শুক্রবার, ৮ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীগণ অবিচল আস্থা ও আনুগত্যের বন্ধন

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীগণ অবিচল আস্থা ও আনুগত্যের বন্ধন

করোনাকালের এই দুঃসময়ে ঘরে অবরুদ্ধ। এ যেন এক অন্য জীবন! জনস্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত রাখতেই এই লকডাউন। এই স্বেচ্ছাবন্দিত্ব আর সামাজিক দূরত্ব এক অর্থে পরিবার তথা স্ত্রী-সন্তানদের কাছে দিনের সবটুকু সময় থাকার এক অপ্রত্যাশিত সুযোগও বটে। সেই সঙ্গে ভাবনাগুলো ঘুরে ফিরছে ফেলে আসা দিনগুলোয়। অনেক অনেক ভাবনাকে লকডাউনে রাখতে পারছি না। ইতিহাসের অনেক পাতায় ফেলে আসা দিনের অনেক ঘটনা সামনে আসছে। ১৯৭১-এর এপ্রিলে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের একটি অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব আর তাঁর নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আনুগত্যই এ অধ্যায়ের জন্ম দেয়। সেই অধ্যায় পরিশেষে সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের নিয়ে আসে মুক্তির স্বাদ আস্বাদনে। আবার এও দেখেছি, নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা অন্য এক আঁধার সৃষ্টি করে। দুটোই আমাদের অভিজ্ঞতায় রয়েছে। কোয়ারেন্টাইনে থাকা এই মে মাসের একটি দিনে আজ ফিরে যাই ১৯৭১-এর মার্চ-এপ্রিলে এবং তার পরের সময়ে। আমার আজকের ভাবনাগুলো মূলত ইতিহাস থেকেই আহরিত।

১৯৭১-এর ২৪ মার্চ সাংবাদিকরা জানতে চান জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনায় কতটুকু অগ্রগতি হলো। বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেন- ‘হবে জয় হবে জয়, হবে জয়, মানবের তরে, মাটির পৃথিবী দানবের তরে নয়।’ সাংবাদিকরা আরও জানতে চান জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু কিছু বলবেন কিনা। বঙ্গবন্ধু উত্তরে আবৃত্তি করেন,

নাগিনীরা দিকে দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস

শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-

বিদায়ের আগে তাই ডাক দিয়ে যাই

দানবের সঙ্গে যারা সংগ্রামের তরে,

প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।

(সূত্র : এখানে থেমোনা-আনিসুল হক)

২৪ থেকে ২৫ মার্চ, ১৯৭১ রাতের প্রথম প্রহর অবধি অনেকে আসেন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, কর্নেল (পরবর্তীতে জেনারেল) আতাউল গণি ওসমানী, ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ এবং আরও অনেকেই। এমনকি আসেন কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফও। তাঁর বাড়ি কিশোরগঞ্জ। তাঁদের কেউ কেউ বলছিলেন- ‘বঙ্গবন্ধু! পাকবাহিনী আজ কালই আক্রমণ করবে, কিছু একটা করুন।’ কবি বলছেন ‘রেডিও টেলিভিশন আমাদের নিয়ন্ত্রণে আপনি স্বাধীনতা ঘোষণা করুন।’ সবার কথার উত্তর বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের গহিনে ছিলই। তিনি সবার উদ্বেগেরই উত্তর দিয়েছেন।

ইতিপূর্বে জনাব তাজউদ্দীন আহমদকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণার একটি ইংরেজি খসড়া দিতে। এ খসড়াটি পেয়ে বঙ্গবন্ধু তা অনুমোদন করেন। এরপর প্রকৌশলী নূরুল হকের ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের মানুষ জানতে পারে মুক্তির বার্তাটি। তৎকালীন ইপিআর ও আরও যাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর বার্তাটি প্রথম পৌঁছেছিল তারাও তাদের মতো করে এ বার্তাটি চারদিকে ছড়িয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল, আমীর-উল ইসলাম তাজউদ্দীন আহমদের বাড়ি থেকে একটি জিপযোগে অজানার উদ্দেশে যাত্রা করেন। আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা যার যার মতো করে আত্মগোপনে যান। সুরক্ষিত থেকে নেতার নির্দেশনা অনুযায়ী সবকিছু এগিয়ে নিতে। তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ২৭ মার্চ ঝিনাইদহ পৌঁছান। সেখানে তখন এসডিও ছিলেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবং এসডিপিও ছিলেন মাহবুব উদ্দিন আহমদ। এ দুজনের সহায়তায় জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলাম ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছান।

এরপর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২ এপ্রিল জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। (সূত্র : বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-এইচ টি ইমাম)। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর মামলা নম্বর আইসিটি বিডি কেস নম্বর ০৪/২০১৩ (চিফ প্রসিকিউটর বনাম সৈয়দ মো. কায়সার) মামলায় ১ নম্বর সাক্ষী কাজী কবির উদ্দীন ও ৪ নম্বর সাক্ষী মোহাম¥দ আলী পাঠান তাদের সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন যে, ৩ এপ্রিল, ১৯৭১ মেজর খালেদ মোশাররফ তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার্স বাংলোয় আসেন এবং সেখানে মেজর শফিউল্লাহ, মেজর জিয়া, মেজর আবু ওসমান চৌধুরীসহ অনেক বাঙালি সামরিক অফিসার একত্রিত হন। তাঁরা সেখানে ৪ এপ্রিল একটি সভা করেন। এ সভায় স্থানীয় এমএনএ ও এমপিএরা উপস্থিত ছিলেন। এ সভাতেই তিনটি ফোর্স গঠনসহ মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত ও সুগঠিত করার সিদ্ধান্ত হয়। মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর বই ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ (ভাষান্তর : ছিদ্দিকুর রহমান) : উল্লিখিত সাক্ষ্যের বক্তব্যকে অনুসমর্থন করা হয়েছে।

জেনারেল শফিউল্লাহ তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন- ৪ এপ্রিল, ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স¥রণীয় দিন। জেনারেল শফিউল্লাহর ভাষায় ‘একটি মহিমান্বিত সমাবেশ’। এদিন তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বহু উচ্চপদস্থ বাঙালি সামরিক অফিসারের আগমন ঘটে। কর্নেল এম এ জি ওসমানী ও পূর্বে উল্লিখিত অন্য বাঙালি সামরিক অফিসার ছাড়াও সেখানে আসেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ভি সি পা-ে ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. সায়গল। বেসামরিক রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী এমএনএ উপস্থিত হন। দফতরপ্রধান মেজর শফিউল্লাহ তাদের স্বাগত জানান এবং কর্নেল ওসমানীর সভাপতিত্বে এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

৪ এপ্রিলের সে সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, মুক্তিযুদ্ধ একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পরিচালিত হবে এবং এর দায়িত্ব দেওয়া হবে একজন প্রবীণ অফিসারকে। তা ছাড়া রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে, রাজনীতিবিদদের একটি প্রবাসী সরকার গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত অনুসারে এমএনএ ও এমপিএদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করা হয়। ৪ এপ্রিলের সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করার জন্য যে আনুষ্ঠানিক বাহিনী গঠন করা হবে, তার নাম হবে ‘মুক্তিবাহিনী’। জেনারেল ওসমানীকে এই মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এদিন চারজন আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। এরা হলেন মেজর শফিউল্লাহ, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। জানা যায়, ৪ এপ্রিলের সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১০ এপ্রিল পুনরায় তেলিয়াপাড়ায় সেনাসমাবেশ করা হয়। এ সমাবেশে আগের সভার সবাই ছাড়াও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফরে প্রধান কে এফ রুস্তমজি উপস্থিত ছিলেন।

উল্লেখ্য, তাজউদ্দীন আহমদ আমীর-উল ইসলাম, শেখ মণি, তোফায়েল আহমেদ ও এম মনসুর আলীকে সঙ্গে নিয়ে ১০ এপ্রিল কলকাতা থেকে আগরতলার উদ্দেশে যাত্রা করেন। পথে শিলিগুড়িতে তারা যাত্রাবিরতি করেন। শিলিগুড়ি থেকে রওনা হয়ে তারা ময়মনসিংহ সীমান্তের কাছে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাক্ষাৎ পান। তাঁকে সঙ্গে করে সবাই আগরতলা যাত্রা করেন। আগরতলা পৌঁছে নেতৃবৃন্দ নিজেদের মধ্যে অনেক আলাপ-আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠনে সবাই একমত পোষণ করেন। তাঁরা আরও একমত হন যে, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন এবং তাজউদ্দীন আহমদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। খন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্র, এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র এবং জনাব এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রীর পদ প্রদান করা হয়। এভাবেই ছয় সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়।

উল্লেখ্য, ২৫ মার্চ মধ্যরাত বা ২৬ মার্চ, ১৯৭১-এর ঊষালগ্নে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সব নেতাকে আত্মগোপনের নির্দেশ দিলেন কিন্তু তিনি নিজে বাসায় রইলেন। তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে তাঁর দলের দ্বিতীয় নেতার স্থান প্রদান করেন এবং তাঁকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বললেন এবং এও বললেন তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) অবর্তমানে যেন তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও যুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সম্ভবত পাকিস্তানিরা ভেবেছিল মূল নেতাই যখন গ্রেফতার হয়ে গেছে তখন আর কে-ই বা কী করতে পারবে। তারা ভাবতেই পারেনি যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর অবর্তমানে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড থার্ড-ইন-কমান্ড তৈরি করে রেখেছেন। নেতৃত্বকে তারা বন্দী করতে পারেনি কোনোভাবেই।

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ছয় সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। একই দিন অর্থাৎ ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (Proclamation of Independence) তৈরি করা হয়। এরপর ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১-এ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমানাসংলগ্ন তৎকালীন মহকুমা মেহেরপুরের মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথিবীর সামনে আত্মপ্রকাশ করে। পৃথিবীর বহু দেশের সাংবাদিক ও হাজার হাজার মানুষের সামনে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেন। এর পরপরই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বেতার ভাষণের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান ও মুক্তিযুদ্ধ অব্যাহত রাখতে অস্ত্র সাহায্য প্রার্থনা করেন। এটি মাতৃভূমির মুক্তির লক্ষ্যে নেতার দর্শন ও নির্দেশের প্রতি তাঁদের দৃশ্যমান দৃঢ় আনুগত্য।

রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে রেখে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা যৌথভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা শুরু করে দখলদার পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে। এটা ছিল একটি কঠিন কাজ। যদি কোনোভাবে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে বলাতে পারত যে, ‘ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তোমরা আর যুদ্ধ পরিচালনা করো না।’ তা হলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো? সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন আহমদের মাথায় এ ধরনের ভাবনা কখনোই আসেনি। তাঁদের এই দৃঢ় ভাবনাই হলো নেতার প্রতি তাঁদের আনুগত্য ও অকৃত্রিম বিশ্বাস। নেতার প্রতি তাঁদের এ বিশ^াস অবনমিত হয়নি কোনোভাবেই। নেতার প্রতি তাঁদের এ বিশ^াস তাঁদের নেতা ও জাতির মুক্তির আকাক্সক্ষাকে সদা অবিচল রেখেছিল। এটিই এনে দেয় আমাদের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন ভূখ- বাংলাদেশ।

সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন এমন এক নেতার একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন যিনি হাসতে হাসতে ফাঁসির কাষ্ঠে যাবেন কিন্তু তিনি তাঁর দেশ, জনগণ ও কর্মীর গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগুক এমন কিছু করবেন না। নেতা ও তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে এ রকম বিশ্বাস ও আনুগত্য অত্যন্ত বিরল। নেতার প্রতি সহকর্মীদের পর্বতসমান শ্রদ্ধা এবং সহকর্মীদের ওপর নেতার অপরিসীম আস্থার কারণেই বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানেও কেবল তাঁর নির্দেশেই তাঁর সহকর্মীদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। দেশের আপামর জনতা একজন মানুষের আহ্বানে তাঁর কথায় বিশ্বাস করে অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। দেশের মা-বোনেরা তাঁদের প্রিয় মানুষটির মুক্তির জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছেন দিনরাত।

যেখানে আলো তার পাশেই থাকে অন্ধকার। এটি নির্মম সত্য। খন্দকার মোশতাক ছিল আলোর পাশেই এ রকম একটি অমানিশা। একজন বিশ^াসঘাতক। তার নষ্ট অন্ধকারাক্রান্ত লোভী মনোজগৎ দৃশ্যমান হয় ১৯৭৫ সালে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে যখন জাতির জনককে এ দেশের কিছু নরপশু সপরিবারে হত্যা করে ঠিক তখন অন্যদিকে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান তাঁদের নেতার আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে হাসিমুখে কারাবরণ করতে দ্বিধা করেননি। কারা অভ্যন্তরে তাঁরা তাঁদের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁদের এবং তাঁদের নেতা ও তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে এতটুকু বিচ্যুত হননি। জীবন দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন এই জাতীয় চার নেতা। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন তাঁদের জীবনে এরূপ আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারে এই কামনা করি। সেই সঙ্গে তারা যেন ঘৃণা করে কপট বিশ^াসঘাতকদের। এটি যেন কখনো তারা বিস্মৃত না হয় যে, নেতা একজনই থাকেন। আর তাঁর সহযোগীরা সেই নেতার প্রতি থাকবেন সদা অনুগত এবং তারা কখনো বিশ^াসঘাতক হবে না। দেশ, রাজনীতি তবেই এগিয়ে যাবে সামনে। দেশের অগ্রগতি থাকবে সুরক্ষিত।

                লেখক : সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর