মঙ্গলবার, ৫ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা আক্রান্ত বাংলাদেশ : কতিপয় অর্থনৈতিক ভাবনা

মাহবুব আহমেদ

করোনা আক্রান্ত বাংলাদেশ : কতিপয় অর্থনৈতিক ভাবনা

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১০ হাজার অতিক্রম করেছে। মাত্র এক মাসের লকডাউনেই বিপুলসংখ্যক খেটে খাওয়া মানুষ তাদের নিত্যদিনের অন্নসংস্থানের জন্য ভোগান্তিতে পড়েছে। সরকার, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, ব্যক্তিগত উদ্যোগে নানাভাবে বিপুল পরিমাণে ত্রাণ দেওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের দুর্দশা লাঘব করা যাচ্ছে না, মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না। শুরু হয়েছে জীবন ও জীবিকার গুরুত্ব নিয়ে বিতর্ক। এ বিতর্ক অর্থহীন। জীবন না বাঁচলে যেমন জীবিকা অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে, তেমন জীবিকাবিহীন জীবন বাঁচানোও সম্ভব নয়। জীবন ও জীবিকার সম্পর্ক অচ্ছেদ্য, একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি অর্থহীন। তাই জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে সঠিক কাক্সিক্ষত কৌশল গ্রহণ করতে পারাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির প্রায় ৪০ শতাংশই আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক সহায়তার সূত্রে বিদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই করোনা মহামারীর বিশ্বব্যাপী অভিঘাত বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর নানাভাবেই পড়তে বাধ্য এবং পড়া শুরুও করেছে। রপ্তানি, আমদানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ, পর্যটন শিল্প, রেমিট্যান্স, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি, রেভিনিউ ইত্যাদির ওপর করোনাভাইরাসের অভিঘাত এখনই দৃশ্যমান। রপ্তানি খাতে বেশ কিছু দিন ধরে সমস্যা যাচ্ছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বিগত বছরের তুলনায় রপ্তানি ৪.৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ সময়ে তৈরি পোশাকশিল্পের রপ্তানি কমেছে ৫.৫ শতাংশ। করোনা আক্রমণের পর সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি পোশাক খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে বলে জানা গেছে। আমদানিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রায় সাত মাসে আমদানির বিপরীতে মূল্য পরিশোধ ২.২ শতাংশ কমে গেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হ্রাস পাওয়ার পরিমাণও উল্লেখযোগ্য। চীন থেকে কাঁচামাল না আসায় অনেক কারখানা তালাবদ্ধ করতে হয়েছে। তবে আমদানি হ্রাসের তুলনায় রপ্তানি আয় হ্রাস অধিকতর হওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে দাঁড়িয়েছে (-)৮.২ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছর থেকে দশমিক ৪ বিলিয়ন বেশি। বিডাসূত্রে জানা গেছে, বিগত তিন মাসে বাংলাদেশে কোনোরূপ বৈদেশিক বিনিয়োগ আসেনি। জি-২০-এর এক ঘোষণায় জানা গেছে, করোনা আক্রমণের কারণে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নœত দেশগুলো প্রায় ৮৩ হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। রাজস্ব ঘাটতি বাড়বে বলেই মনে হয়। গত বছরের ৮৭ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির বিপরীতে এ বছরের ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে কোনো কোনো থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আভাস দিয়েছিল। প্রথম আট মাসে ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। করোনার কারণে এ ঘাটতি আরও বাড়তে পারে বলে অনেকেই মনে করছে। ব্যবসায়ী মহল থেকে ইতিমধ্যে নানারূপ কর সুবিধা দেওয়ার দাবি আসছে, যার মধ্যে অনেকটিই যৌক্তিক কারণে দিতে হবে। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কেনাকাটার কারণে কোনো কোনো অঞ্চলে সাময়িক মূল্যস্ফীতি ঘটেছিল, তা আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, কোনো কোনো খাদ্যপণ্যের (শাকসবজি) দাম ক্রেতার অভাবে শহরাঞ্চলে বেশ হ্রাস পেয়েছে। খাদ্যশস্যের মজুদ যথেষ্ট থাকায় এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। মার্চের ২৬ তারিখ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগ পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল বেশ উদ্দীপনামূলক। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এ খাতে +২১.৫ শতাংশের প্রবৃদ্ধি সত্যিকার অর্থেই প্রশংসনীয়। তবে এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে, আমাদের রেমিট্যান্সের দুই-তৃতীয়াংশ আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। করোনা মহামারীর কারণে জ্বালানি তেলের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে, মূল্যও কমেছে বেশ। তাই মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে কর্মীর চাহিদা হ্রাস পেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

ইতিমধ্যে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেছেন করোনাভাইরাসের তা-বলীলা বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার মধ্যে নিয়ে ফেলবে। এ বক্তব্যের সমর্থনে নানাবিধ ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছিল। স্টক মার্কেটে ধস নামেনি এরূপ বাজার খুঁজে পাওয়া ভার। মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ, ২০২০ সময়ে বিশ্ব স্টক শেয়ারবাজার মূল্য ২৩ ট্রিলিয়ন হ্রাস পেয়েছে বলে জানা যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) থেকে সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে যে, সরকারগুলো এখনই সচেতন না হলে বিশ্ব থেকে ২৫ মিলিয়ন চাকরি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, করোনা আক্রমণের কারণে আমাদের জিডিপি থেকে ৩.০২ বিলিয়ন ডলার হারিয়ে যেতে পারে, বিলুপ্ত হতে পারে প্রায় ৯ লাখ চাকরি। বিশ্ব অর্থনীতিতে ইতিমধ্যে মন্দা শুরু হয়েছে মর্মে আইএমএফ ঘোষণা করেছে।

কভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকার ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কভিড মোকাবিলার জন্য স্বাস্থ্য খাতে বাড়তি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারিত হয়েছে। খোলাবাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিক্রির কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকার অনেক আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য স্বল্পসুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হয়েছে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশন্সের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট শিল্প, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ এ ঋণ দেবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। প্রদত্ত ঋণের সুদের অর্ধেক অর্থাৎ ৪.৫০ শতাংশ ঋণগ্রহীতা শিল্প, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৪.৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে পরিশোধ করবে। একইভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ব্যাংকব্যবস্থার মাধ্যমে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হারও হবে ৯ শতাংশ। ঋণের সুদের ৪ শতাংশ ঋণগ্রহীতা শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। এলসির মাধ্যমে কাঁচামাল আমদানি সুবিধার লক্ষ্যে ইডিএফের বর্তমান আকার ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করা হয়েছে। ফলে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অতিরিক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ইডিএফ তহবিলে যুক্ত হবে। ইডিএফের বর্তমান সুদহার  LIBOR+১.৫ শতাংশ (যা প্রকৃতপক্ষে ২.৭৩%) থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করার বিষয়েও বলা হয়েছে। পাশাপাশি, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণ সুবিধা চালু করবে। এ ঋণ সুবিধার সুদহার হবে ৭ শতাংশ। এ ছাড়া রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিফাইন্যান্স স্কিমের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে। এ অর্থের মাধ্যমে রপ্তানি খাতের শ্রমিকদের তিন মাসের মজুরি পরিশোধ করা সম্ভব হবে। এতে ৪০ লাখ শ্রমিক উপকৃত হবে। অধিকন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গৃহহীনদের ঘর প্রদান বাবদ ২১.৩ বিলিয়ন, কর্মহারাদের জন্য ৭.৬ বিলিয়ন, কভিড মোকাবিলায় কর্মরত সরকারি কর্মীদের স্বাস্থ্যবিমা বাবদ ৭.৫ বিলিয়ন এবং ডাক্তার ও কভিড টেস্টের সঙ্গে জড়িত কর্মীদের বোনাস বাবদ ১ বিলিয়ন টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন।

ব্যাংকব্যবস্থার তারল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে রক্ষিত ট্রেজারি বিল ও বন্ড কেনার ঘোষণা দিয়েছে। রেপো হার ও দৈনিকভিত্তিক সিআরআর বেশ খানিকটা কমানো হয়েছে। ঋণ-আমানত ও বিনিয়োগ-আমানত অনুপাত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়বে ও ব্যাংকব্যবস্থায় তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে কয়েকটি পুনরর্থায়ন স্কিম চালু করেছে, যার মাধ্যমে রপ্তানি খাত ও কৃষক উপকৃত হবে এবং এগুলো সরকারের অর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নেও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সরকারের আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজসমূহ ও অন্যান্য প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও করোনার আর্থ-সামাজিক অভিঘাত মোকাবিলার সাফল্য নিয়ে অনেক সংশয় রয়েছে। তবে এত ঋণাত্মক ভাবনার পরও আমাদের অর্থনীতি নিয়ে বেশ কিছু ধনাত্মক ভাবনার অবকাশ রয়েছে- আমাদের খাদ্য আমরা নিজেরাই উৎপাদন করি, খাদ্যের জন্য কারও ওপর আমরা নির্ভরশীল নই। এ বছরও বাম্পার ধান উৎপাদন হয়েছে, যা অচিরেই কৃষকের গোলায় উঠবে। মাছ, মাংস, সবজির উৎপাদনও স্বাভাবিক আছে। পণ্য ও কাঁচামাল আমদানির জন্য আমরা মূলত চীন ও ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ভারতে করোনার আক্রমণ সহনীয় মাত্রায়। চীনে আক্রমণ প্রথম শুরু হলেও তা ইতিমধ্যে নিয়ন্ত্রণে এসেছে, অচিরেই চীনের সঙ্গে বাণিজ্য কার্যক্রম পুনঃ স্থাপিত হবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য কার্যক্রম ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।

আমাদের পণ্য মূলত রপ্তানি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (১৭ শতাংশ) এবং ইউরোপে। এর মধ্যে জার্মানি (১৫.২ শতাংশ), যুক্তরাজ্য (১০.২ শতাংশ) ও স্পেন (৬.৩ শতাংশ) প্রধান। ইউরোপের বাজারের অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে শক্তিশালী মার্কিন অর্থনীতিতে যত জোরেই ধাক্কা লাগুক না কেন, তা তারা কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে হয়। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে হয়তো মুদ্রানীতির সহায়তা নিতে হতে পারে। ডলার বিশ্বের সব দেশের কাছে আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য মুদ্রা। বর্তমান যুগে ডলারও যেহেতু Fiat মুদ্রা, তা ছাপানো যেমন কোনো কষ্টসাধ্য বিষয় নয় এবং তার সরবরাহ বাড়ানোও কোনো সমস্যা নয়। যুক্তরাষ্ট্র করোনা-উত্তর সময়ে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতিই গ্রহণ করবে বলে ধারণা করে নেওয়া যায়। ডলারের চাহিদা যেহেতু সর্বব্যাপী, অতিরিক্ত ডলারের সরবরাহের কারণে মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাই ডলাারের সরবরাহ বাডিয়ে পণ্য আমদানির সুবিধা যুক্তরাষ্ট্র যে নেবে, তা ধরে নেওয়া যেতে পারে। তাই সাময়িক অসুবিধায় পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি কমার আশঙ্কাও প্রায় নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্রে আমরা যেসব পণ্য রপ্তানি করি তা Income Inelastic পণ্য। আয় হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কহীন। তা ছাড়া ওই দেশে আমাদের মোট রপ্তানির পরিমাণ ওই দেশের মোট আমদানির একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। তা সত্ত্বেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত TICFA (Trade and Investment Co-operation Forum Agreement) চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের জন্য আলোচনার উদ্যোগ নিতে পারে।

বাংলাদেশ যদি সামনের দুটি সপ্তাহ এভাবে পার করে দিতে পারে তবে অনেক দেশ থেকেই পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস ইত্যাদি পণ্যের চাহিদা মোতাবেক সরবরাহের অনুরোধ আসতে পারে। এ-জাতীয় কিছু কিছু ইঙ্গিত পাওয়াও যাচ্ছে।

করোনা নিয়ে এত ভয়-ভীতি শঙ্কার মধ্যেও প্রকৃতি ও জীবন থেমে নেই। প্রতিদিনই সূর্য উঠছে, বাগানে ফুল ফুটছে, পাখি গান গাইছে, মানুষও আহার গ্রহণ করছে, নিদ্রা যাচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। যথাসময়ে জাতীয় বাজেট ঘোষিত হবে। নভেল করোনাভাইরাস আক্রান্ত এই অস্থির উদ্দান্ত সময়ের বাজেট প্রণয়নের সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা যেতে পারে-

অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি করার জন্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ৭০-৭৫ শতাংশই আসে অভ্যন্তরীণ ভোগ থেকে।

কর্মসংস্থান করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকল্প/কর্মসূচি গ্রহণ করে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ সৃষ্টি করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা সম্প্রসারণ করতে হবে। দু-এক বছরের জন্য রেশন কার্ড ব্যবস্থা চালু করে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জন্য খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। সরকারি গুদামের ধারণ ক্ষমতার ১০০% ব্যবহার করে সরকারি খাদ্য মজুদ গড়ে তুলতে হবে। তাত্ত্বিকভাবে প্রথমে সরকারি ব্যয় নির্ণয় করে বাজেটে কর ধার্যের মাধ্যমে আয় করা হয়। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল/স্বল্পোন্নত দেশে সরকারি আয় পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে বাজেট ব্যয়ের পরিমাণ নির্ণীত হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রথমে ব্যয় নির্ণয় করে তারপর আয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এ ব্যয় সংগ্রহ করা সম্ভবপর হবে না বলেই মনে হচ্ছে। তাই এ বছরের বৈদেশিক সহায়তার দিকে বেশি নজর দিতে হবে। এখনই বিশ্বব্যংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, এআইআইবি, আইডিবি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈদেশিক সহায়তার জন্য যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে হবে। এ বছরের সম্ভাব্য ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি ও ঘাটতি বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে Public Money and Budget Management Act, 2009 পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির ব্যবস্থা এমনভাবে নিতে হবে যাতে করে মূল্যস্ফীতি, সুদের হার ও বিনিময় হারের মধ্যকার ভারসাম্য বিনষ্ট না হয়। সরকার-ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজগুলো যাতে যথাযথভাবে সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। এ প্রণোদনার উপকারভোগী নির্বাচনের নীতি-কৌশল দ্রুতই প্রকাশ করা প্রয়োজন। ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ মোট ৫০ হাজার কোটি টাকা নিজস্ব তহবিল থেকে প্রদান করতে হবে বিধায় এ ঋণ প্রদানে তহবিল সংগ্রহের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নীতিগত সহায়তা প্রদান করতে হবে। প্রণোদনার আওতায় প্রদত্ত ঋণ অনাদায়ের ঝুঁকি পুরোটাই ব্যাংকগুলোর ওপর বর্তালে প্যাকেজগুলো বাস্তবায়ন কঠিন হবে। এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। আশা করি, শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিগত দশকের মতো সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে করোনা-উত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতি সামনে এগিয়ে যেতে পারবে।

লেখক : সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক।

সর্বশেষ খবর