শনিবার, ৯ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর হেডকোয়ার্টার কুমিল্লা

কাজী আখতারউদ্দিন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর হেডকোয়ার্টার কুমিল্লা

১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ডিসেম্বর, ১৯৪১ অক্ষশক্তির একটি বাহু জাপান আকস্মিকভাবে প্রশান্ত মহাসাগরে পার্ল হারবার আক্রমণের মাধ্যমে আমেরিকা ও ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

১৯৪১ সালে বার্মায় (মিয়ানমার) জাপানি বিমানবাহিনীর শক্তি ছিল তুঙ্গে। পার্ল হারবার (৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১) পতনের ১৬ দিন পর ওরা রেঙ্গুনে (ইয়াঙ্গুন) বোমা ফেলতে শুরু করে। মাঞ্চুরিয়া, চীন, ইন্দোচীন এবং থাইল্যান্ড দখলের পর জাপানি বাহিনীকে অপরাজেয় মনে হচ্ছিল। জাপান বার্মা আক্রমণ করার পর ব্রিটিশ সরকার বেঙ্গল ও আসামে বিমানঘাঁটি গড়ে তোলা শুরু করে। তবে মার্চ, ১৯৪২ সাল পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষে কেবল ১৬টি বিমানক্ষেত্র ছিল, কাজেই আরও ২১৫টি বিমানক্ষেত্র নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিলে ১৮ মাস পর এর সংখ্যা দাঁড়াল ২৮৫। যথোচিতভাবে কয়েকটি বিমানক্ষেত্র রেলপথের সঙ্গেই নির্মাণ করায় এগুলো রসদ পরিবহনের জন্য চমৎকার বিমান ঘাঁটিতে পরিণত হলো। এভাবেই আগরতলা, কুমিল্লা, সিলেট ও ফেনীতে বিমানক্ষেত্র গড়ে তোলা হলো। ব্রিটেন ও আমেরিকা থেকে সাগরপথে ভারতে রসদ আনা হতো, এরপর স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত রসদের সঙ্গে রেলপথে বিমানঘাঁটিতে পাঠানো হতো। এখানে সেনা সদস্যরা রসদগুলো বাছাই করতেন এবং এয়ার ড্রপিংয়ের উপযোগী ছোট ছোট প্যাকেট তৈরি করে সেগুলো স্টোরে রাখতেন। তারপর একটি জটিল, নিয়ন্ত্রিত সিগন্যাল মারফত সেনাবাহিনী থেকে চাহিদা পাওয়ার পর বেশ সতর্কভাবে চাহিদা মোতাবেক প্যাকেট মিলিয়ে উড়োজাহাজে বোঝাই করার জন্য প্রস্তুত করা হতো। উড়োজাহাজের স্বল্পতাহেতু এ প্রক্রিয়ায় অনেক সময় দেখা যেত আগরতলার ঘাঁটি থেকে একটি এয়ারক্রাফট সকালে রসদ নিয়ে কালাদান উপত্যকায় ফেলার পর আবার চট্টগ্রাম বিমানঘাঁটি থেকে (সমুদ্রবন্দর) রসদ নিয়ে ইম্ফলে পৌঁছে দিয়ে সেখান থেকে আহত সেনাদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ঘাঁটিতে ফিরে আসত।

আরাকানের বিভিন্ন টার্গেট ও রাজকীয় বিমানবাহিনীর এয়ার ফিল্ডগুলোর ওপর হামলা চালানোর পর ঔঅঋ (জাপান বিমানবাহিনী) যখন এক রাতে কলকাতার ওপর বোমা ফেলল, তখন মিত্রশক্তি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল।

পূর্ব বাংলার সবচেয়ে পুরনো সামরিক ঘাঁটি কুমিল্লা সেনানিবাস আগে থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সামরিক ঘাঁটি ছিল এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি এই সেনানিবাসই ব্যবহার করেছিল।

১৯৪২ সালের শেষ দিকে সমগ্র ইন্ডিয়া এয়ার কমান্ড তিনটি গ্রুপ নিয়ে গঠিত ছিল...। অক্টোবরে জাপানিরা উত্তরের মার্কিন ঘাঁটিগুলোর ওপর ভারি বিমান হামলা শুরু করল। তখন কুমিল্লা ও আগরতলা থেকে মার্কিন বাহিনীর C46 Curtiss Commandos যুদ্ধবিমানগুলো কুনমিং পর্যন্ত উড়ে গেল। রয়েল এয়ারফোর্সের ফাইটার বোম্বার এবং 3rd Tactical Air Force (TAF) -এর ফাইটার প্লেনগুলো ১৮ বার সেখানে উড়ে গিয়েছিল।

আগস্ট, ১৯৪৩ সালে অ্যাডমিরাল মাউন্টব্যাটেনের অধীনে সাউথ এশিয়া কমান্ড গঠিত হয়। এরপর একই বছরের ডিসেম্বরে বার্মায় অভিযান শুরু। ইতিমধ্যে জাপানি স্থলবাহিনী আসামের ইম্ফল ও কোহিমা আক্রমণ করে। মিত্রবাহিনীর সহায়তায় ও জাপানি আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য কুমিল্লায় মার্কিন পি-৪০ (Curtiss P-40 Warhawk) এবং যুক্তরাজ্যের হারিকেন যুদ্ধবিমানের দুটি স্কোয়াড্রন মোতায়েন করা হয়। নভেম্বর, ১৯৪৩ সালে ৬ স্কোয়াড্রন এবং পরবর্তীতে ৮ স্কোয়াড্রন কক্সবাজারে স্থানান্তর করা হয়। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ৬ স্কোয়াড্রনের পাইলটরা প্রতিদিন ছয়বার করে মোট ১ হাজার বার বিমান হামলা করে। এরপর ৪ স্কোয়াড্রন প্রথমে ফেনী, তারপর কুমিল্লায় চলে আসে। আবার মে, ১৯৪৪, ৯ স্কোয়াড্রন কোহিমা ও ইম্ফলে কিছু দিন কৌশলগত দায়িত্ব শেষে কুমিল্লায় চলে আসে। আগস্ট, ১৯৪৪ সালে দুটি স্কোয়াড্রনই এখান থেকে উড়ে গিয়ে সাঙ্গু নদ উপত্যকায় জাপানি অবস্থানে ভারি বোমা বর্ষণ করে। বিশেষত জাপানিদের সেই এলাকা থেকে হটিয়ে দেওয়ার অভিযানে মিত্রবাহিনীর ৮১ ডিভিশনের একটি আক্রমণ অভিযানে সহায়তা করার কাজে একনাগাড়ে তিন দিন বার্মার লাবাওয়া এলাকায় বোমাবর্ষণ করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যুক্তরাজ্য ও মার্কিন বিমানবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত Third Tactical Air force (Third TAF) -এর দায়িত্ব ছিল শত্রুর ওপর পাল্টা বিমান হামলা করা। ইস্টার্ন এয়ার কমান্ডের (EAC) অধীন একটি বাহিনী হিসেবে ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৪৩ এই বাহিনীটি গড়ে তোলা হয়। এয়ার মার্শাল স্যার জন বাল্ডউইন ছিলেন Third TAf -এর কমান্ডার। তিনি কুমিল্লায় তার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন। চার মাসের বর্ষাকালে ভারি বৃষ্টিপাতের মধ্যে RAF Third Tactical Air Force  তাদের বিমান হামলার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে ২৪ হাজার আক্রমণ পরিচালনা করে, যা আগের বছরের চেয়ে ছয় গুণ বেশি ছিল। এ সময় রয়েল এয়ারফোর্সের ভারতীয় অংশ The Royal Indian Airforce (RIAF), অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যে মুহূর্তে মাউন্টব্যাটেন সিদ্ধান্ত নিলেন যে, পাঁচ ভারতীয় ডিভিশন আরাকান থেকে সরিয়ে আনবেন, তখন নতুন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হলো। এটা ছিল যুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই প্রথম একটি বিশাল সেনাদলকে এক রণক্ষেত্র থেকে আরেক রণক্ষেত্রে বিমানে স্থানান্তর করতে হয়েছিল। 5th Indian Division, 7th Indian Division--এর দুটো ব্রিগেড ও ব্রিটিশ 2nd Division-এর একটি ব্রিগেড উড়িয়ে নিয়ে ১ হাজার ৫৪০ বার প্লেন উড়ে গিয়েছিল।

ভাইকার ওয়েলিংটন বোমারু বিমানগুলোকে দ্রুত রূপান্তরিত করা ট্রান্সপোর্ট স্কোয়াড্রনগুলো মে-জুন পুরো দুই মাস কুমিল্লা, আগরতলা আর বেঙ্গলের অন্যান্য বিমানক্ষেত্র থেকে উড়ে গিয়ে অন্তত ৪০০ টন ওজনের রসদ অবরোধের প্রতিদিন ফেলতে লাগল। এয়ারফিল্ডগুলো প্রায় রেলস্টেশনের রূপ ধারণ করল। একটি ডাকোটা প্লেন অবতরণ করার পর আনলোডিং, রি-লোডিং আর রি-ফুয়েলিংয়ের কাজ ১৫ মিনিটের মধ্যে করা হচ্ছিল। তবে বড় C46 প্লেনগুলোর আরও বেশি সময় লাগত।

১৯৪৩ সালে 14TH ARMY-এর কমিউনিকেশন ও হেডকোয়ার্টারের একটি কেন্দ্র হিসেবে কুমিল্লাকে উন্নত করার প্রয়োজন দেখা দিল। জাপানিদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালাবার জন্য তখন পূর্ব বাংলায় কুমিল্লা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কৌশলগত কারণেই আরাকান ও আসাম ফ্রন্টের মাঝে, চট্টগ্রাম থেকে মণিপুর রোড এবং ঢাকা যাওয়ার (বার্মা অ্যান্ড আসাম রেলওয়ে) B & A railway--এর মাঝে এর অবস্থান, সিগন্যাল কমিউনিকেশন এবং এয়ার ফিল্ড নির্মাণের একটি কেন্দ্র হিসেবে এর উপযুক্ততার কারণে, কুমিল্লাকে 14th Army and 3rd TAF-এর হেডকোয়ার্টার এবং Re-inforcement Camp করা হয়েছিল। ক্যাম্পের সেনা ও গ্যারিসনের জন্য হাসপাতালের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৯৪৪ সালের শেষ দিকে প্রায় ১০ লাখ সেনা নিয়ে গঠিত 14th Army নামে এই সেনাদলটি তৎকালীন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাদল ছিল। এর ৪০ ভাগই ছিল ভারতীয় মুসলিম সেনা।

আসাম ফ্রন্টের জন্য ইম্ফলে এবং আরাকান ফ্রন্টের জন্য মূলত ঢাকায় হাসপাতাল এলাকা স্থাপন করা হয়েছিল। এ ছাড়া কক্সবাজার ও চট্টগ্রামেও অতিরিক্ত হাসপাতালের সুবিধা ছিল। এরপর আরাকান থেকে আকাশপথে যখন সেনা অপসারণ করার পরিকল্পনা হয়, তখন কুমিল্লার বিমানঘাঁটি থেকে রসদ নিয়ে বিমানগুলো উড়ে যেত এবং আহতদের ফিরিয়ে আনত। কাজেই তখন কুমিল্লাকে একটি ফরওয়ার্ড হসপিটাল এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হলো, যেখান থেকে আহতদের বিমানে নিরাপদ এলাকায় নেওয়া যায়।

১৯৪৪ সালের এপ্রিল ও মে মাসটি ছিল অত্যন্ত সংকটময়। উত্তর ফ্রন্টের প্রাথমিক পরিকল্পনা পুরোপুরি পুনর্গঠন করা দরকার ছিল। ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইম্ফল ও কোহিমা থেকে ফরওয়ার্ড হাসপাতাল এলাকা গঠন করার কাজটি সরিয়ে কুমিল্লা ও আগরতলায় আনতে হয়েছিল।

যেহেতু কুমিল্লা ও আগরতলা অ্যারোড্রোম থেকেই ইম্ফলে রসদ সরবরাহ করা হতো, তাই এ সিদ্ধান্ত। যুদ্ধাহতদের ফিরিয়ে আনা ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্র্যাফটগুলো ডাইভার্ট করা সম্ভব নয় বিধায় অ্যারোড্রোমের কাছেই হাসপাতাল তৈরি করা দরকার ছিল। যথেষ্ট প্রকৌশলী না থাকায় তৎক্ষণাৎ হাসপাতালের জায়গা ও রাস্তা নির্মাণ শেষ করতে অনেক সময় লেগে গেল। ফলে আহতদের কিছু অংশ কুমিল্লা ও আগরতলায় রেখে অবশিষ্ট যুদ্ধাহতদের পর্যায়ক্রমে অ্যাম্বুলেন্স ট্রেনে ঢাকার হাসপাতালগুলোয় পাঠানো হচ্ছিল। এয়ারক্রাফটের প্রচন্ড স্বল্পতাহেতু সব যুদ্ধাহতকে আকাশপথে ঢাকায় নেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া মেডিকেল অথরিটির কাছে কোনো অ্যাম্বুলেন্স এয়ারক্রাফ্ট ছিল না, যা ইচ্ছামতো ডাইভার্ট করা যেত। ইম্ফলের যুদ্ধের পুরো সময় এক স্কোয়াড্রন (ডিসি-৩) ডাকোটা অ্যাম্বুলেন্স এয়ারক্রাফ্ট সব আহত ও অসুস্থ সেনাকে ঢাকা নিয়ে যেতে পারত। ফেরার পথে এয়ারক্রাফ্টটি ঢাকা বিমানক্ষেত্র থেকে রসদ ভর্তি করে নিয়ে যেতে পারত এবং সেনা অপসারণের চূড়ান্ত সময়ে রসদবাহী বিমানে কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামে কিছু কিছু আহতকে সরিয়ে নেওয়া যেত, যেখানে ইতিমধ্যে গ্যারিসনের জন্য হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছিল।

১. বার্নাড ডিয়ার নামে এক ব্রিটিশ সেনার স্মৃতিচারণা : আমরা বোম্বে (মুম্বাই) নামলাম। সেখান থেকে রেলে কুমিল্লার পথে যাত্রা হলো। সাত দিন ট্রেনে চলার পর ১৯৪৪ সালের বড়দিনের কয়েক দিন আগে কুমিল্লা পৌঁছলাম। তখন কুমিল্লা ছিল 14th Army -এর নতুন জনবলের একটি ট্রানজিট ক্যাম্প। সেখানে বেল তাঁবুতে অবস্থান করা কয়েকজন আমাদের স্বাগত জানিয়ে বললেন, ‘এখন আরাম করুন। আমরা ছয় মাস ধরে এখানেই রয়েছি।’ রাত ১০টায় শুতে গেলাম। তারপর দুটার সময় তাঁবুর চারদিকে চিৎকার শুরু হলো। রয়েল সিগন্যালের সেনারা সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলো। কাছেই এয়ার ফিল্ডে নিয়ে আমাদের ২০ জনকে একটা ডাকোটা প্লেনে ঠেলে উঠানো হলো, বসার কোনো সিট নেই, কয়েকটা তেলের ড্রাম, পশুখাদ্য রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। শুরু হলো কুমিল্লা থেকে উত্তর-পূর্ব বার্মার দিকে আকাশপথে তিন ঘণ্টার ভ্রমণ।

কুমিল্লা এয়ারফিল্ডের রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্তে একটি টিলা ছিল, এটা ছিল যুদ্ধবিমানের হ্যাংগার।

২. ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর ওয়্যারলেস অপারেটর ডগলাস গিবসন-মে ১৯৪২ সালে HMT Strathaird, , জাহাজে ভারতে আসেন। তার মতে, ১৯৪৪ ও ১৯৪৫ সালের অধিকাংশ সময় আগরতলায় মোবাইল সিগন্যাল ইউনিটে কর্মরত ১৭৭ উইং স্কোয়াড্রনের ডাকোটায় বার্মায় সেনাদের জন্য রসদ নিয়ে যেতাম যার অভিজ্ঞতা ছিল রোমহর্ষক। দুবার আমাকে কুমিল্লায় পাঠানো হলো, সেখানে একটা হাসপাতালে সাউথ ইস্ট কমান্ডের সুপ্রিম এলাইড কমান্ডার লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রী লেডি এডউইনা মাউন্টব্যাটেনের দেখা পেয়ে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করলাম। তিনি তখন তার স্বামীর অনুরোধে সব মেডিকেল সেন্টার ভিজিট করছিলেন। উল্লেখ্য, লর্ড মাউন্টব্যাটনও এর কিছু দিন আগে চট্টগ্রাম এসে সেনাদের মনোবল বৃদ্ধি করার জন্য তাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

৩. স্কোয়াড্রন লিডার মিচেল, সিগন্যাল অফিসার। তার ভাষ্য, সবকিছু নির্ভর করত দক্ষ যোগাযোগব্যবস্থার ওপর। অধিকাংশ সিগন্যাল পাঠানো হতো কুমিল্লার সিগন্যাল সেন্টার থেকে, ১৯৪৪ সালে কুমিল্লা ছিল 3rd Tactical Air Force-এর হেডকোয়ার্টার। সেখানকার বিশাল সিগন্যাল সেন্টার থেকে সেনাবাহিনীর সব ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করা হতো। সব সিগন্যাল এনসাইফার ও ডিসাইফার করা হতো। কুমিল্লার HQ 14th Army আমাদের পাশেই ছিল। আমার উল্টো দিকের একজন ইন্ডিয়ান আর্মি কমিউনিকেশন অফিসারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছিলাম।

৪. গ্রুপ ক্যাপ্টেন ডেনিস ডেভিড তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, আমাদের গুটিকয়েক হারিকেন, পি-৪০ এবং বাফেলো প্লেন জাপানিদের সঙ্গে পেরে উঠছিল না। অক্টোবর, ১৯৪৪ পদোন্নতি দিয়ে আমাকে চট্টগ্রামে ২২৪ গ্রুপে পাঠানো হলো। প্রচুর আহত সেনাকে আমি প্লেনে করে কক্সবাজার নিয়ে গিয়েছিলাম। চট্টগ্রামের পর শালিমারে একটা জয়েন্ট হেডকোয়ার্টার গঠন করা হলো- এটা ছিল কক্সবাজার এয়ারফিল্ডের কাছে ভালো একটা ঘাঁটি। পুরনো প্লেনের বদলে এবার আমরা Modern Spitfires, P-47 Thunderbolts, P-38 Lightnings, Mustangs and Beaufighters প্লেন পেলাম। কর্নেল বব গেপিনের অধীনে P-51 and P-38 squadrons, যুদ্ধবিমান ছিল।

জাপানের বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বার্মার যুদ্ধে চিটাগাং একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থল, নৌ ও বিমান ঘাঁটি ছিল। ১৯৪২ সালের এপ্রিল ও মে মাসে জাপানি বিমানবাহিনী চিটাগাংয়ে বোমাবর্ষণ করেছিল। ব্রিটিশ বাহিনীকে তখন বাধ্য হয়ে কুমিল্লায় পশ্চাৎপসরণ করতে হয়েছিল। তবে ইম্ফলের যুদ্ধের পর মার্কিন বিমানবাহিনীর দশম বিমানবাহিনীর কিছু ইউনিট মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেওয়ায় তাদের শক্তি বৃদ্ধি পেল। এখানে কমনওয়েলথ বাহিনীর সেনারা ছিল।

হাটহাজারী : মার্কিন সেনাবাহিনীর দশম এয়ারফোর্স ১৯৪৪ সালে এই ফিল্ড ব্যবহার করেছিল। 128th ArmyGi এখানে একটি রেডিও রিলে স্টেশন ছিল।Douglas C-47 Skytrain and Curtiss C-46 Commando ট্রান্সপোর্ট ইউনিট ১৯৪৫ পর্যন্ত এই ফিল্ড ব্যবহার করেছিল।

দোহাজারী এয়ারফিল্ড : ৩০ জানুয়ারি থেকে ১৫ মে, ১৯৪৫ পর্যন্ত মার্কিন বিমানবাহিনীর দশম বাহিনীর প্রথম কমবাট কার্গো গ্রুপের সাপ্লাই ইউনিট। ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত C-46 Commando বিমানগুলো এখান থেকে উড়ত।

ফেনী : দশম এয়ারফোর্সের ১২তম বম্বার্ডমেন্ট গ্রুপের প্রাথমিক ঘাঁটি। জুলাই, ১৯৪৪ থেকে জুন, ১৯৪৫ পর্যন্ত B-25 Mitchellবোমারু বিমানগুলো ব্রিটিশ ১৪তম সেনাদলের সহায়তা করার জন্য বার্মায় উড়ে যেত। এ ছাড়া ১২তম কমবাট কার্গো গ্রুপ ফেনী থেকে উড়ে গিয়ে স্থলবাহিনীর জন্য রসদ বয়ে নিয়ে আকাশ থেকে নিচে ফেলত। কমিউনিকেশন স্টেশন ওAir Technical Service Command maintenance depot হিসেবেও ফেনী ব্যবহৃত হতো।

৫. সিলেট : টমাস ই নাটের স্মৃতিচারণা : খারাপ সময়ের সেরা মুহূর্ত : (জানুয়ারি ১৯৪৩-জুলাই ১৯৪৬) বছরের শেষ দিকে আমরা দুটো প্লেনে সিলেটে আমেরিকান স্কোয়াড্রনে যোগ দিলাম। চমৎকার একটি ক্যাম্প। থাকার জায়গা আর খাবার-দাবার ছিল উৎকৃষ্ট। রাতে নাচ-গান হতো বা ক্যাম্পে সিনেমা দেখতাম। এক রবিবারে একজন পাদরি এসে ধর্মীয় বাণী শোনাতে শুরু করলেন।

সূত্র :

(The South African Military History Society- AIRBORNE LIFELINE Action over Burma, 1942-45 by P.R. Fox)/ militaryhealth.bmj.com/J R Army Med Corps: 1 September 1948)/ The Army Air Forces in World War II, Volume Four: The Pacific, Guadalcanal)

 

                লেখক : গবেষক ও অনুবাদক।

সর্বশেষ খবর