শনিবার, ৯ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

অর্থ জনগণের, তাদের বাঁচাতে কার্পণ্য নয়

মইনুল হোসেন

অর্থ জনগণের, তাদের বাঁচাতে কার্পণ্য নয়

যে কোনো দায়িত্বশীল সরকারের পক্ষে এটা বোঝা খুব সহজ যে, জাতীয় সংকট সন্ধিক্ষণে সরকার হচ্ছে জনগণের সাহায্যপ্রাপ্তির শেষ ভরসাস্থল। এই সময়ে জনগণের প্রতি সরকারের জবাবদিহি বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।

মালিকপক্ষের সিদ্ধান্তের কারণে শ্রমিকরা তাদের চাকরি হারায়নি। তারা চাকরিচ্যুত হয়েছে সরকারি লকডাউন ও শাটডাউন সিদ্ধান্তের কারণে। স্বীকার করি বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর জন্য সরকার জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে এ ধরনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু জনজীবনে যে কঠিন বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে তা দেখার দায়িত্ব সম্পর্কে সরকারকেই তো বেশি সচেতন থাকতে হবে।

সব মালিকই এমন ধনী নয় যে, ইচ্ছা থাকলেও তারা ব্যবসা বন্ধ রাখার মধ্যেও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে পোশাকশিল্পের অনেক মালিকই প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। বিদেশে তাদের যে অঢেল অর্থ-সম্পদ রয়েছে তা কারও অজানা নয়। শ্রমিকরাও সে খবর রাখে। তারা অন্তত কয়েক মাসের জন্য দরিদ্র শ্রমিকদের তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে সাহায্য করে মহানুভবতার স্বাক্ষর রাখতে পারেন।

চাকরি হারানো শ্রমিকদের জন্য তাদের মালিকরা সরকারের কাছে নগদ অর্থ সাহায্য দাবি করছে। পোশাকশিল্পের মালিকদের সরকার স্বল্পসুদে ব্যাংক থেকে ঋণও মঞ্জুর করেছে। অন্য আরও কিছু লোককেও সরকার ঋণ সুবিধা দিয়েছে।

সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা মহামারী সম্পর্কে জনগণ ও সরকারের পক্ষে সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করলেও সরকারের কাছ থেকে একইভাবে ঋণ পাওয়ার আবেদন জানিয়েছে কিন্তু কোনোরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

এসব ঋণ দেওয়া হচ্ছে কম সুদে, যা মালিকদেরই পরিশোধ করতে হবে। এটা কোনো অনুদান নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় মালিকরা এ ঋণ পরিশোধের বাড়তি চাপ কীভাবে সামাল দেবেন, সে প্রশ্ন কোনো বিবেচনার বিষয় নয়। করোনা মহামারীতে গরিব-ধনী সবারই আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে খবর রয়েছে যে, ব্যাংকগুলো আর্থিক টানাটানির মধ্যে আছে।

সরকার মনে করছে মহামারীজনিত সংকট মোকাবিলা করার সহজ উপায় হচ্ছে জনগণকে গৃহবন্দী রাখা এবং অর্থনীতির চাকা বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু মানুষের আয়ের পথ না থাকলে তাদের কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যাবে, সে ব্যবস্থাও সরকারকেই করতে হবে। করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা জনজীবনের জন্য যে মহাবিপদ ডেকে এনেছে তা বুঝতে অনেক দেশের সরকারের অসুবিধা হচ্ছে না। নানাভাবে তারা জনগণকে বিনামূল্যে বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে যাচ্ছে। আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে। সব কর্মচারীর বেতন দেওয়ার দায়িত্ব সরকারই নিচ্ছে। এমনকি বিনামূল্যে ঘরে ঘরে খাবারও পৌঁছে দিচ্ছে। সমগ্র জনগোষ্ঠীকে বিপদকালীন সহযোগিতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করেছে। এসব খবর আমাদের সরকারের অজানা নয়।

কাজ করুক আর না করুক সরকারি কর্মচারী এমনকি সরকারি শিক্ষকদেরও জনগণের অর্থে বেতন দেওয়া হচ্ছে। এখন এই কঠিন সময়ে জনগণের অর্থ দিয়ে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারটিকে নেহাত অনুগ্রহের ব্যাপার মনে করা হচ্ছে। জনগণকে অনুগ্রহের পাত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে। অথচ জনগণের অর্থে সব ধরনের আরাম-আয়েশের জীবন যাপন করতে অসুবিধা হয়নি। ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লুট হয়ে যাওয়ার ঘটনা তাদের কাছে দুশ্চিন্তার বিষয় বলে মনে হয়নি। অন্য অনেক দেশের মতো এ দেশের চাকরি হারানো লোকদের এই জাতীয় সংকটের সময় সরকারি অর্থভান্ডার থেকে বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হবে।

সরকার সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণে অগোছালো। সর্বপ্রধান প্রয়োজন ছিল মহামারী মোকাবিলার জন্য চিকিৎসা-বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় শক্তিশালী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তুতি গ্রহণ।

গত চার মাসেও এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটিকে পরিপূর্ণভাবে করোনা সংকট মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলা সম্ভব হয়নি। যাদের সংকট মোকাবিলায় সামনের সারিতে থাকতে হচ্ছে সেই ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী এবং তাদের সঙ্গী পুলিশ, সেনা সদস্যরা উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত সুরক্ষামূলক উপকরণ না পাওয়ায় তাদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করছে। তাদের এই অসহায়ত্বই গোটা জাতিকে আরও বেশি অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাই সমস্যাটি কেবল শ্রমিকদের চাকরি হারানোর হুমকি বা বিপদের ভিতর দিয়েই শেষ হওয়ার নয়।

