শনিবার, ৯ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

লকডাউনে নির্যাতন নয়

সালাহ্উদ্দিন নাগরী

লকডাউনে নির্যাতন নয়

লকডাউনের কারণে সারা পৃথিবীর মানুষ কার্যত বন্দী। কেউ জানে না, এভাবে কত দিন চলতে হবে, নাকি এর থেকেও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেকে, পরিবার, সমাজ, সর্বোপরি জাতিকে রক্ষার জন্য সবাইকে ঘরে থাকতে হচ্ছে। আর এই ঘরে থাকার সময়টি ভালো কাজ, ভালো চিন্তা ও জীবন গঠনে না লাগিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফেতনা-ফ্যাসাদ, গন্ডগোল, বাদবিসংবাদে জড়িয়ে পড়ছি। ‘ঘর’ নামক সুন্দর আবাসটিকে তিক্ততার গারদখানায় পরিণত করছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিচালিত কিছু জরিপে লকডাউনে নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। চীনের হুবেই প্রদেশে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে এ ধরনের সহিংসতার অভিযোগ পাওয়া গেছে ১৬২টি; যা গত বছরের ওই সময়ে ছিল ৪৭টি। ফ্রান্সে লকডাউনের পর থেকে পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে ৩২ শতাংশ। নির্যাতনকারীর সঙ্গে একই বাসায় সারা দিন থাকার ফলে অনেকেই সহায়তার জন্য হেল্পলাইনে ফোনও করতে পারছেন না।

বিবিসির অনলাইনের একটি  প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ব্রিটেনে নয়, লকডাউনে বিশ^ব্যাপী বেড়েছে নারীর প্রতি পারিবারিক নির্যাতন। ওখানে পারিবারিক সহিংসতা রোধে সহায়তা দেওয়া ‘দ্য ন্যাশনাল ডোমেস্টিক অ্যাবিউজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান জানায়, সম্প্রতি তাদের হেল্পলাইনে সাহায্য চাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ২৫ শতাংশ। ঘরে আটক থাকার ফলে নারীরাই মূলত তাদের বন্ধু বা স্বামী দ্বারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আমরা সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে মজা করে হোক বা বাস্তবে হোক অনেক পোস্ট ও ছবি দিচ্ছি  স্বামীকে দিয়ে স্ত্রী ঘরদোর মোছাচ্ছেন, কাপড়-চোপড় কাচাচ্ছেন। বিষয়গুলো সাদা চোখে বিশ্লেষণ করা ঠিক হবে না। এগুলো অসংখ্য নির্যাতনের বিপরীতে দু-চারটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। এ ধরনের সহিংসতায় জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, এ দুর্যোগের সময় নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বাসাবাড়িতে তারা অনিরাপদ হয়ে উঠছে, যেখানে তাদের সবচেয়ে নিরাপদ থাকার কথা। তাই তিনি করোনা মোকাবিলার  পরিকল্পনায় নারীদের সুরক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে সব দেশের সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন। কেন এ ঘটনাগুলো ঘটছে? নারী তো নির্যাতিত হওয়ার জন্য কারও সঙ্গে সংসার পাতে না। তাহলে কেন এবং বিশেষত এই দুর্যোগ মুহূর্তে এ ঘটনাগুলোর হার বেড়ে চলছে? লকডাউনে ঘরের বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না, বার-নাইট ক্লাবে সঙ্গীর সঙ্গে উদ্দামতায় ভেসে যাওয়া যাচ্ছে না, সেজন্যই কি স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে মারামারি, হাঙ্গামা? হতেও পারে।

তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ-ব্যবস্থার অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ আমাদের বিচ্যুত হওয়ার দরজাগুলোকে নিয়ত উন্মুক্ত ও বিস্তৃত করেই চলেছে। আর পারিবারিক নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতা তো এসবেরই উপজাত। গল্প-উপন্যাস, টিভি সিরিয়াল, ছায়াছবিতে পরকীয়া, অবৈধ ভালোবাসা, অশ্লীলতা, অন্যের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে হাইলাইট করা, নগ্নতা, পর্নো ছবির দৌরাত্ম্য, সহজলভ্যতা, আমাদের পবিত্র ভালোবাসা ও চিরায়ত সম্পর্কগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে। সবাই বল্গাহীন স্রোতে গা ভাসিয়ে ক্ষণিকের মোহে নীতি-নৈতিকতা ও সৎগুণগুলোকে  জলাঞ্জলি দিচ্ছে। নারীতে নারীতে, পুরুষে পুরুষে বিয়ে, লিভটুগেদার, গর্ভপাতকে বৈধতাদানের মাধ্যমে পারিবারিক কাঠামোকেই অস্বীকার করা হচ্ছে।

আসলে আমাদের সমাজকাঠামো, পারিবারিক সম্পর্ক দিন দিন পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। পারিবারিক নির্যাতন, সহিংসতা এক দিনে হুট করে শুরু হয়নি। প্রতিনিয়ত আমাদের আইন-কানুন এগুলো উৎসাহিত করেছে, হয়তো এগুলোর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিচার-বিবেচনা না করেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যার ফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে। নারীকে নগ্নতা, অশ্লীলতা, ভোগ্যপণ্য, যৌনতার প্রতীকে পরিণত হওয়া ও করা থেকে বের করে আনতে হবে। নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতার প্রচলিত সংজ্ঞা ও ধারণা পাল্টাতে হবে। সত্যিকার অর্থে নারীকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে হবে।

ইসলামে স্ত্রীকে ভালোবাসা, তার সঙ্গে গল্প-গুজব করা, সাংসারিক কাজে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একই প্লেটে আহার গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। স্ত্রীর এঁটো খাওয়াকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) তাঁর স্ত্রী হজরত আয়েশার সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করেছেন, তাঁর কোলে মাথা রেখে কোরআন তিলাওয়াত করেছেন। যথাযথভাবে স্ত্রীর হক আদায় করেছেন। বর্তমান সমাজে স্ত্রীর প্রতি সে ভালোবাসা কোথায়?

মানবসভ্যতার অমূল্য উপহার ‘পারিবারিক কাঠামো’ আজ অনেক দেশেই হুমকির সম্মুখীন। সমাজ গঠনের অপরিহার্য এই প্রতিষ্ঠানটি মানুষের ক্ষণিকের মোহ, আবেগ-উত্তেজনা, হিংসা-ক্ষোভের কারণে যেন ভেঙে না পড়ে, লকডাউনের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের সুযোগ নিয়ে বাসাবাড়িকে নির্যাতন সেলে পরিণত করতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার সময় দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। এটি কোনো দেশ বা অঞ্চলের নয়, এটি করোনার প্রাদুর্ভাবের মতো একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তাই নারী নির্যাতন ও তাদের প্রতি সহিংসতা রোধে বিশ্বের প্রভাবশালী ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ এবং এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। কে জানে, করোনাভাইরাস আমাদের সার্বিক জীবনাচরণে পরিবর্তন আনার জন্যই হয়তো এ ধরাধামে এসেছে।

লেখক : কলামিস্ট।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর