রবিবার, ১০ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার সংক্রমণ থেকে কৃষিকে বাঁচাতে হবে

শাইখ সিরাজ

করোনার সংক্রমণ থেকে কৃষিকে বাঁচাতে হবে

যে কোনো ক্রান্তিকাল পাড়ি দিতে প্রয়োজন ঐক্য ও সুপরিকল্পনা। ঐক্য গড়তে প্রয়োজন দৃঢ় নেতৃত্বের। যেহেতু কাজটা বড় ও চ্যালেঞ্জিং, একা করা সম্ভব নয়, তাই একটা ভালো দল গড়ে নিতে হয়, যেখানে দলের প্রত্যেকের একটা নির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকে। দলটির প্রত্যেকেই যখন তার নিজের দায়িত্বটুকু যথাযথ পালন করে, তখনই সাফল্য আসে। সমন্বয় এ ক্ষেত্রে একটি জরুরি বিষয়। যেমনটি করেছে জার্মানির কৃষি বিভাগ। জার্মানিতে বাংলাদেশের প্রবাসী কৃষক মোকতাজল হোসেন কাজলের কথা আগেও বলেছি। এ বিষয়ে তার কাছ থেকে যেমন জেনেছি। কৃষিবিষয়ক জার্নালগুলোয় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখেছি কৃষকের সমস্যায় কত দ্রুত সাড়া দিচ্ছে জার্মান সরকার। এই করোনা আক্রান্ত সময়ে কৃষি বিপর্যয় ঠেকাতে অন্য দেশগুলো কীভাবে ভাবছে, কী করছে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে স্মার্টফোনে কী চাই বললেই আলাদিনের দৈত্যের মতো হাজির করে রাজ্যের তথ্য। বিভিন্ন দেশের কৃষি দফতরের ওয়েবসাইট, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নানান তথ্য নিমিষেই চলে আসে। মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও কৃষি নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, করোনাভাইরাস মহামারীর ফলে এ বছর ফসলের দাম ১০% ও পশুর দাম ১২% হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা। তারা বলছে কৃষি ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে খারাপ বছর। কৃষকের নিট আয় ২০ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পেতে পারে বলেও ইঙ্গিত করেছে তারা। গবেষকদের এমন তথ্যের ভিত্তিতেই ট্রাম্প প্রশাসন দ্রুত ১৯ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনার পদক্ষেপ নিয়েছে। পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে অর্থ প্রদানের পাশাপাশি লাখ লাখ বেকার আমেরিকানকে খাদ্যসহায়তার জন্য কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি খাদ্য কেনার প্রকল্প। এতে কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সাপ্লাই চেনের ভারসাম্য রক্ষা পাবে। মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) সেক্রেটারি সনি পেরডু সাংবাদিকদের বলেছেন, এ কর্মসূচি কৃষকের লোকসান কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসার একটা প্রচেষ্টা। এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে, আমেরিকার কৃষি বিভাগ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বিভিন্ন গবেষকের দেওয়া তথ্য আমলে নিয়ে একটা কার্যকর পন্থা খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়েছে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোয় রোগাক্রান্ত ও মৃতের হার কমে এলেও এই মহামারী এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোয় দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী করোনাভাইরাস-উদ্ভূত লকডাউনের কারণে ২০২০ সালের শেষ নাগাদ নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের প্রায় ২৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষ তীব্রতর খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হবে।

আমাদের দেশে করোনা আক্রান্তের দুই মাস অতিবাহিত হয়েছে। ৮ মার্চ থেকে আমাদের সব খাত পড়েছে অচল অবস্থার মুখে। শুরু থেকে আমাদের কৃষি খাতও চরম অচলাবস্থার মুখে পড়ে। বিশেষ করে কৃষি উৎপাদনের নিত্যকার পরিবহন, বাজার তথা চাহিদা ও জোগানে চরম প্রভাব পড়ে। বাজার বন্ধ থাকায় গ্রামে কৃষকের খামারির উৎপাদিত পণ্যগুলো দিনের পর দিন নষ্ট হতে থাকে। সবজি চাষি তার পণ্যের মূল্য না পেয়ে চরম ক্ষতির শিকার হতে থাকে। এমন ক্ষতির সারিতে পড়ে পোলট্রি শিল্প, দুগ্ধ খামার, মাছ চাষসহ সব খাত। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কৃষিপণ্য সরবরাহের কিছু ব্যবস্থা অনুকূল করা হলেও কৃষক ও খামারি পর্যায়ে কোনো পণ্যেরই তেমন দাম নেই। এ ক্ষতি এখনো তারা গুনছে। করোনার ঝুঁকি, আক্রান্তের হার ও ভয়াবহতা কোনো কিছুই কমেনি কিন্তু এর মধ্যেই লকডাউনের অনেক কিছুই তুলে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল, জীবনযাপন কীভাবে সম্ভব হবে, তা কারোরই মাথায় আসছে না।