যতক্ষণ না হাসপাতালগুলোকে যথাযথভাবে সুসজ্জিত করে তোলা না যাবে ততক্ষণ অন্য কোনো পদক্ষেপ নিয়ে জনগণকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের গতি সঞ্চার করা যাবে না। এ বিষয়টি সরকার বুঝতে পারছে না।

করোনা মহামারীসংক্রান্ত অর্থনৈতিক সমস্যার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতেও বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন হবে। মালিকদের সঙ্গে বৈঠকই যথেষ্ট নয়। টেস্ট কিটের বিষয়টি এখনো খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। আর পেলেই কী হবে? যাদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হবে তাদের তো আলাদা করে রাখতে হবে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। সরকার কীভাবে নিজেদের অব্যবস্থাপনা থেকে রক্ষা পাবে সেটাই বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। জনগণ সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে কোনো সমন্বয় দেখতে পাচ্ছে না এবং গৃহীত সিদ্ধান্ত যে বাস্তবায়ন হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা খুঁজে পাচ্ছে না।

এটা নিশ্চিত যে, করোনাভাইরাস নামক অদৃশ্য শত্রুকে পরাজিত করার জন্য দক্ষ ও সক্রিয় মেডিকেল বিশেষজ্ঞ দরকার। কিন্তু যারা ফিল্ডে সক্রিয় তারা এখন নিজেদের জীবন নিয়েই শঙ্কিত এবং হতাশায় ভুগছেন। তাই তারা রোগীদের তেমন সাহায্য করতে পারছেন না। কারণ, হাসপাতালগুলো চিকিৎসা প্রদানের জন্য সজ্জিত নয়, রোগীদের তাই ভর্তি করতেও চাচ্ছে না। তারপর তাদের সাহসের প্রশংসা করতে হয়। তাদের কাছে জাতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু সরকারি প্রস্তুতির অভাবে তারা সফল হতে পারছে না। এ পর্যন্ত ১১ হাজার ৭১৯ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অনিশ্চিত জীবন নিয়ে দিন কাটাচ্ছে।

জরুরিভিত্তিতে মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সাজসরঞ্জাম সংগ্রহ করার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা কতটা সাহসী ভূমিকা রাখতে পারছেন জানি না। কিন্তু তাদের সাহসী ভূমিকা করোনা মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ। বহু লোক চিকিৎসার অভাবে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করছে। আক্রান্ত আরও অনেকেরই জীবন রক্ষা করা যাবে না।

এ পর্যায়ে বিলম্বে হলেও আমেরিকার সাহায্যপ্রাপ্তির আশায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূতের কাছে জনৈক মন্ত্রী মাত্র একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। এই সংকটকালে আমাদের উত্তম বন্ধুরা যেমন চীন ও ভারতকে আমাদের পাশে দেখা যাচ্ছে না। সরকার বড্ড একাকী ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না যে, ক্রেতারা আগের মতো বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কিনতে আগ্রহী হবে। ফলে গোটা পরিশ্রম শেষ পর্যন্ত পন্ডশ্রমে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সুবিবেচিত চিন্তা-ভাবনার অভাবে গার্মেন্ট কর্মীদের অনেককেই বিনা চিকিৎসায় জীবন দিতে হবে। অন্য শ্রমিকদেরও রেহাই নেই।

আংশিকভাবে পোশাকশিল্প খোলার সিদ্ধান্ত যখন সরকারিভাবে নেওয়া হয় তখন বিশ্বের কোথাও শ্রমিকবহুল বড় ফ্যাক্টরি নতুন করে চালু করার অনুমোদন দিতে দেখা যায়নি।

কিন্তু সরকারকে বুঝতে হবে সরকারের অর্থ বলতে কিছু নেই, সবই জনগণের অর্থ। জনগণের বাঁচা-মরার মুহূর্তে তাদের সাহায্যে কার্পণ্য দেখানো যাবে না। সরকারের কাছে অনুগ্রহও চাওয়া হচ্ছে না। সরকারকে দায়িত্ব পালন করতে হবে জনগণের অর্থে জনগণকে বাঁচিয়ে রাখার।

যদি বৈদেশিক ঋণ বা সাহায্য নিতে হয় তাহলে তার আগে গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে যাতে জনগণের অর্থ জনগণের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও চরিত্রে পরিবর্তন প্রয়োজন। সরকারকে বুঝতে হবে জনগণের সহ্যের সীমার বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।

জনগণের একটা বড় অংশ যখন আয়-উপার্জন থেকে বঞ্চিত হয়ে শুধু বেঁচে থাকার জন্য রাস্তায় ছোটাছুটি করতে বাধ্য হচ্ছে তখন সরকার ও সরকারি কর্মচারীরা আগের মতোই সম্পূর্ণ বেতন-ভাতা ভোগ করে চলেছেন। তাদের বেতন-ভাতার একটা অংশ যেন কর্তন করা হয়, এটাই বিবেকের দাবি। তারা জনগণের অর্থেই বিলাসবহুল-জীবন যাপন করছেন। ভারতে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ৩০ ভাগ কম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

                লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

সর্বশেষ খবর