সোমবার, ১১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

একটি আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু

এম জে আকবর - অনুবাদ : আনোয়ার হোসেন মঞ্জু

একটি আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু

এম জে আকবর

[ইতিহাসে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৬৩তম বার্ষিকী ১১ মে। ১৮৫৭ সালের এই দিনে উত্তর প্রদেশের মিরাটে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে দেশীয় সিপাহিরা দিল্লিতে চলে আসে এবং শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে তাদের নেতা নির্বাচিত করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। কিন্তু এ বিদ্রোহ সফল হয়নি। ১৩০ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিদ্রোহী বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। বাহাদুর শাহ জাফরকে বন্দী করে তার বিচার করা হয়। এ বিচার প্রক্রিয়ার ওপর ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এইচ এল ও গ্যারেটের ‘দ্য ট্রায়াল অব বাহাদুর শাহ জাফর’-এ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন ভারতের খ্যাতিমান সাংবাদিক এম জে আকবর। দীর্ঘ ভূমিকাটির বাংলা অনুবাদ উপস্থাপন করা হলো।]

ঠিক কবে মোগল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটেছিল? ১৭০৭ সালের মার্চ মাসে আহমদনগরে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সঙ্গে? অথবা ১৭১৭ সালে, যখন একটি মোগল ফরমানের অধীনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম প্রজন্মের ‘নবাবদের’ এদেশে লবণ, সোরা (বারুদ তৈরির কাজে ব্যবহৃত পটাশিয়াম নাইট্রেট), সুপারি, আফিন ও তামাকের ব্যবসার ওপর থেকে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছিল; যে নবাবরা তাদের নিজ দেশে গিয়ে সম্পদের নতুন অর্থ খুঁজে পেত। এটি ঘটেছিল ফররুখশিয়ারের সময়, যখন তাঁর দরবার ‘মর্দ-ই-ময়দান’ অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রের বীরের পরিবর্তে পরিচিতি লাভ করেছিল ‘শের-ই-কালিন’ বা গালিচার সিংহে।

মোহাম্মদ শাহ ক্ষয়িষ্ণু মোগল সিংহাসনে ছিলেন দীর্ঘ ২৯ বছর এবং তিনি তাঁর বিলাস বাহুল্যের কারণে খ্যাতি লাভ করেন ‘রঙিলা’ হিসেবে। তাঁর সময়েই কী মোগল সাম্রাজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটে? নাকি যখন মেজর হেক্টর মুনরো ১৭৬৪ সালের ২৩ অক্টোবর বক্সারে শাহ আলম, সিরাজ-উদ-দৌলা ও মীর কাসিমের বিশাল কিন্তু বিশৃঙ্খল বাহিনীকে পরাজিত করে প্রাচীন রাজবংশের মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছিলেন? ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট লর্ড ক্লাইভ যখন এলাহাবাদে পরাজিত মোগল সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে সমৃদ্ধ বাংলার দিওয়ানি গ্রহণ করেন, যার বদৌলতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির দরবারকে বার্ষিক মাত্র সোয়া তিন লাখ পাউন্ড প্রদানের বিনিময়ে পূর্ব ভারতের বিশাল একটি অংশের ভূমি রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে (কোম্পানি লন্ডনের অনুমতি লাভ করেছিল পার্লামেন্টকে বার্ষিক চার লাখ পাউন্ড প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে)। এই সিদ্ধান্তের পরিণতি ছিল চরম- লন্ডনে কোম্পানির শেয়ার মূল্যের পতন ঘটে, আন্তর্জাতিক ঋণ সংকটের সৃষ্টি হয় এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। অন্যদিকে ভূমি রাজস্ব আদায়ের নামে বাংলায় টানা পাঁচ বছর ধরে যে দুর্দশা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার অনিবার্য পরিণতি ছিল ১৭৭০ সালের মহাদুর্ভিক্ষ। পাঁচ বছরে নতুন প্রভুদের অত্যাচারে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ক্ষুধা অথবা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এ প্রসঙ্গে হোরাস ওয়ালপোল (Horace Walpole) নামে একজন লেখক লিখেছেন, ‘ভারতবাসী এবং সেখানে বসবাসকারী সাধারণ ইংলিশদের ওপর কোম্পানির চাকরিতে নিয়োজিত ও অনুগতদের অত্যাচারের মাত্রা এত ভয়াবহ ছিল যে এ খবর এখন ইংল্যান্ডে পৌঁছেছে এবং এখানে হৈচৈ শুরু হয়েছে। এ ধরনের একচেটিয়াবাদের কারণে বাংলায় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়েছে এবং সেই দুর্ভিক্ষে ত্রিশ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটেছে। এহেন অপরাধের ছিটেফোঁটাই আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট।’

অথবা মোগল সাম্রাজ্যের অবসানের ক্ষেত্রে আমরা কি ১৭৮৯ সালের আগস্ট মাসে অসহিষ্ণু, রক্তপিপাসু রোহিলা গোলাম কাদির কর্তৃক বয়োবৃদ্ধ মোগল সম্রাট শাহ আলমের বুকের ওপর বসে নিজের ছুরি দিয়ে তার চক্ষু উৎপাটনের ঘটনাকে ধরে নেব- যখন শাহ আলম আর্তনাদ করে রোহিলা নেতার করুণা কামনা করেছিলেন যে, এই চোখ দুটি ষাট বছর ধরে পবিত্র কোরআন পাঠের কাজে যে ব্যক্তি নিয়োজিত ছিল? সম্ভবত মোগল সাম্রাজ্যের প্রকৃত মৃত্যুক্ষণ ছিল ১৮০৩ সালের ডিসেম্বর মাস, যখন জেনারেল জেরার্ড লেক তাঁর পূর্বসূরি আর্থার ওয়েলেসলি কর্তৃক সেপ্টেম্বর মাসে আসায়’তে সিন্ধিয়াদের বিরুদ্ধে বিজয়ের পথ অনুসরণ করেছিলেন। তিনি দিল্লিতে প্রবেশ করে শূন্য প্রাসাদে একজন অন্ধ ব্যক্তির রক্ষাকর্তায় পরিণত হন। এর আগে কোম্পানি আসরিগড়ের মারাঠা দুর্গ দখল করেছিল সেই দুর্গের সিপাহিদের বকেয়া সাত লাখ রুপি বেতন পরিশোধ করে। ১৮১৩ সালে কলকতায় গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টো মোগল সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি হিসেবে দিল্লির দরবারে খিলাত প্রদানে অস্বীকার করার সময়ে কি মোগল সাম্রাজ্য কফিনে আশ্রয় নিয়েছিল?

সম্ভবত ১৮১৬ সালে, যখন লর্ড হেস্টিংস মোগল টাকশাল বাতিল করে ব্রিটিশ রুপিকে সাম্রাজ্যের প্রকৃত মুদ্রায় পরিণত করেন। সম্রাট আকবর ও আওরঙ্গজেবের প্রতিষ্ঠিত বিশাল মোগল সাম্রাজ্য উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ব্রিটিশ প্রহরাধীনে যমুনা তীরবর্তী কিছু এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের বংশধর পরিণত হন একজন ভিক্ষুকে এবং কল্পনার রাজ্যে বসবাসকারী মোগল সম্রাট পারিবারিক ব্যয় নির্বাহের জন্য তাঁর ভাতা বৃদ্ধির জন্য করুণ ভাষায় দরখাস্ত প্রেরণ করতে থাকেন। কিন্তু সে ভাতা কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়া ছিল না। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাদের শাসনের কর্তৃত্ব মেনে নেওয়ার শর্তে ভাতার পরিমাণ ১২ লাখ রুপি থেকে ১৫ লাখ রুপিতে উন্নীত করার প্রস্তাব দেয়। মোগল বাদশাহ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও তা ছিল অযৌক্তিক। ১৮৪৩ সালে লর্ড অ্যালেনবরো ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে সম্রাটকে খিলাত প্রদানের রীতির অবসান ঘটান এবং এর ক্ষতিপূরণ বাবদ মাসিক ৮৮৩ রুপি প্রদান করেন, যা গৃহীত হয়। ব্রিটিশ করুণার কাছে মোগল মর্যাদার বিনিময় এভাবেই চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। মোগল উত্তরাধিকারী নিয়োগের বিষয়টি বাতিল করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ পরামর্শ দেয় যে পরবর্তী মোগল বংশধররা লাল কিল্লা ত্যাগ করে কুতুব মিনারের নিকটবর্তী আবাসেই ভালোভাবে থাকবেন। ব্রিটিশ কর্তারা লাল কিল্লাকে তাদের অস্ত্রাগারে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। ১৮৫৬ সালে মোগল উত্তরাধিকারী ফখরুদ্দীনের মৃত্যুর পর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় যে মোগল উত্তরাধিকারের পরবর্তী দাবিদারদের ‘বাদশাহ’ উপাধি ধারণের অধিকার দেওয়া হবে না।

১৮৫৭ সালে মোগল সাম্রাজ্যের মৃত্যু ঘটেনি। সেই বহুল আলোচিত বছরে মৃত্যু ঘটেছিল একটি আকাক্সক্ষার। এটি ছিল প্রচন্ড শক্তিশালী একটি আকাক্সক্ষা দুই শতাব্দীর সমৃদ্ধপূর্ণ স্থিতিশীলতাই নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, সব ধরনের সমস্যা, অদক্ষতা সত্ত্বেও মৃত্যুশয্যায় থেকেও মোগল সাম্রাজ্য আরও একশ বছর টিকে থাকবে। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর দুই দশকের মধ্যে যারা হিন্দুস্তানকে খন্ডবিখন্ড করে ফেলেছিল, বিভিন্ন অঞ্চলের সেসব শাসক, নওয়াব ও রাজাদের শক্তির বলে নয়, বরং মোগল সাম্রাজ্য টিকে ছিল মোগলদের প্রতি জনপ্রিয় রহস্যময়তা ও শ্রদ্ধায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর অবক্ষয় ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থ আদায়ের বাড়াবাড়ির কারণে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে হিন্দুস্তানের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির নস্টালজিয়া নিশ্চিতভাবেই মানুষের মধ্যে ফিরে এসেছিল। সাম্রাজ্যের আবির্ভাব আকস্মিক হলেও এর টিকে থাকার বিষয়টি আকস্মিক নয়। একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, রাজকীয় মৈত্রী, ন্যায়বিচারের চেতনা দ্বারা বিকশিত প্রশাসনিক বিধান, স্থানীয় রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধা ছিল মোগল শাসনের স্তম্ভ। সম্রাট আকবরের শাসনামলের প্রথম বিবরণী ‘তারিখ-ই-আকবরী’র বর্ণনা অনুসারে শাহী আস্তাবলে পাঁচ হাজার হাতির জন্য দৈনিক ব্যয় ছিল এক লাখ রুপির অধিক। সমসাময়িক অন্যান্য ইতিহাসবিদও একই ধরনের হিসাব দিয়েছেন।

মোগলরা অবশ্যই যুদ্ধ করেছেন; কিন্তু শুধু যুদ্ধই তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের একমাত্র কৌশল ছিল না। আকবরের এক দরবারি তাঁকে পরামর্শ দেন তাঁর প্রতিপক্ষ সবাইকে ধ্বংস করতে। কিন্তু আকবর উত্তর দেন যে তাঁর হিসাব অনুযায়ী হিন্দুস্তানে ৩২০ জন রাজা আছেন, যাদের শক্তিশালী বা বিশাল দুর্গ রয়েছে। এক একটি দুর্গ জয় করতে তাঁর ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগবে। সে হিসেবে সমগ্র হিন্দুস্তান দখল করতে তাঁর প্রায় ২৩০ বছর প্রয়োজন। এর পরিবর্তে তিনি রাজাদের তাঁর নিরাপত্তা ও মিত্রতার প্রস্তাব দেন এবং তারা তাঁর বিকাশমান সামাজ্যে তাদের পছন্দ অনুযায়ী অভিজাত হিসেবে থাকতে পারেন মর্মেও আশ্বাস প্রদান করেন।

আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীরের শাসনামলের বিবরণী ‘জাহাঙ্গীরনামা’র প্রথম অংশে একটি মিনিয়েচার চিত্রে জাহাঙ্গীরকে দেখানো হয়েছে ফেরেশতা পরিবৃত অবস্থায়, যিনি এক কুৎসিত দর্শন বৃদ্ধ লোককে মাথায় তীরবিদ্ধ করে হত্যা করছেন। বীরেরা কখনো অসহায় বৃদ্ধকে হত্যা করে না, তারা যত কদর্য দর্শনই হোন না কেন। আওরঙ্গজেব তাঁর মৃত্যুর তিন বছর আগে ১৭০৪ সালের হিন্দুদের ওপর থেকে জিজিয়া কর প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন, তা বিধর্মীদের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কারণে নয়, বরং মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়ে হিন্দু কৃষকরা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল বলে। মোগল সম্রাটদের অনেক উপাধির একটি ছিল ‘গরিবের সেবক’। সফল বাদশাহরা জানতেন যে তাদের ক্ষমতার ভিত্তিই হচ্ছে এ ধরনের দায়িত্বশীলতা। পর্তুগিজ পর্যটক ফ্রে মারিগ (Fray Marrigue), যিনি ১৬৪০ সালে ঢাকা সফর করেন, তিনি মোগল ন্যায়বিচারের বর্ণনা দিয়েছেন- এক কাজী জনৈক মুসলিমকে শাস্তি প্রদান করেন হিন্দু গ্রামে দুটি ময়ূর হত্যা করার কারণে। কাজী তাঁর ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, ১৫৭৫ সালে আকবর যখন বাংলা জয় করেন তখন বাঙালিদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে স্থানীয় আইনে স্থানীয় রীতিপ্রথা ও সংস্কৃতিকে সম্মান দেওয়া হবে এবং তাঁর বিচার সেই প্রতিশ্রুতিরই বাস্তবায়ন।

সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর শাসনামলে এ দেশবাসীকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাতে দারিদ্র্য দূর হয়নি; কিন্তু এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছিল। নিক রবিনস  (Nick Robins) তাঁর ‘দ্য করপোরেশন দ্যাট চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড’ (The Corporation That Changed The World)  গ্রন্থে দুর্ভিক্ষের সময়ে মোগল ও ব্রিটিশ নীতির মধ্যে তুলনা করেছেন; ‘দুর্ভিক্ষ হাজার বছর যাবৎ ভারতের সামাজিক বাস্তবতার অংশ ছিল, যা সত্যিকার অর্থে নির্মূল হয়েছে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর।’ প্রথম দিকের ইংলিশ পর্যটকরা ১৬৩১ সালের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ বিস্তার দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে মন্তব্য করায় স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। তা সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষের ঘটনা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় প্রথমত কোম্পানির অধীনে, এরপর ব্রিটিশ শাসনাধীনে। বাস্তবে হিন্দুস্তানে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়েছিল ১৭৭০ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে এবং শেষও হয়েছিল দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে এবং সেটিও ঘটে বাংলায়, ১৯৪৩ সালে।

১৮৮৭ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মধ্যে কাজ করে কর্নেলিয়াস ওয়াটফোর্ড (Cornelius Watford) অনুমান করেন যে, সেই বছরের দুর্ভিক্ষে এক কোটি মানুষ মারা গেছে এবং তাঁর হিসাব অনুযায়ী ওই সময় পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনের ১২০ বছরের মেয়াদে হিন্দুস্তানে ৩৪টি দুর্ভিক্ষ হয়েছে এবং এর তুলনায় বিগত দুই হাজার বছরের ইতিহাসে হিন্দুস্তানে দুর্ভিক্ষ হয়েছে ১৭ বার। মোগলরা বর্ষা মৌসুমের বন্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে সত্য, কিন্তু অমর্ত্য সেন যা নিশ্চিত করেছেন মোগলরা সেই সত্য সম্পর্কে জানত যে, ‘দুর্ভিক্ষ মুখ্যত মানুষ দ্বারা সৃষ্ট’। রবিনস আরও বলেছেন, ‘দুর্ভিক্ষের বহু কারণের মধ্যে একটি ছিল কোম্পানি কর্তৃক জনবিধি ও বিনিয়োগের মোগল পদ্ধতি পরিহার করা।’ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ মোগল শাসনকে বিবেচনা করেছে পুরনো ধাঁচের সুশাসন বলে ‘মোগলরা কর রাজস্বকে শুধুমাত্র পানি সংরক্ষণের জন্যই ব্যয় করেনি, বরং এর দ্বারা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে এবং যখনই কোথাও দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা গেছে তখন তারা খাদ্য রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, মূল্য নিয়ন্ত্রণ, কর রেয়াত এবং বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করেছে। কিছু নিষ্ঠুর আচরণও অবশ্য করা হয়েছে, দুর্ভিক্ষের সময় কোনো ব্যবসায়ীকে যদি কৃষকের কাছে খাদ্যশস্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ওজনে কম দিতে দেখা যেত তা হলে অভিযুক্ত ব্যবসায়ীর শরীর থেকে সমপরিমাণ মাংস কেটে কৃষকের কাছে পেশ করা হতো।’

১৭৭০ সালে লাখ লাখ বাঙালি কেন মারা গিয়েছিল? নিক রবিনস লিখেছেন, ‘প্রাকৃতিক চক্রের বিগত বছরগুলোর ব্যর্থতার মতো ১৭৬৯ সালের অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত জনিত ক্ষয়ক্ষতি অধিক সংখ্যক জীবনহানির ঘটনা ছাড়াই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে বাংলার অসহায়ত্বকে বিপর্যয়মূলক ও লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি করেছিল। বিগত দশকগুলোতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও কোম্পানির নির্বাহীরা বাংলাকে নিদারুণভাবে শোষণ করার মধ্য দিয়ে ভূখন্ড টিকে সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছিল। কোম্পানি কর্তৃক বাংলার দিওয়ানি গ্রহণের এক বছর আগে যেখানে বার্ষিক রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ছয় লাখ ছয় হাজার পাউন্ড, সেই পর্যায় থেকে রাজস্ব আদায় নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় কোম্পানি দিওয়ানি গ্রহণের পর; অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ লাখ পাউন্ড। ১৭৬৯ সালে মুর্শিদাবাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেসিডেন্ট রিচার্ড বেচার কিছুটা লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করেন, ‘এ দেশের মানুষের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘এই মনোরম দেশটির সমৃদ্ধি সাধিত হয়েছিল দেশটি যখন অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী সরকারের অধীনে ছিল। কিন্তু এ ভূখন্ড এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে যখন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রশাসনের সিংহভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।’ এখানেই একটি ঘটনা বিদ্যমান। শাহ আলম স্পষ্টতই বার্ষিক সোয়া তিন লাখ পাউন্ড পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছিলেন। কারণ তাঁর ধারণা ছিল যে এই পরিমাণ অর্থই হবে মোট আয়ের অর্ধেক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঙ্ককে চার গুণের অধিক বৃদ্ধি করার মধ্য দিয়ে দেশটিকে বিরান করে ফেলেছিল। এ থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলা ও সমগ্র হিন্দুস্তান কতটা সমৃদ্ধ ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে সমুদ্র পথে বিশ্ব বাণিজ্যের দুই-তৃতীয়াংশের ওপরই দখল ছিল হিন্দুস্তান ও চীনের।

১৮৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে বিজয় লাভের পর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নর লর্ড ক্লাইভ যখন বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেন তখন নগরীর সমৃদ্ধি দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। ‘মুর্শিদাবাদ নগরী লন্ডনের মতোই বিরাট, জনবহুল ও সমৃদ্ধ; পার্থক্যের মধ্যে দেখা যায় যে প্রথম নগরীর বাসিন্দারা দ্বিতীয় নগরীর যে কোনো বাসিন্দার চেয়ে অনেক বেশি সম্পদের মালিক।’

লর্ড ক্লাইভ যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন তখন তাঁকে ব্রিটেনের সবচেয়ে ধনবান ব্যক্তি হিসেবে সন্দেহ করা হতো। পর্তুগিজরা কেরালার বন্দর নগরী কালিকটে অবতরণ করেছিল, যা লিসবনের চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ নগরী ছিল।

১৭৬৯ সালে বাংলা ছিল চরম দুর্দশাগ্রস্ত। লর্ড ক্লাইভ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন, ‘ফ্রান্স ও স্পেন মিলিতভাবে যতটা সমৃদ্ধ, ব্রিটেন তার চেয়েও বেশি সমৃদ্ধ, জনবহুল ও সফল একটি ভূখন্ডের ওপর সার্বভৌমত্ব লাভ করেছে। তারা দুই কোটি পরিশ্রমী প্রজার মালিক, এই ভূখন্ড থেকে বার্ষিক পঞ্চাশ থেকে ষাট লাখ পাউন্ড প্রকৃত আয় করা সম্ভব হবে।’ এ ছাড়া তাঁর ব্যক্তিগত বর্ণনা অনুসারে কিছু সম্পদের হিসাব রয়েছে যা তিনি আহরণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে ১৭৭২ সালে তিনি পার্লামেন্টে বলেন, ‘আমার সন্তুষ্টির ওপর নির্ভর করতেন একজন যুবরাজ, আমার কৃপার অধীনে ছিল একটি সমৃদ্ধ নগরী, সেই নগরীর ধনী মহাজনরা আমার হাসি উপহার পাওয়ার জন্য একজন আরেকজনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতো, আমি তাদের সিন্দুকের সামনে দিয়ে যেতাম, তারা খুলে দিতো সিন্দুকগুলো। সোনা ও মণিরতেœ ঠাসা থাকত সেসব সিন্দুক।’

ব্রিটিশ গবেষক পল কেনেডি (Paul Kennedy) তাঁর ‘দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অব দ্য গ্রেট পাওয়ার্স’ (The Rise and Fall of the Great Powers)  গ্রন্থে পলাশী যুদ্ধের পূর্বেকার ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছেন। ১৭৫০ সালে অর্থাৎ যুদ্ধের সাত বছর আগে পৃথিবীতে প্রস্তুত পণ্যের ২৪.৫ শতাংশ উৎপাদিত হতো হিন্দুস্তানে, আর পণ্য প্রস্তুতে সমগ্র ইউরোপের অংশ ছিল ২৩.২ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যের অংশ ছিল মাত্র ১.৯ শতাংশ। অপরদিকে প্রস্তুত পণ্যের ৩২.৮ শতাংশ উৎপাদন করত চীন, ৩.৮ শতাংশ জাপান, ৫ শতাংশ রাশিয়া, ৪ শতাংশ ফ্রান্স এবং ২.৯ শতাংশ উৎপাদিত হতো হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্য (অস্ট্রীয় সাম্রাজ্য)। ১৯০০ সালের মধ্যে এই চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। তখন প্রস্তুত পণ্যের ১৮.৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় যুক্তরাজ্যে, আর ভারতের অংশ নেমে আসে মাত্র ১.৭ শতাংশে। ১৮৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধ এবং ১৮৫৭ সালে দিল্লিতে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহের একশ বছরের মধ্যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সাফল্যের সঙ্গে অনেক অর্থনৈতিক কৃতিত্ব তাদের অনুকূলে নিতে সক্ষম হয়েছিল। দুই প্রতিপক্ষ সেনাবাহিনীর মধ্যে শক্তির ভারসাম্য যাই থাকুক না কেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিরক্ষা ব্যূহ অটল ও দৃঢ় ছিল এবং হিন্দুস্তানের ঝান্ডার পতন ঘটেছিল। আর্থার ওয়েলেসলি, যিনি পরবর্তীতে ‘ডিউক অব ওয়েলিংটন’ হিসেবে মর্যাদার লাভ করেছিলেন, তাঁর হাতে ব্রিটিশ উচ্চাভিলাষ পূরণের পথে আরেকটি প্রধান বাধা ছিলেন মহীশূরের টিপু সুলতান। ১৭৯৮ সালে শ্রীরঙ্গপতমের যুদ্ধে টিপু সুলতানের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সেই বাধাও অপসারিত হয়। ১৮০৩ সালে কোম্পানির বাহিনী দিল্লিতে উপনীত হওয়ার পর ১৮১৪-১৬ সালে গুর্খাদের দমন করে এবং ১৮১৮ সালের মধ্যে মারাঠা শক্তির পুনর্জাগরণের সব আশার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে, ১৮৪৩ সালে সিন্ধু দখল এবং ১৮৪৮-৪৯ সাল জুড়ে উপর্যুপরি যুদ্ধের পর পাঞ্জাবের বিশাল শিখ সাম্রাজ্যকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করে।

ব্রিটিশ প্রশাসনকে প্রতিটি আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়েছে এবং প্রতিটি যুদ্ধে তারা বিজয় অর্জন করেছে। প্রতিপক্ষকে বশীভূত করতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রেরও আশ্রয় নিয়েছে। যুদ্ধের চেয়ে বরং ষড়যন্ত্রের পথই তাদের কাছে অধিকতর ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়। কারণ ওই সময়ে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকেই এশীয় দেশগুলোর সরকারের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মহীশুরের টিপু সুলতান এবং মারাঠারা যদি কিছুটা আঞ্চলিক সহযোগিতার আশ্রয় গ্রহণ করত, তা হলে তারা যৌথভাবে আর্থার ওয়েলেসলির মতো প্রতিভাধরের শক্তিকেও সাফল্যের সঙ্গে দমন করতে পারত। কিন্তু ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ চতুরতার সঙ্গে হিন্দুস্তানের শাসকদের বিভেদ ও অনৈক্যকে কাজে লাগিয়েছিল। এই অনৈক্যের ফাটল প্রসারিত করতে ধর্মকে কাজে লাগানোর প্রয়োজন হয়নি; বরং অহমিকা ও লোভ অনেক বেশি কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।

[বাকি অংশ আগামীকাল]

লেখক : ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর