সোমবার, ৪ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাভাইরাসে গৃহবন্দী রমজান

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন

করোনাভাইরাসে গৃহবন্দী রমজান

সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপট এবং পরিবেশের মধ্যে এবার মুসলিম উম্মাহর কাছে এসেছে বহু প্রতীক্ষিত মহিমান্বিত পবিত্র রমজান মাস। এই রমজান মাসকে সামনে রেখে শাবান মাসের তেমন কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এই মাসের যাবতীয় আয়োজন ঘরে ঘরে ছিল অনুপস্থিত। রমজান মাসের তাৎপর্যপূর্ণ তারাবি নামাজের আয়োজন নেই মসজিদগুলোতে। পরিবারের সদস্য নিয়ে তারাবি নামাজে শরিক হওয়ার তাড়াহুড়া নেই কোনো বাড়িতে। রমজানের কেনাকাটাও নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত। সামাজিক ও পারিবারিক পর্যায়ে নেই ঘটা করে কোনো ইফতারের আয়োজন। ঢাকার চকবাজার মসজিদের সামনে সড়কজুড়ে ঐতিহ্যবাহী চিরচেনা ইফতার সামগ্রীর পসরা নেই। বেইলি রোড, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, পল্টন, ধানমন্ডি এবং রমনা বাবুর্চিবাড়ির সামনের মাঠে এখন সুনসান নীরবতা। এসব স্থান ছাড়াও ঢাকাসহ বাংলাদেশে সর্বত্র রাস্তার পাশে ইফতারের পসরা নিয়ে বসেনি কোনো অস্থায়ী দোকান, নেই কোনো ক্রেতা। কল্পনাতীত এই পরিবেশ ও দৃশ্য মুসলমান সমাজ কখনো দেখেনি।

বিশ^ব্যাপী করোনাভাইরাসের সর্বাত্মক আক্রমণের এই কঠিন সময়ে পবিত্র রমজান মাস আমাদের জীবনে উপস্থিত হয়েছে। ইসলাম যে পাঁচটি মূল স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তার মধ্যে রোজা অন্যতম। মহান আল্লাহ মুসলিম বিশে^র সব মুসলমানের জন্য রোজাকে ফরজ করেছেন। পবিত্র কোরআন শরিফের বিভিন্ন আয়াতে রোজাকে ফরজ করার বিষয়টি বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। রোজার আধ্যাত্মিক, শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা সম্পর্কে মুসলমানদের অবহিত করা হয়েছে। রমজান সিয়াম সাধনার মাস। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস। এই মাস প্রতিটি মুসলমানের জন্য তাকওয়া অর্জন, আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযম লাভ করার অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করে। এ মাসে বেশি বেশি ইবাদত, কোরআন পাঠ ও দান-খয়রাত (জাকাত) দেওয়ার জন্য মুসলমানদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর সৃষ্ট ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি ভাইরাস (কভিট-১৯) সারা বিশ^কে ঘরে বন্দী করে রেখেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যার মিছিল ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোও এই ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে অসহায়। সব ধর্মের মানুষ বর্তমানে অসহায় অবস্থায় সৃষ্টিকর্তার মুখাপেক্ষী হয়ে আছে। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ পৃথিবীতে সর্বশেষ ধর্ম ইসলাম এবং মানুষের জন্য সম্পূর্ণ জীবন-বিধান ‘আল-কোরআন’ প্রেরণ করেছেন। বিজ্ঞানময় কোরআন শরিফে আল্লাহ পৃথিবীর রোগ ও মহামারী পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়েও মানবজাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। করোনার মতো মহামারীতে করণীয় সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করতে হলে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের মর্মবাণীর গভীরে প্রবেশ করতে হবে। অর্থসহ কোরআন ও হাদিস অধ্যয়নের মাধ্যমেই তা সম্ভব হবে। তাই সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য রোজার মাসে ঘরে অবস্থানকালে বাধ্যতামূলকভাবে বেশি বেশি করে কোরআন ও হাদিস পাঠের একটি উত্তম সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ।

রমজান মাস রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস। হিজরি সালের দ্বিতীয় বছরে মুসলমানদের কাছে রমজানের পুরো এক মাস (২৯/৩০ দিন) রোজা রাখার প্রত্যাদেশ আসে। রোজা পালনের মাধ্যমে বা সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে মুসলমানরা আত্মশুদ্ধি, নিয়মানুবর্তিতা, ধৈর্য, জীবনের শৃঙ্খলাবোধ, মানসিক শান্তি এবং নৈতিক মূল্যবোধে শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ পান। সারা দিন অভুক্ত থেকে গরিব-দুস্থ ও কর্মহীন মানুষের ক্ষুধার জ্বালা বাস্তবভাবে উপলব্ধির মাধ্যমে তাদের প্রতি সহানুভূতির বিবেক জাগ্রত হয়। যার ফলে মানুষের মধ্যে গরিবদের সাহায্য ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার আকাক্সক্ষা জন্ম নেয়। করোনা আগ্রাসনে দেশের নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া হতদরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ আজ কর্মহীন, বেকার। তারা বর্তমানে অত্যন্ত মানবেতর কাল কাটাচ্ছে। সমাজের বিত্তবান মানুষ এই হতদরিদ্রদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। তা হলেই আমাদের সিয়াম সাধনার প্রকৃত সার্থকতা খুঁজে পাব।

রোজা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পরকালের পুরস্কার লাভ ছাড়াও নিজের চরিত্র গঠন, আত্মোপলব্ধি, ধৈর্যধারণ, পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, মনের কালিমা মুক্তি, সুস্থ জীবনবিধান এবং নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে বিশাল ভূমিকা রাখে। বর্তমানে করোনা আক্রান্ত সমাজে ঘরে লকডাউন অবস্থায় এবারের রোজাকে যদি উল্লিখিত শিক্ষালাভের সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করা যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে নিজের, সমাজের ও দেশের কল্যাণ সাধিত হবে। রোজা পালন ও তার গভীর উপলব্ধি থেকে একজন মানুষ সৎ, যোগ্য এবং সময়োপযোগী চরিত্রের অধিকারী হতে পারেন। রোজা পালন ধর্মীয় নির্দেশ অনুযায়ী দৈনন্দিন জীবনের রুটিন বদলে যায়, বিভিন্ন সমাজবিরোধী কাজ থেকে বিরত রাখে ও আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের ভিত্তিমূল আরও সুদৃঢ় হয়। সব ধরনের কল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগের প্রত্যয় জোরদার হয়। বর্তমান করোনাভাইরাস আক্রান্ত সমাজে সচ্চরিত্রের মানুষের অভাব সবাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। একজন ধর্মপ্রাণ সচ্চরিত্রবান মানুষের পক্ষে বর্তমান মহাবিপর্যয়ের সময়ে ক্ষুধার্ত মানুষের চাল চুরি করা সম্ভব হতো না। শুধু ক্ষণিকের লাভের জন্য নিম্নমানের পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুয়েপমেন্ট (পিপিই) সরবরাহ করা সম্ভব হতো না। নিম্নমানের মাস্ক আমদানি করা বা ব্যবহৃত মাস্ক বাজারজাত করার অভিপ্রায় জন্মাত না। একজন সচ্চরিত্রের মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে তা গোপন করতে পারত না। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরি করা হতো না। এটা অনস্বীকার্য যে, সমাজে এই ধরনের অসৎ ও সমাজবিরোধী মানুষের জন্য বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে করোনা মোকাবিলায় বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

রোজা একজন মানুষকে আত্মোপলব্ধি (Self Reflection) করতে সাহায্য করে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সকলে তার ভয়াবহতা চিন্তা করে নিজের আত্মোপলব্ধি থেকেই নিজেকে লকডাউন করে রাখা জরুরি। ঘরে থকে নিজেকে এবং অপরজনকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা করাই কর্তব্য। যা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, এই আত্মোপলব্ধির অভাবে আজকে বাংলাদেশের মানুষকে ঘরে আটকে রাখার জন্য সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনীকে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাতে হচ্ছে। রোজার এই শিক্ষাকে অর্থাৎ আত্মোপলব্ধিকে জাগ্রত করে প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্বে ঘরে অবস্থান করে করোনা থেকে দূরে থাকা অতীব জরুরি।

রোজার অপর একটি শিক্ষা হচ্ছে, সব পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণ করা। লকডাউনের বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, মানুষ ঘরে বসে থাকতে থাকতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। ঘর থেকে বাইরে চলে আসার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করা খুবই জরুরি। তা না হলে, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এ মহামারী ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। পবিত্র কোরআন শরিফে আল্লাহ বলেছেন, ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদের কিছু ভয়, ক্ষুধা, জানমালের ক্ষতি এবং ফলফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে পরীক্ষা করব। তবে তুমি ধৈর্যশীলদের জান্নাতের সুসংবাদ দাও’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৫৫)। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে পবিত্র কোরআনের আলোকে এবং রোজার শিক্ষা অনুসরণ করে আমাদের সামনে ধৈর্যধারণ করা ব্যতীত অন্য কোনো পথ খোলা নেই।

পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা রোজা পালনের মাধ্যমে আমরা অর্জন করে থাকি। রোজা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গতিধারায় আমূল পরিবর্তন আনে। একজন রোজাদার পরিবর্তিত এই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়। বর্তমান করোনা আক্রান্ত বিশ্ব একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। পৃথিবীতে মানুষ এ ধরনের লকডাউন পরিস্থিতি কখনো কল্পনা করতে পারেনি। কোনো বিশ্বযুদ্ধে সারা বিশ্বের মানুষকে ঘরে বন্দী রাখার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। তাই বর্তমান মুসলমান বা অন্য ধর্মের মানুষের এই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

রোজা মানুষকে (রোজাদারকে) সব ধরনের পাপাচার ও অনাচার থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। সারা বিশ্ব আজ পাপের রাজত্বে পরিণত হয়েছে। একজনের ওপর আরেকজনের, এক দেশের ওপর আরেক দেশের আধিপত্য ও দাদাগিরি প্রতিষ্ঠায় বিশ্ব এক বিধ্বংসী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে। সে জন্য বিশ্বশান্তি ও বিশ্ব মানবতা ধ্বংসের কিনারায় উপনীত হয়েছে। সমাজে পাপাচার, দুর্নীতি, চোরাকারবারি, লুণ্ঠন, জননিরাপত্তাহীনতা, মানবাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে পচন ধরেছে। সারা বিশ্বে বর্তমানে করোনার ভয়ে লকডাউন থাকায় এসব সমাজবিরোধী অনেক কাজ বন্ধ রয়েছে। পবিত্র কোরআন শরিফে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি বহুজনপদকে ধ্বংস করেছি যার অধিবাসীরা ছিল জালেম। অতঃপর সৃষ্টি করেছি অন্য জাতি’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-১১)। সমাজকে সব ধরনের সমাজবিরোধী কাজ থেকে বিরত করতে হলে পবিত্র কোরআনের আলোকে এবং রমজানের শিক্ষা অবলম্বনে সমাজকে বদলাতে হবে। রোজা মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা ও ভালোবাসা সৃষ্টি করার শিক্ষা দেয়। রোজার মাধ্যমে একজন মানুষ তার মনের যত কালিমা আছে, তা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে সক্ষম হয়। মুসলমানরা একই দিনে একই পদ্ধতিতে সারা দিন অভুক্ত থেকে প্রথমে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসা এবং সারা মুসলিম জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এই ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা ও ভালোবাসা সারা বিশ্বে যে বৈষম্য, নির্যাতন-নিপীড়ন, অন্যায় ও অনাচার চলছে, তা থেকে রক্ষা করতে পারে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্ব  নেতারা একে অপরকে সহযোগিতা করার জন্য ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বের সব দেশকে একত্রে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা ও ঐক্য সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা রোজা রাখার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ও বাণীর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।