প্রশ্ন হলো, কৃষির এ ক্ষতি কীভাবে দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব? এ নিয়ে বেশ কয়েকজন কৃষক ও খামারির সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলছেন, কৃষিতে ইতিমধ্যে যারা বহুমুখী ক্ষতির শিকার হয়েছেন তাদের যতদ্রুত সম্ভব সরকারি প্রণোদনা দেওয়া যায়, তারা তত দ্রুত আগামী মৌসুমের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবেন। কিন্তু প্রণোদনা সাধারণ কৃষক, খামারির হাতে পৌঁছবে ব্যাংকের মাধ্যমে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত মাসের ১২ তারিখ ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি সব তফসিলি ব্যাংক এ টাকা ৪% সুদে কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা। এ লেখা যখন লিখছি ঘোষণার প্রায় এক মাস হতে চলল, খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি দু-একটি ব্যাংক ছাড়া অধিকাংশ ব্যাংকই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। এ বিষয়ে কথা বলেছি বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষিঋণ শাখার মহাব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। কথা বলেছি সোনালী, রূপালী ও কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে। তারা বলছেন, খুব দ্রুতই প্রস্তুতি নেবেন। কিস্তু আমরা দেখেছি আমেরিকা বা জার্মানির মতো দেশগুলোয় কত দ্রুত কৃষকের অ্যাকাউন্টে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে সরকারি প্রণোদনা। কৃষক বা খামারির যদি দ্রুত ঋণপ্রাপ্তি সম্ভব হতো তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী-ঘোষিত প্রণোদনার যে সুফল তা কৃষক বা খামারির কাছে পৌঁছে যেত। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কৃষকের ফোন পাচ্ছি আমি। তাদের অনেকেই বলছেন ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে কৃষিঋণ পেতে হলে বকেয়া কোনো খাজনা থাকলে তা পরিশোধ করে নিতে হবে। কৃষক বলছেন, খাজনা দেওয়ার জন্য তারা অফিসে গিয়ে দেখছেন অফিস বন্ধ। ফলে তারা একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। এসব বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হই কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক সাহেবের। তিনি আশ^স্ত করেছেন, এ সংকটগুলো নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন। আমাদের প্রধান ফসল বোরো কাটার ক্ষেত্রে শ্রমিক সংকট এড়াতে সরকার বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর ফলে বোরো ধান কেটে ঘরে তোলার ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হয়েছে। আমাদের গ্রামীণ জীবনব্যবস্থা কৃষি উৎপাদনভিত্তিক। আজকের দিনে শুধু কৃষক নয়, অসংখ্য স্বল্পায়ী নানা পেশার মানুষ তার প্রতিদিনের শ্রম, নিষ্ঠা, বুদ্ধি ও জ্ঞান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। চারদিকে সব কিছু অচল থাকায় সব পেশার মানুষেরই জীবন-জীবিকা অচল হয়ে পড়েছে। এ একই চিত্র আছে শহরেও। করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম মাসে শহরে ও গ্রামে সাধারণ মানুষের মাঝে খাদ্যসহায়তা বিতরণের যে তৎপরতা দেখা যায়, তাতে বেশ ভাটা পড়েছে। রোজার দিন হওয়ায় দিবাভাগে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের খাদ্য চাহিদা চোখে পড়ছে না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে অগণিত মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। তারা বর্তমানটিই চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। ভবিষ্যৎ কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেই সমীকরণ খুঁজে পাচ্ছে না। দেশের অধিকাংশ স্থানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা একটি সচ্ছলতার ভিতর দিয়ে চলছিল, সামাজিক মর্যাদা ও সম্মানের কারণে তারা মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে পারে না, এই শ্রেণিটি আছে সবচেয়ে বিপদে। সমাজের অনেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি, ভিতরে ভিতরে চেষ্টা করছেন এমন মানুষ খুঁজে খুঁজে খাদ্যসহায়তা পৌঁছে দিতে। আমাদের এই বিপদের ভিতর এমন অনেক ইতিবাচক নজিরও আছে।

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপ অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক আঘাতে গ্রাম পর্যায়ে প্রায় ৩২ শতাংশ পরিবার খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। যেহেতু এ মুহূর্তে অভাবের মধ্যে দিনযাপন করা মানুষের কেউ কর্মসূচি থেকে বাদ পড়লে তার ক্ষতি হতে পারে অনেক, তাই এই ‘নতুন দরিদ্র’ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা ও সাহায্য প্রদানে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদে সবার মধ্যে নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছিল পঙ্গপাল। বিষয়টি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেওয়ার জন্যই কক্সবাজারের টেকনাফে দেখা দেওয়া আলোচিত পোকার ঝাঁকের নমুনার ছবি পাঠাই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সদর দফতরে দায়িত্বরত সিনিয়র লোকাস্ট ফরকাস্টিং অফিসার কিথ ক্রেসম্যানের কাছে। তিনি দেখে সেটি পঙ্গপাল নয় বলে জানান। এ বিষয়ে তার সঙ্গে আমার সুদীর্ঘ আলোচনা হয় ভিডিওকলে। তিনি বাংলাদেশে পঙ্গপালের আক্রমণের আশঙ্কাকে নাকচ করে দেন। বলেন, দুটি কারণে বাংলাদেশে পঙ্গপালের আক্রমণের আশঙ্কা নেই। এক. বাংলাদেশের আবহাওয়া পঙ্গপালের অনুকূলে নয়, বাংলাদেশ অনেক সবুজ। দুই. বাতাসের গতিপথ বাংলাদেশমুখী নয়। পঙ্গপাল সাধারণত বাতাসের গতির সঙ্গে চলে।

কিথ ক্রেসম্যান, মরু অঞ্চলের পঙ্গপাল দমন ও পূর্বাভাস বিষয়ে এফএওর বিশেষ কমিশনপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ। তার অবস্থান থেকে আমাদের দেশে গত কয়েক বছর ভুট্টায় দেখা দেওয়া ফল আর্মি ওয়ার্ম নিয়েও বেশ কার্যকর ধারণা দেন। তিনি বলেন, ফল আর্মি ওয়ার্ম রোধে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপটি হচ্ছে আক্রান্ত গাছটির পোকাটিকে বের করে এনে দুই আঙুলে ঘষে মেরে ফেলা। আক্রান্ত গাছটিকে উপড়ে ফেলা। আবার একটু দৃষ্টি দিতে চাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। গোটা ইউরোপ-আমেরিকায় এবার অভিবাসী কৃষিশ্রমিকের ব্যাপারে সরকারগুলো সতর্কতা অবলম্বন শুরু করেছে। কোনো দেশই চাইছে না শতভাগ বিদেশি শ্রমিকের ওপর নির্ভর থাকতে। বরং বিভিন্ন খাতে বেকার হয়ে পড়া কর্মী ও শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীকে যতটা সম্ভব কৃষিতে যুক্ত করতে নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন পেশার মানুষ প্রায় দুই মাস বেকার থেকে এখন কৃষিতে যুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করছে।

আগামী পরিস্থিতি কোথায় যাবে, এখনই কারও পক্ষে অনুমান করা সম্ভব হচ্ছে না। আমি আশাবাদী, কৃষি উৎপাদনের গতি ধরে রাখা গেলে হয়তো আমাদের খ্যাদ্যাভাবে পড়তে হবে না, কিন্তু সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বড় এক পরিবর্তন হয়তো ঠেকানো যাবে না। মাহে রমজানের বরকতের দিনগুলো চলছে। এগিয়ে আসছে ঈদুল ফিতর। ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের তৃণমূল ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের যে অর্থনৈতিক উপার্জনের লক্ষ্যমাত্রা থাকে, তাতে এবার বেশ ছেদ পড়বে। কোনো মানুষের ঘরেই ঈদের স্বাভাবিক আনন্দ ফিরে আসবে না। অনেকের ঘরেই ঈদ আসবে কষ্ট, বিষাদ আর যন্ত্রণার ভিতর। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, মানুষের কাছে এই দিনগুলো সহজ হয়ে উঠুক।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর