাসী শ্রমিক।

মধ্যপ্রাচ্যের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। ইউরোপের শ্রমিকের ৭ দশমিক ৮ শতাংশ বা ১ কোটি ২০ লাখ ফুলটাইম শ্রমিক বেকার হয়েছে। আর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোর মোট শ্রমঘণ্টার ৭ দশমিক ২ শতাংশ বা ১২ কোটি ৫০ লাখ ফুলটাইম শ্রমিক বেকার হয়েছে।

অবশ্য একেক দেশ একেক রকম নীতি গ্রহণ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে কৃষিশ্রমিক। ইউরোপ-আমেরিকার কৃষি নির্ভর করে অভিবাসী শ্রমিকের ওপর। আমেরিকার বেশির ভাগ শ্রমিক মেক্সিকো, ইকুয়েডরের আর ইউরোপের উন্নত দেশগুলোয় শ্রমিক চাহিদা পূরণ হয় ইউক্রেন, পোল্যান্ডসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতির দেশের কৃষিশ্রমিকের মাধ্যমে। জার্মানিতে গত দেড় মাস বাইরের কৃষিশ্রমিক আসা পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ফসলি মৌসুম উপলক্ষে বাইরের শ্রমিক আসার ওপর সরকারি সিদ্ধান্ত কিছুটা শিথিল করেছে। জার্মানির জেলসেনে বসবাসকারী সেখানকার একমাত্র বিদেশি কৃষি উদ্যোক্তা মোকতাজল হোসেন কাজলের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছি। কাজল জানিয়েছেন কৃষক হিসেবে তারা দুই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি। প্রথম সমস্যা শ্রমিকের অভাবে তারা ফসল তুলতে পারছেন না। দ্বিতীয়ত নিজেরা কিছু ফসল তুলতে পারলেও ক্রেতা পাচ্ছেন না। যদিও জার্মান সরকার খুব দ্রুত তাদের সমস্যা আমলে নিয়ে কৃষককে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে। খামারগুলোকে কতজন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়, সে সংখ্যার ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছে। যাদের খামারে এক থেকে পাঁচ জন শ্রমিক কাজ করে তাদের ৫ হাজার ইউরো, ছয় থেকে ১০ জন শ্রমিকের খামারে ১৫ হাজার ইউরো, ১১ থেকে ২৫ জন শ্রমিকের খামারে ২৫ হাজার ইউরো তৎক্ষণাৎ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রেরণের ব্যবস্থা করেছে। কাজল বলছিলেন জার্মানিতে এই সময়ে সাধারণত প্রতি বছর ২ লাখ অভিবাসী শ্রমিক কাজ করে। কিন্তু এই বিরূপ পরিস্থিতিতে জার্মান সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তসাপেক্ষে ৬০ হাজার অভিবাসী কৃষিশ্রমিকের কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। শর্তগুলো হচ্ছে- যে দেশ থেকে শ্রমিক আসবে তাকে অবশ্যই বিমানে আসতে হবে, বিমানে ভ্রমণের আগে ‘করোনা আক্রান্ত নন’- ডাক্তারের এমন ছাড়পত্র নিতে হবে। বিমানে এসে পৌঁছার পর সরাসরি খামারে নিয়ে গিয়ে প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করে তাকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর স্থানীয় চিকিৎসক যদি সেই শ্রমিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে অনুমতি দেন, তবেই তিনি কাজ করতে পারবেন। এসব শর্ত মেনেই স্থানীয় উদ্যোক্তারা কৃষিশ্রমিক আনতে রাজি ছিলেন। কিন্তু করোনা আতঙ্কে শ্রমিকরাই আসতে রাজি হচ্ছে না বলে জানালেন কাজল। কাজলের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম এ পরিস্থিতিতে জার্মানিতে খাদ্য ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা আছে কিনা। কাজল বললেন, ৩৩ বছর তিনি জার্মানিতে আছেন, এমন পরিস্থিতি কখনো দেখেননি। এ সময়টা অ্যাসপারাগাস, আলু, আপেল, স্ট্রবেরিসহ নানান সবজি ও ফল হারভেস্টের সময়। সবজিগুলো মাঠেই নষ্ট হচ্ছে। আর সামনে ভুট্টা, টমেটো প্রভৃতি ফসলের জন্য জমি প্রস্তুত করাও সম্ভব হচ্ছে না শ্রমিকের অভাবে। খাদ্য যদি উৎপাদনই না করা যায়, খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবেই।

আমাদের দেশের বেশির ভাগ কৃষিশ্রমিক টানা এক মাস কর্মহীন থাকার পর কিছু অংশ নিজ জেলা ছেড়ে আরেক জেলায় ধান কাটার কাজে যেতে পেরেছে ঠিক, কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঘরেই দারিদ্র্যের কঠিন সময় পার করছে এমন শ্রমিকও কম নেই। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে আমাদের দেশের কৃষিশ্রমিকরা কি স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করতে পারছেন? আমি খোঁজখবর নিয়ে যতটুকু জেনেছি হাওরে উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষিশ্রমিকদের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছে, বারবার হাত ধোয়া, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করা, মাস্ক ব্যবহার সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তোলার কাজটুকু করেছে। তবে যেসব অঞ্চলে এনজিওগুলোর সরাসরি তত্ত্বাবধান নেই সে অঞ্চলগুলোয় কৃষিশ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি ততটা মানছে না। নির্দিষ্ট শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করছে না। যদিও আমাদের দেশে জার্মানির মতো একজন কৃষিশ্রমিককে একটি কক্ষে রাখার মতো ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়, তবে সরকার এবার স্কুল-কলেজগুলোয় কৃষিশ্রমিকদের রাতযাপনের ব্যবস্থা করেছে। অন্য বছরগুলোয় তারা খোলা মাঠে বা ছোট জায়গায় গাদাগাদি করেই রাতযাপন করত।

আসা যাক কৃষি ঋণের প্রসঙ্গে। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক সোমবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক অনলাইন সভায় বলেছেন, সব মিলিয়ে ২৯ হাজার ১২৪ কোটি টাকার ঋণ ও প্রণোদনা পাবে দেশের কৃষক। এরই মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা ৪ শতাংশ সুদে ঋণ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে বর্তমান বাজেটে কৃষকের স্বার্থে সারসহ সেচকাজে বিদ্যুৎ বিলের রিবেট বাবদ কৃষি খাতে ৯ হাজার কোটি টাকার ভর্ভুকি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অন্যদিকে ৯ শতাংশ সুদের পরিবর্তে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে কৃষককে ঋণ বিতরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ ঋণ প্রণোদনা প্রদান করবে। প্রশ্ন হলো নিয়মনীতি নিয়ে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে যা বলা হয়েছে তাতে দেখা যায়, সব নিয়মনীতি থাকছে আগের মতোই। কৃষকের সিংহভাগই বর্গাচাষি। যদি আগের নিয়মনীতিই থেকে যায়, তাহলে এর সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক কীভাবে গ্রহণ করবে? এ নিয়ে কথা বলেছি বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি ঋণ শাখার মহাব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, এমনিতে প্রতি বছর ২৪ হাজার ১২৪ কোটি টাকা কৃষি খাতে ঋণ দেওয়া হতো ৯% সুদে। তবে এ বছর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী-ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনাসহ মোট ২৯ হাজার ১২৪ কোটি টাকার ঋণ প্রদান করা হবে ৪% সুদে। সব তফসিলি ব্যাংকই এ ঋণ কৃষকের মধ্যে বিতরণ করবে। এ ঋণের মেয়াদ হবে এ বছরের ১ এপ্রিল থেকে পরবর্তী ১৫ মাসের। আমার প্রশ্ন ছিল বর্গাচাষিরা কীভাবে ঋণ পেতে পারে। তিনি জানালেন, সাধারণত ৫ একর পর্যন্ত জমি চাষ করার জন্য বর্গাচাষিদের ঋণ দেওয়া হয়। ৫ একরের বেশি জমি চাষের জন্য ঋণ দেওয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে জমির মালিকের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে গিয়ে ব্যাংক থেকে বর্গাচাষিরা এ ঋণ নিতে পারবে।

দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যু হচ্ছে প্রতিদিন। প্রতিদিন শত শত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যেই বজ্রপাতেও ঝরছে প্রাণ। চলতি এপ্রিলে বজ্রপাতে প্রায় ৫৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। গত বছরের পুরো এপ্রিলে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ২১। বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। করোনার ভিতর ঝুঁকি নিয়ে কৃষক ধান কাটতে যাচ্ছে, কিন্তু বজ্রপাতে প্রাণ রক্ষা হচ্ছে না তাদের। এ ক্ষেত্রে কৃষককে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সরকারের কোনো চিন্তা-ভাবনা আছে কিনা জানতে কথা বলি কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী বজ্রপাতে মারা যাওয়া প্রত্যেক কৃষক পরিবারের জন্য কমপক্ষে ১ লাখ টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছেন। মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলাম, কিন্তু এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কৃষককে রক্ষা করতে স্থায়ী সমাধান কী হতে পারে? এ ছাড়া কৃষকের পেশাগত স্বাস্থ্যঝুঁকি ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে সরকারের কোনো চিন্তা আছে কিনা? ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ২০ জেলায় বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতালকে যুক্ত করে প্রতি সপ্তাহে কৃষককে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের চেষ্টা করেছি। কৃষক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে একদমই সচেতন নয়। শতকরা ৯৫ ভাগ কৃষকই রক্তের গ্রুপ সম্পর্কে জানে না। ধান রোপণ করতে গিয়ে পচা শামুকে হাত কেটে গেলেও কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয় না। সেই কাটা হাত নিয়েই কাজ করে যায়, সার দেওয়া, কীটনাশক প্রয়োগ সবই করতে হয়। ফলে সেই কাটা অংশে ইনফেকশন দেখা দেয়। বহু দেশের কৃষককে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে, কি ধনীদেশ বা দরিদ্র্র দেশ। নিকটবর্তী একটি দেশ থাইল্যান্ডে দেখেছি কৃষকের কৃষি উপকরণ বা যন্ত্রের পাশাপাশি তাদের গামবুট, গ্লাভস, হ্যাট, মাস্ক রয়েছে। এগুলো প্রত্যেক কৃষকের ব্যক্তিগত সুরক্ষার উপাদান। অথচ আমাদের দেশের কৃষকের এসব কিছুই নেই। এসব নিয়ে সরকারের কৃষি বিভাগ যেমন ভাবেনি, তেমন ভাবেনি কৃষি উপকরণ বিক্রেতা কোম্পানিগুলোও। যারা কোটি কোটি টাকার কীটনাশক বিক্রি করছে কৃষকের কাছে, তারা অন্তত কৃষককে কীটনাশক ছিটানোর আগে মাস্ক পরার বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে পারত। আমাদের কৃষকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ও কৃষককল্যাণ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কৃষিমন্ত্রীর কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম এ ব্যাপারে সরকারের কৃষি বিভাগ কোনো প্রকল্প হাতে নিতে পারে কিনা। কৃষিমন্ত্রী বললেন, ‘এ বিষয়গুলো নিয়ে ওভাবে ভাবিনি। তবে কৃষকের স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলো নিয়ে আপনার সঙ্গে বসব। কীভাবে বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক ঝুঁকি থেকে শুরু করে কৃষকের পেশাগত স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে আনা যায় এ ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবতে হবে।’

করোনার মধ্যেই কৃষিতে আরেক আশঙ্কার বার্তা নানাভাবেই আসছে। ধেয়ে আসছে পঙ্গপাল। চলতি বছরের মে-তে ভারতে পঙ্গপালের উপদ্রব শুরু হবে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছিল বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে একদল পঙ্গপাল সরাসরি ভারত উপদ্বীপের কৃষিজমিতে নেমে পড়তে পারে। এ গ্রীষ্মে ভারতের কৃষিজমিগুলোয় হামলে পড়তে পারে পঙ্গপাল। পরপরই আক্রান্ত হতে পারে বাংলাদেশ। জানা যায়, হর্ন অব আফ্রিকা থেকে একদল পঙ্গপাল গতিপথে মরু অঞ্চলের আরেক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হানা দিচ্ছে। এর একটি ঝাঁক ইয়েমেন, বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, ইরান, সৌদি আরব ও পাকিস্তান হয়ে ভারতে হানা দিচ্ছে। এরা ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানাসহ আরও কয়েকটি এলাকায় ঢুকছে। এ কারণেই করোনা মহামারী থেকে খাদ্যের মহামারীর আশঙ্কার মধ্যে পড়েছে ওই দেশগুলো। বাংলাদেশের টেকনাফে ইতিমধ্যে পঙ্গপালের মতো এক ধরনের পোকার আক্রমণের কথা শোনা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের আগে থেকেই সতর্ক হতে হবে।

এরই মধ্যে আরেকটি উদ্বেগ আছে, তা হচ্ছে ফল আর্মি ওয়ার্ম। গত বছর দেশের বিভিন্ন এলাকার ভুট্টা খেতে ‘ফল আর্মি ওয়ার্ম’-এর ব্যাপক আক্রমণ দেখা দেয়। এতে চরম প্রভাব পড়ে ফলনের ওপর। এবারও আর্মি ওয়ার্মের ব্যাপক আক্রমণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবার ফল আর্মি ওয়ার্ম দমনে কৃষকের জন্য প্রদান করেছে ফেরোমন ট্র্যাপ। কষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের আর্মি ওয়ার্ম মনিটরিং ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক একটি প্রকল্পে তারা ১২ হাজার ৫০০ ফেরোমন ট্র্যাপ ও ৩৭ হাজার ৫০০ স্ট্রিপ প্রদান করেছে। এ ছাড়া এফএও আর্মি ওয়ার্মে আক্রমণ বেশি এমন ১৪ জেলার কৃষককে প্রশিক্ষণও দিয়েছে। ফেরোমন ট্র্যাপ আমাদের কৃষকের কাছে অপরিচিত কিছু নয়। এর মাধ্যমে ভুট্টার ফলন বিপর্যয় কতটা রোধ করা যাবে, তা জানতে কথা বলেছি এফএওর বাংলাদেশ প্রতিনিধি রবার্ট ডি সিম্পসনের সঙ্গে। তার কাছে আমার প্রশ্ন ছিল, ফল আর্মি ওয়ার্মের আক্রমণ বেশি হলে কৃষক স্থানীয় উপায়ে এর প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে পারে কিনা। তার সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতাও শেয়ার করলাম। শেরপুরের পাহাড়ি সীমান্ত এলাকার কৃষিজমির ফসল বন্যহাতি নষ্ট করে দিচ্ছিল- এমন একটি প্রতিবেদন চ্যানেল আইয়ে প্রচারের পর অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী আমাকে একটা ওয়েবলিংক পাঠিয়েছিলেন। সেখানে আফ্রিকার কৃষক কীভাবে বন্যহাতি থেকে নিজেদের ফসল রক্ষা করেছে তার উল্লেখ ছিল। তারা হাতির মলের সঙ্গে মরিচগুঁড়ো মিশিয়ে শুকিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিত, এতে প্রচুর ধোঁয়া হতো। এতে হাতির আক্রমণ কমেছে, পাশাপাশি মরিচের উৎপাদনও বেড়েছে। ফল আর্মি ওয়ার্ম প্রতিরোধে এমন কোনো স্থানীয় পদ্ধতি কৃষক কাজে লাগাতে পারে কিনা সে বিষয়ে সিম্পসনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। সিম্পসন জানিয়েছে, কীটনাশকে এটি মরে না, বেশি কীটনাশক প্রয়োগ করলে ফসলের উপকারী পোকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই জৈব বালাইনাশক পদ্ধতির বিকল্প নেই। ফল আর্মি ওয়ার্মের আক্রমণ সাধারণত একটি গাছে প্রথমে শুরু হয়, তারপর আর একটি গাছে সংক্রমিত হয়, তাই যে গাছে আক্রমণ দেখা যাবে, সে গাছটি উপড়ে ফেলতে হবে।

যা হোক, লেখা শুরু করেছিলাম বাংলাদেশের কৃষিশ্রমিক নিয়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো কৃষি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে প্রায় আড়াই কোটি কৃষিশ্রমিক রয়েছে। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের যথাযথ স্বীকৃতি নেই। শ্রম আইনে শ্রমিকের সংজ্ঞায় কৃষিশ্রম অন্তর্ভুক্ত হলেও কৃষি খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা নেই। ফলে এ খাতে নিয়োজিত শ্রমিকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ন্যায্য মজুরি থেকে যেমন বঞ্চিত, তেমন তারা বঞ্চিত প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকেও। আজ এ দুর্যোগ আক্রান্ত সময়ে ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি ও কৃষকের সুস্বাস্থ্যের কথাই ভাবতে হবে সবার আগে। কৃষক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে।

 

                লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর