মঙ্গলবার, ৫ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

বরং জামায়াতে ইসলামীই প্রকাশ্যে আসুক

এফ এম শাহীন

যুদ্ধাপরাধীদের আইনজীবী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক প্রবাসে বসে জামায়াত থেকে পদত্যাগ করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছিলেন ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তবে আমরা ভুলিনি এই রাজ্জাক যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য বিগত সময়ে কী ধরনের ভূমিকা রেখেছিলেন। বিগত সময়ে যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়ের পর পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, জামায়াতের কলকাঠি এখনো পাকিস্তানে। রাজ্জাকের এই পদত্যাগ যে নতুন মোড়কে পুরনো জামায়াতকে বাঁচানোর পাকিস্তানি প্রেসক্রিপশন, তাও দিনে দিনে স্পষ্ট হবে বলে মনে করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর ‘সংস্কারপন্থিরা’ নতুন প্ল্যাটফরম গঠনের এক বছর পর ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি (এ বি পার্টি)’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। গত শনিবার সকালে বিজয়নগরে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের নাম ঘোষণা করেন এক বছর আগে ‘জন-আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ’ নামে গঠিত ওই প্ল্যাটফরমের সমন্বয়ক বহিষ্কৃত জামায়াত নেতা মুজিবুর রহমান মঞ্জু। নতুন দলের নাম ঘোষণার পাশাপাশি ২২২ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করা হয়েছে সংবাদ সম্মেলনে। এ দলের আহ্বায়ক হিসেবে আছেন জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগকারী এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরী, যিনি একজন সাবেক সচিব। আর ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মঞ্জু এ কমিটির সদস্যসচিব।

সংবাদ সম্মেলনে মঞ্জু বলেন, ‘সমালোচকদের তির্যক ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে আমরা ঘোষণা করছি, আজ থেকে আমাদের দলের নাম ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ - এ বি পার্টি। যে নামটি এসেছে রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমের একটি বই থেকে। অনেকের ধারণা, জামায়াতের সম্পদ ও নেতা-কর্মীদের নতুন আশ্রয় হবে এই সংগঠন। এই মহামারী আর সংকটে জামায়াত-ফেরত নেতাদের এমন ধৃষ্টতা আওয়ামী লীগ সরকারকে লজ্জায় ফেলতে না পারলেও তরুণ প্রজন্মকে ক্ষুব্ধ করেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন ১১ দফাসহ বিভিন্ন দাবির বিরোধিতা করে জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামে বিভিন্ন দল গঠন করে। তারা সারা দেশে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মতো যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এ পর্যন্ত ঘোষিত ছয়টি রায়েই বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

আমরা বারবার বলে এসেছি, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে জামায়াতে ইসলামীর মতো যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী একটি দল এভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর অধিকার রাখে না।

বিশ্ব ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাব, যেসব সংগঠন গণহত্যা পরিচালনা করেছিল, সেগুলো যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গণ্য হয়েছে। আর প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী কোনো সংগঠন এমনিতেই অবৈধ হয়ে যায়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জার্মানিতে নাজি পার্টিকে এবং বর্ণবাদী কাজকর্মের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান নামের একটি পার্টিকে অনন্তকালের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সন্ত্রাসী কাজকর্ম পরিচালনার জন্য চিরতরে নিষিদ্ধ হয়েছে হিযবুত তাহরির ও হরকাতুল জিহাদের মতো সংগঠন। জামায়াতে ইসলামী কোনো রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। যদি আলকায়েদা বা তালেবানের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনকে বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ করা হয়, তবে জামায়াত কেন নয়? কিন্তু সত্য হলো, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রায় প্রতিটি রায়ের পর্যবেক্ষণেই জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন (ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন) হিসেবে উল্লেখ করলেও দলটি নিষিদ্ধের উদ্যোগ নেই সরকারের। দল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতাকারী সংগঠন জামায়াত ও তার সব সহযোগী সংগঠনকে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩ সংশোধনের খসড়া প্রস্তুত থাকলেও অদৃশ্য কারণে তা প্রায় পাঁচ বছরেও মন্ত্রিসভায় ওঠেনি। সবার কাছে আজ পরিষ্কার, প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার নামে টালবাহানা করছে।

তাই এই প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি, গণজাগরণের একজন কর্মী হিসেবে আমি চাই রাজাকারের বাচ্চারা প্রকাশ্যে আসুক। আমরা জানি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিগত ১২ বছরে যে পরিমাণ জামায়াত-শিবির ও স্বাধীনতা-বিরোধীকে পুনর্বাসন করে মুক্তিযুদ্ধের বীরদের স্বপ্নের বাংলাদেশের যে ক্ষতি করেছে তা আর পূরণ হওয়ার নয়। বিএনপির সঙ্গে থেকেও তারা রাষ্ট্রের এতটা ক্ষতি করতে পারেনি। আজ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জামায়াত -হেফাজতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয়। তাই তারা প্রকাশ্যে আসাই আগামী প্রজন্মের জন্য ভালো। কারণ তারা স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে চিনতে পারবে, জানতে পারবে। এমন সময় তাদের আত্মপ্রকাশের ঘোষণা যা আমাদের নতুন করে ভাবনার খোরাক জোগায়, কে বা কারা শক্তি দিচ্ছে তাদের, করছে সহযোগিতা? এ খেলায় কারা জড়িত? উত্তর জানা খুব জরুরি।

ভুলে যাইনি, বিএনপি, জাতীয় পার্টির ঘাড়ে পাড়া দিয়ে অবস্থান তৈরি করা এই সন্ত্রাসী সংগঠন আজ তলে তলে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে পা রেখেছে। আওয়ামী লীগের ভোগ-উপভোগ আর সম্ভোগে ব্যস্ত থাকা নেতারা আজ তাদের কাছে বন্দী। ২০১৩ সালের গণজাগরণের সফলতা ঘরে তুলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকলেও গণজাগরণ-যোদ্ধাদের সব দাবিকে তুচ্ছ করে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেনি। বরং তাদের দলে ও সরকারে পদ-পদবি দিয়ে, চাকরি, ব্যবসা দিয়ে এবং রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের পতাকা বিক্রি করে তাদের নব্যরূপে পুনর্বাসন করেছে। ৩০ লাখ শহীদ ও জাতির পিতার আদর্শের সঙ্গে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করেই চলেছে বাংলাদেশ সৃষ্টির মহান ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ! যেহেতু এই যুদ্ধাপরাধী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা সরকার বা আওয়ামী লীগের ইচ্ছা নেই, তাই বলব, যে নামেই আসুক না কেন স্বাধীনতাবিরোধী আদর্শের কর্মীদের প্রকাশ্যে আসতে দেওয়া হোক। অন্তত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান এই প্রজন্মের সবাই তাদের চিনতে পারবে। পাকি আদর্শে জন্ম নেওয়া নব্য রাজাকারদের জানতে পারবে তারা এবং পূর্বপুরুষের রক্তাক্ত লড়াইয়ের গৌরব নিয়ে আগামীর জন্য প্রস্তুত হবে।

লেখক : সম্পাদক, ডেইলি জাগরণ সাধারণ সম্পাদক, গৌরব ’৭১সংগঠক গণজাগরণ মঞ্চ।

সর্বশেষ খবর