রবিবার, ৩ মে, ২০২০ ০০:০০ টা
মতামত

অতিবেগুনি রশ্মির ভয়াবহ পরিণাম

আশরাফ আহমেদ

অতিবেগুনি রশ্মির ভয়াবহ পরিণাম

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেদিন আমাদের ইউভি, মানে আল্ট্রা-ভায়োলেট লাইট, বাংলায় যাকে অতিবেগুনি রশ্মি বলা হয়, তাতে গোসল করতে অথবা সেটি শরীরের ভিতর ঢুকিয়ে করোনামুক্ত হওয়ার এক অশ্রুতপূর্ব সম্ভাবনার কথা শোনালেন। সঙ্গে সঙ্গে এ রশ্মি নিয়ে আমার নিজের দুটি অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালে আমি প্রাণরসায়নে এমএসসি ক্লাসের ছাত্র ছিলাম। প্রয়াত অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম চৌধুরীর অধীনে অণুজীব-বিজ্ঞান-বিষয়ক গবেষণা করছি। বিভাগের তিন তলার একটি ঘরের কোণে কাচের দুই দেয়ালবেষ্টিত একটি প্রকোষ্ঠ ছিল। গবেষণার যে যে জিনিস জীবাণুমুক্ত করার প্রয়োজন হতো সেগুলো ওই প্রকোষ্ঠে ঢুকিয়ে সুইচ টিপে চলে আসতাম। নির্দেশ ছিল কাচের প্রকোষ্ঠের ভিতরে দাঁড়িয়ে কোনোভাবেই অতিবেগুনি রশ্মির সুইচ অন করা যাবে না। কারণ ছোট ছোট জীবাণুর মতো মেরে না ফেললেও এ রশ্মি আমাদের দেহের সমূহ ক্ষতি, এমনকি ক্যান্সারও উৎপাদন করতে পারে। অন্য গবেষণায় চৌধুরী স্যার

দেখিয়েছিলেন, অপ্রতুল অতিবেগুনি রশ্মি প্রয়োগ করলে জীবাণু ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস না হয়ে এর জিন-তথ্যে মিউটেশন বা পরিবর্তন হয়। ফলে পরবর্তী প্রজন্মের জীবকোষগুলো লম্বায় ও আয়তনে অস্বাভাবিক রকমের বড় হয়ে যায় এবং এর ক্রোমোজমের দৈর্ঘ্যও বেড়ে যায়। অর্থাৎ অতিবেগুনি রশ্মি মানবদেহেও অস্বাভাবিক কিছু করতে পারে। এর বহু বছর পর ১৯৭৯ সালে জাপানের কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছিলাম। আমার বাসস্থান ছিল পর্যটকদের আকর্ষণ, ইয়াসে-ইউএন নামের এক অসম্ভব সুন্দর জায়গায়, উঁচু পাহাড়ের গা-ঘেঁষে, খরস্রোতা নদীর ঠিক পাশে। বাড়ির বাসিন্দা ছিলাম আমি একা। সন্ধ্যা হতে না হতেই স্থানটি অসম্ভব নির্জন হয়ে যেত এবং একাকীত্ব পেয়ে বসত।

এক সপ্তাহের ছুটি শুরুর আগে থেকেই আমার জ্বর জ্বর ভাব শুরু হলো। বাসায় ফিরতে ফিরতে শুরু হলো চোখ-মুখ জ্বলার যন্ত্রণা। বারবার মুখ-হাত ধুয়েও কোনো নিস্তার পাই না। যন্ত্রণা ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়াল যে, মনে হচ্ছিল কেউ সমুদ্রের লবণমাখা একমুঠো বালি আমার চোখে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সারা সপ্তাহ পরিশ্রমের পর রাতে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়, কিন্তু অসহ্য যন্ত্রণায় তা করতে পারি না। এ যেন ‘কী করব’ প্রশ্নের ‘কী-ও করতে পারবি না’ উত্তর পাওয়া! দুই চোখ দিয়ে অঝরে বয়ে চলা পানির স্রোতটি পাশের খরস্রোতা নদীকেও যেন হার মানায়! বারবার নিংড়ে ফেলেও হাতে ধরা ছোট তোয়ালেটিকে কয়েক মিনিটের জন্যও শুকনো রাখতে পারি না। অসম্ভব একাকিত্বের অনুভূতিতে আমি কি দেশে ফেলে আসা স্বজনদের বিরহে কাঁদছি, না আমার কোনো অসুখ হয়েছে তা বুঝতে পারছিলাম না।

দুই রাত এভাবে কাটানোর পর কীভাবে চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়ে পৌঁছেছিলাম তা আর মনে নেই। ডাক্তার এক বর্ণও ইংরেজি জানেন না, আমার জাপানি জ্ঞানও তদ্রƒপ। কিন্তু তার ব্যবহার খুবই কোমল ছিল বলে আবছা চোখে তাকে সুন্দরীই দেখলাম। উপরন্তু চোখ পরীক্ষা করার সময় তার নাক আমার গাল স্পর্শ করছিল যেন! কাগজে ইংরেজিতে লিখে জানতে চাইলেন ‘তুমি কি অতিবেগুনি রশ্মি নিয়ে কাজ কর?’ বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন অতিবেগুনি রশ্মি তোমার মুখের চামড়া ও চোখের ভীষণ ক্ষতি করেছে। এ রশ্মিতে আরও বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তুমি অন্ধ হয়ে যেতে পারতে। এই বলে তিনি অতি সস্নেহে আমার মুখম-লে একটি মলম লাগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আপাতত সাত থেকে ১০ দিন ল্যাবে যাওয়া বন্ধ রাখো, এবং এরপর অতিবেগুনি রশ্মি নিয়ে কাজ করার আগে অতি অবশ্যই মুখোশ পরে নেবে।

ব্যাপারটি ছিল এ রকম : ল্যাবের অতিবেগুনি রশ্মি জ্বালানো হতো কাচের ছোট একটি বাক্সে। দুই হাতের কবজি পর্যন্ত আমার দেহটি ঢাকা থাকত ল্যাবকোটে আর হাতে থাকত দস্তানা বা গ্লাভস। একটি টুলে বসে হাত দুটো কাচের বাক্সে ঢুকিয়ে ভিতরে অতিবেগুনি রশ্মি জ্বালিয়ে গবেষণার কাজ করতাম। হাত ঢোকানোর খোলা জায়গা দিয়ে রশ্মির ছিটেফোঁটা যা বেরিয়ে আসত তা বাক্সের বাইরের টেবিলে প্রতিফলিত হয়ে আমার চোখ ও মুখ জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

চৌধুরী স্যারের কাছে শিক্ষাটি বহু বছর আগে হওয়ায় তা পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলাম। সেদিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সবকিছু মনে করিয়ে দিলেন। আপনারাও মনে রাখবেন।

লেখক : ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসরত লেখক ও বিজ্ঞানী।

সর্বশেষ খবর