সারা বিশ্বে বর্তমানে একটা অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, মিডিয়াকর্মী ও নিরাপত্তা বাহিনীসহ প্রশাসন সম্মুখযুদ্ধ ক্ষেত্রে যুদ্ধরত। তারা জীবনবাজি রেখে করোনাভাইরাস সংক্রমণকে ঠেকানোর জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছে। যারা স্বাস্থ্য অধিদফতর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশাবলি মেনে ঘরে আবদ্ধ রয়েছে, তারাও করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধ করার কাজে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। যারা ঘরে বসে অলস জীবন কাটাচ্ছেন, তারা নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক প্রভাবের শিকার হচ্ছেন। রমজান উল্লিখিত প্রভাব থেকে মুক্তিলাভের একটি পথ হতে পারে। রোজা সুস্থ জীবন-দর্শন নিশ্চিত করে এবং মানসিক প্রশান্তি (নৈতিক মূল্যবোধ) সৃষ্টিতে সহায়তা করে। পবিত্র কোরআনের সূরা আল-বাকারার আয়াত-১৮৪ এর শেষাংশে বর্ণিত আছে, ‘(অবশ্য) তোমরা যদি রোজা রাখতে পার (তাহলে) সেটা তোমাদের জন্য ভালো; যদি তোমরা (রোজার উপকারিতা) সম্পর্কে জানতে পারতে।’ ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উপকারিতা বলতে ইহকাল ও পরকালের মঙ্গলের কথা বলা হয়েছে। ইহকালের উপকারিতা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছে। রোজা পালনে মানুষের শারীরিক ও মানসিক কী পরিমাণ উপকারিতা আছে তা নির্ণয় করেছেন।

জাপানি চিকিৎসাবিজ্ঞানী ওশিওমি ওহসুমি রোজা বা উপবাসকালে, অনশনকালে মানুষের দেহে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আত্মরক্ষণ ও পূর্ণাঙ্গ পুনর্গঠন কাজে ‘অটোফেজি’ প্রক্রিয়ার আবিষ্কার করেন। তার এই আবিষ্কার মানুষের রোগব্যাধির প্রতিষেধক হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করে এবং ২০১৬ সালে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তার গবেষণা মতে, আমাদের শরীরের কোষগুলো সারা দিন খাদ্য না পেয়ে ক্ষুধার্ত অবস্থায় শরীরের মৃত, অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকারক কোষগুলো খেয়ে ফেলে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ প্রক্রিয়ায় নতুন কোষের সৃষ্টি করে এবং দেহের অভ্যন্তরে জমে থাকা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস ধ্বংস করে দিতে সাহায্য করে। এই প্রক্রিয়ায় রোজা মানবদেহে নতুন ও প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে এবং মানবদেহকে পূর্ণাঙ্গ পুনর্গঠন করে। মানুষের তৈরি যে কোনো যন্ত্র চালু রাখার জন্য যেভাবে সার্ভিসিং এবং ওভারহোলিং করতে হয়, তেমনিভাবে রোজা মানবদেহের যন্ত্রেরও সার্ভিসিং ও ওভারহোলিং করে। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা রোজার মাধ্যমে মানবদেহের বিভিন্ন ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে উপকারিতা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, রোজার প্রভাবে মস্তিষ্কের সক্রিয় কোষ মৃত কোষকে খেয়ে বা ধ্বংস করে মস্তিষ্ককে সুরক্ষা করে এবং এর ফলে দুশ্চিন্তা ও হতাশা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। এমতাবস্থায় রোজা আমাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা লাভে বিশাল অবদান রাখে। লকডাউন অবস্থায় অত্যন্ত প্রশান্ত চিত্তে রোজা পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের সঙ্গে সঙ্গে সব মুসলমান শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ জীবনের আস্বাদ লাভ করতে পারেন।

করোনা আতঙ্কে সারা বিশ্ব লকডাউন থাকার কারণে মানুষ আজ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক, অনিদ্রা ও মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে। বিশ্বের সব মুসলমান এই দুর্যোগকালে রোজা এবং তার আনুষঙ্গিক কর্ম যেমন- কোরআন পাঠ, বেশি বেশি ইবাদত ও জাকাত প্রদানের মাধ্যমে শারীরিক সুস্থতা এবং মানসিক শান্তি লাভের সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। মুসলমানরা বিশ্বাস করে, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ বিপদ-আপদ, মহামারী দিয়ে মানবজাতিকে পরীক্ষা করেন, সতর্ক করেন এবং তার থেকে মুক্তিও দান করেন। করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের সেবা লাভের পাশাপাশি সব দেশের মানুষকে তাদের পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা আবশ্যক। এই বিধ্বংসী করোনাভাইরাস থেকে বিশ্ববাসীর মুক্তির জন্য পরম করুণাময়ের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন। 

লেখক : সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি-বিএনপি এবং সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ভূ-তত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর