রবিবার, ১০ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে সম্মুখ সমরে লড়ছেন যারা

তপন কুমার ঘোষ

মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে সম্মুখ সমরে লড়ছেন যারা

করোনা আতঙ্কে বিশ্বজুড়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কবে করোনা থেকে মুক্তি মিলবে কেউ জানে না। প্রকৃতির কাছে মানুষ আজ বড্ড অসহায়! এই দুঃসময়ে করোনা রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। ফ্রন্টলাইন বা সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়ছেন তারা। দিনরাত এক করে ফেলেছেন। সংক্রমণের ভয়ে বাড়িতে অস্থায়ী গৃহকর্মীদের সবেতন ছুটি দেওয়া হয়েছে। শিশুসন্তানকে বাসায় রেখে হাসপাতালে করোনা রোগীদের সেবা দিচ্ছেন অনেক চিকিৎসক দম্পতি। বাসায় অসুস্থ বাবা-মা। ছেড়ে আসতে হয়েছে তাদের। অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলাতেই এদের যত আনন্দ। যারা করোনা রোগীদের চিকিৎসা করছেন তারা ডিউটির দিনগুলোয় টানা সাত দিন বাড়ি যেতে পারবেন না। এরপর কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে টানা ১৪ দিন সরকারি ব্যবস্থাপনায়। তিন সপ্তাহ ভুলে থাকতে হচ্ছে ঘরসংসার। কিন্তু চাইলেই কি আর ভুলে থাকা যায়! পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম মুঠোফোন। কোয়ারেন্টাইনে থাকাকালে দুবার নমুনা টেস্ট করা হবে। টেস্টের ফল নেগেটিভ হলেই একমাত্র পরের সাত দিন ছুটি মিলবে। আমাদের চিকিৎসক ও চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের অভিযোগের শেষ নেই। অভিযোগগুলো সবাই জানেন। নতুন করে আর বলার কী আছে। চিকিৎসাব্যবস্থায় অনেক গলদ আছে। কিন্তু ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো মানুষ দ্রুত লুফে নেয়। রোগীর মৃত্যুর পর ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে অনেক সময় ডাক্তারদের ওপর হামলা করা হয়। ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। এর ফলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো আড়ালে চলে যায়। আমরা এ কথা মানতে নারাজ যে, ডাক্তারদের বিরুদ্ধে এই সাধারণ অভিযোগগুলো সব বা অধিকাংশ ডাক্তারের ক্ষেত্রে সত্য। নিবেদিতপ্রাণ ডাক্তার সমাজে অনেক আছেন, মানবসেবাকে যারা জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তবে এও মানতে হবে, সবাই ধোয়া তুলসীপাতা নন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করোনা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে। ফলে দেশের কোনো কোনো প্রান্তে অতি উৎসাহী কিছু লোকের দ্বারা চিকিৎসাকর্মীরা হেনস্তার শিকার হয়েছেন। ভাড়াবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া বা বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। নারায়ণগঞ্জে করোনা আক্রান্ত চিকিৎসক পরিবারকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। গোপালগঞ্জে এক নারী স্বাস্থ্যকর্মীকে পুকুরের মধ্যে তালপাতা দিয়ে একটা ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে সেখানে রাখা হয়। ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি চাকরি করতেন। করোনাভাইরাসের কারণে তিনি ছুটি নিয়ে বাড়ি আসেন। কি অমানবিক! রাজশাহীতে সরকারি হাসপাতালের একজন আয়াকে তার ভাড়াবাড়িতে ঢুকতে বাধা দেন বাড়ির মালিক। অবশ্য সব ক্ষেত্রেই বিষয়গুলো প্রশাসনের নজরে আসার পর এর সুরাহা করা হয়। সামাজিক দূরত্ব (নির্দিষ্ট শারীরিক দূরত্ব) বজায় রাখার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন না অনেকে। শাঁখের করাতের মধ্যে পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষ। একদিকে জীবন, অন্যদিকে জীবিকা- দুটোর কথাই ভাবতে হচ্ছে। পেটের দায়ে দিশাহারা হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে অনেকে। পেটের দায় বড় দায়। ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, উপসর্গ না থাকা সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে নাকি করোনাভাইরাসের উপস্থিতি মিলেছে। তাহলে তো আমাদের অজান্তেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। এ তো ভয়াবহ বিপদের কথা! প্রতিদিন টেলিভিশনের পর্দায় আমরা ইউরোপ-আমেরিকায় মৃত্যুর মিছিল দেখছি। নিজের চোখে দেখা নয়। তাই হয়তো মালুম হচ্ছে না করোনা সংকটের ভয়াবহতা। আগুনের আঁচ নিজের গায়ে না লাগা পর্যন্ত আমাদের কি হুঁশ হবে না! চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট কর্মীরা প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। করোনা রোগীর চিকিৎসার দায়িত্বে নিয়োজিত সিলেটের একজন ডাক্তার নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের ১১ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী। এ হার বৈশ্বিক হারের চেয়ে সাত গুণ বেশি। ৩০ এপ্রিল বিকাল পর্যন্ত ডাক্তার, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মী মিলিয়ে মোট ৮৮১ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন (প্রথম আলো, ১ মে, ২০২০)। এর মধ্যে ৩৯২ জনই ডাক্তার। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত না করলে তারা দায়িত্ব পালন করবেন কীভাবে? আমাদের প্রয়োজনেই তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে যা যা করা দরকার তা করতে আমাদের কসুর করলে হবে না। বাড়িয়ে দিতে হবে সহযোগিতার হাত। করোনা-আবহে দেশে-বিদেশে প্রচন্ড চাপের মধ্যে আছেন চিকিৎসকরা। ফলে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন অনেকেই। লাশের সারি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন এক শীর্ষ মার্কিন চিকিৎসক (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৮ এপ্রিল, ২০২০)। মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে শেষমেশ আত্মহননের পথ বেছে নেন ওই চিকিৎসক। বিশ্বজুড়ে করোনা ঝড় একদিন থেমে যাবে। পৃথিবী আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসবে। সমালোচনা শিকেয় রেখে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের নতুন করে চিনতে হবে। ডাক্তারদের উপযুক্ত মর্যাদা না দিলে ভবিষ্যতে মেধাবী ছাত্রছাত্রী এ পেশায় আর আসবে না। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও হাসপাতালের ভিতরটা সামাল দিচ্ছেন ডাক্তার, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। বাহিরটা সামাল দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সেনাবাহিনী ও প্রশাসন। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে মাঠে আছেন ব্যাংক কর্মীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরাও সংবাদ সংগ্রহ করছেন। নিজের জীবন বিপন্ন করে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য যুদ্ধরত সম্মুখ সারির এই যোদ্ধাদের ত্যাগের কথা জাতি অনেক দিন মনে রাখবে।

লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর