শুক্রবার, ৮ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

‘জয় বাংলা’র শিল্পী কামাল আহমেদ

মুস্তাফিজ রহমান

১৯৬৯ সালের শেষার্ধে দিগ্বিদিক বিদ্রোহী প্রতিবাদে প্রকম্পিত বাংলার অনন্য মুক্তিযুদ্ধের বেদিমূলে উচ্চারিত প্রাণের সেই অবিস্মরণীয় হুঙ্কার ‘জয় বাংলা’। এই জাতীয় সেøাগানের বঙ্গবন্ধু অনুমোদিত প্রথম সাহসী আঙ্গিক লিপিকার প্রবাসী কামাল আহমেদ আজ টরেন্টোর এক নার্সিং হোমে শয্যাশায়ী। তাঁর বয়স ৮৯ বছর। নিউক্লিয়াসের অনুমোদনে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু এবং তৎকালীন সংগঠন কর্ণধার সিরাজুল আলম খান, ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখের স্নেহসান্নিধ্যধন্য আস্থাভাজন ছিলেন তিনি। কানাডাপ্রবাসী কামাল আহমেদ সম্প্রতি প্রিয় পত্নী রেডিও বাংলার হিন্দি, নেপালি ভাষায় অভিজ্ঞ সাবেক সাংবাদিক সায়িদা কামাল নবুকে (৮১) হারিয়ে শোকদীর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় টরেন্টোর একটি বৃদ্ধকালীন আবাসে দিন কাটাচ্ছেন।

প্রবীণ প্রাজ্ঞ প্রচারবিদ অন্যতম রাজনৈতিক গ্রাফিক শিল্পী সৃজনশীল কামালের দুর্দান্ত ব্রাশেই রূপঙ্কিত হয় মূলত ছাত্রলীগের বহুমাত্রিক শিল্পকর্ম। যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বাস্তুহারা লীগ ও একাত্তরে কলকাতায় আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক প্যাড ডিজাইন, বাংলাদেশ সোহরাওয়ার্দী ক্রোড়পত্র, বাংলার বাণী পত্রিকার মাস্ক হেডিং, আন্তর্জাতিক ফিফার বাংলাদেশ সদস্যপদ লাভের মৌলিক ডিজাইন, জহুরুল হকের মৃত্যুর প্রতিবাদী পোস্টার, তৎকালীন আন্দোলনসমূহের মারাত্মক পোস্টার, ডিজাইন ও কভারের কারিগর এই শিল্পী। পরবর্তীতে জাসদের আন্দোলনসমূহের উল্লেখযোগ্য সব রাজনৈতিক পোস্টার, কর্নেল তাহের স্মৃতি সংসদের যাবতীয় ডিজাইনসহ তৎকালীন বহু বিতর্কিত ‘তোদের লালঘোড়া দাবড়ায়ে দেব’ পোস্টারটির শিল্পী এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য অঙ্গসংগঠন ও শেখ সেলিম এবং ইত্তেফাকের আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বিয়ের কার্ড ডিজাইন বঙ্গবন্ধু ও মণি ভাইয়ের ব্যক্তিগত ইচ্ছাক্রমে তাঁর দ্বারাই অঙ্কিত। স্মরণীয় ১৫ আগস্টে ডাকসু কর্তৃক জাতির পিতাকে প্রদেয় চিরকালীন সম্মাননা উপলক্ষে ঐতিহাসিক পোস্টার ও কার্ডের ডিজাইনটিও তাঁরই করা। বঙ্গবন্ধুর শোচনীয় মৃত্যুতে তা আর প্রকাশিত হয়নি।

বলা বাহুল্য, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের শুভ সূচনাতেই রাজ্জাক ভাই, মণি ভাই ও সিরাজুল আলম খানের ইচ্ছাক্রমে বঙ্গবন্ধুর স্নেহসান্নিধ্যময় সম্মতিতে কামাল আহমেদকে বাংলাদেশের সম্মানজনক নাগরিকত্ব দান করা হয়। পার্টির সেক্রেটারির ব্যক্তিগত অনুমোদিত পাসপোর্ট লাভে তাঁকে একাধারে ভারতীয় পরবর্তীতে বাংলাদেশি এবং বর্তমানে ক্যানাডার ত্রিকালদর্শী নাগরিক।

‘জয় বাংলা’ সেøাগানের শিল্পকর্মের গুরুত্ব অনুধাবনে তৎপর সিরাজুল আলম খান ও বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনক্রমে তাঁকে এবং মজহারুল হক বাকীকে তৎকালীন কুমিল্লাস্থ শর্মা কেমিক্যালস লিমিটেডের কেন্দ্রীয় অফিসে গোপনে নিরাপত্তা শেল্টার দেওয়া হয়। বিগত প্রায় ১০ বছর আগে মন্ট্রিলে শেখ হাসিনা প্রথম কানাডায় উপস্থিত হলে কামাল আহমেদ অঙ্কিত প্যাড ও মিনিয়েচার পোস্টার ডিজাইনটি তিনি সাগ্রহে গ্রহণ করেন। সেটা হয়তো এখন তাঁর মনে নেই।

দাদা সিরাজুল আলম খানের আত্মস্মৃতিমূলক বই, গোবিন্দ হালদারের ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে’, বেলাল মুহম্মদের ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ ছাড়াও গবেষক মহিউদ্দীন আহমদের ‘বেলা অবেলা’, ‘জাসদের উত্থান ও পতন’, ‘আওয়ামী লীগের উত্থান’ বইগুলোতেও সংগ্রামী সংবেদনশীল এই কৃতী শক্তিধর শিল্পীর অবদান স্বীকৃত। এ ছাড়া সত্যজিৎ রায়কৃত চিত্রনাট্য শাহেদ আলীর ‘জিব্রাইলের ডানা’র সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। তিনি কৈশোর ও যৌবনে সলিল চৌধুরী, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, মৃণাল সেন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ভূপেন হাজারিকা, প্রতিমা বড়ুয়া, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কলিম শরাফী, খালেদ চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস এবং তাঁর পিতৃবন্ধু কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ প্রমুখ তারকার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসে ধন্য হয়েছেন।

কীর্তিমান কামাল আহমেদের সৃজনশৈলীর সাক্ষীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাদা সিরাজুল আলম খান, মহিউদ্দীন আহমদ, আ স ম রব, শাজাহান সিরাজ, নুরুল আম্বিয়া, মোজাফফর হোসেন পল্টু, আমির হোসেন আমু, রাজীবউদ্দীন, কামাল লোহানী, মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, মোস্তাফা জব্বার, শেখ শহীদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, শুভ রহমান, মেসবাহউদ্দীন, হাসানুল হক ইনু, মার্শাল মণি, শেখ সেলিম এবং রাষ্ট্রীয় কুশলী আইনবিদ সৈয়দ রেজাউর রহমান প্রমুখ অসংখ্য ছাত্রকর্মী ও নেতৃবৃন্দ। স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বাপর ঐতিহাসিক সব আন্দোলনের নিষ্ঠাবান শরিক, একদা বিখ্যাত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক, নিউক্লিয়াস অনুরাগী এবং স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য প্রিয়পাত্র এই স্বীকৃতিবঞ্চিত অনাদৃত বর্ষীয়ান প্রচারবিদ বিজ্ঞ শিল্পী কামাল আহমেদের শুভাকাক্সক্ষীর তালিকায় ড. নীলিমা ইব্রাহিম, চিত্তরঞ্জন সুতার, কামরুল হাসান, কলিম শরাফী, কমল দাশগুপ্ত, ফিরোজা বেগম, আহমদ ছফা, জহির রায়হান, কাজী জাফর, খালেদ চৌধুরী, মাহবুবুল হক, হৃষিকেশ মুখার্জি, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সুভাষ মুখার্জি, মৃণাল সেন, হাসান হাফিজুর রহমান, জসীমউদ্দীন, আহসান হাবিব, ফররুখ আহমদ, আসাদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, নুরুন্নবী, আবু হেনা, খালেদ মুহম্মদ এবং সাংবাদিকগুরু শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন ও তার পুত্র শাহীন রেজা নূর প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

আজ জীবনসায়াহ্ণে সাথীহারা এই অভিমানী দুস্থ প্রাজ্ঞ শিপীর অন্তিম করুণ কামনা- যেন ‘জয় বাংলা’ মুদ্রিত কফিনে ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক’ বাক্য আচ্ছাদনে তাঁকে সরকারি দায়িত্বে সমাহিত করা হয় প্রিয়তমা পত্নীর পাশে, এই টরেন্টোয়।

সর্বশেষ খবর