মঙ্গলবার, ১২ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

একটি আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু

এম জে আকবর হঅনুবাদ : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

একটি আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু

[গতকালের পর]

মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহের পুত্র মির্জা আবু জাফরের জন্ম হয়েছিল ১৭৭৫ সালে। তিনি ১৮৩৭ সালে সিংহাসনে আরোহণ করে নিজের উপাধি ধারণ করেছিলেন, ‘আবুল মুজাফফর সিরাজুদ্দীন মুহাম্মদ বাহাদুর শাহ বাদশাহ গাজী’। নির্জীব, মন্থর একজন মানুষের ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিলাষী নাম পুরোপুরি অর্থহীন ছিল। তিনি যদি মোগল রাজবংশের শেষ উত্তরাধিকারী না হতেন, তাহলে তিনি হয়তো একজন সাধারণ কবি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন। তাঁর সাহস ছিল না, দৃঢ়তাও ছিল না কিংবা মানুষের নেতা হওয়ার বৈশিষ্ট্যও ছিল না। তা ছাড়া ১৮৫৭ সালের যুদ্ধেও প্রমাণিত যে, তিনি কোনো ‘জিহাদি’ বা ধর্মযোদ্ধা ছিলেন না, যা তাঁর নামের অন্তর্নিহিত অর্থ।

যে মোগল বংশ একসময় সমগ্র বিশ্বে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল, তাদের পরবর্তী সময়ের অবক্ষয় ব্রিটিশদের মধ্যে ঘৃণার সৃষ্টি করেছিল যে, এ লোকগুলোর শিরায় কি আসলেই তৈমুরের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে? বাস্তবে কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত অগ্রাভিযানে ব্রিটিশ শক্তি যেসব বহুজাতিক শাসকগোষ্ঠীর মোকাবিলা করেছে তাদের ব্যাপারে ব্রিটিশের শ্রদ্ধাবোধ ছিল সামান্য। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর জমিদারদের সঙ্গে বরং ব্রিটিশরা স্বচ্ছন্দবোধ করেছে, যে জমিদাররা তাদের নিজ দেশবাসীর ওপর চরম অর্থনৈতিক শোষণ চালিয়েছে। এই সময়ে বাংলা ও অযোধ্যার নবাবরা তাদের সমৃদ্ধিকে আরও বিকশিত করে তুলেছিল। মারাঠারা ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর বারবার নিষ্ফল হামলা চালিয়েছে এবং প্রতিটি যুদ্ধে বারবার ব্রিটিশেরই বিজয় অর্জিত হয়েছে। অতএব, দেশীয় শাসকদের প্রতি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ আর কোনো শ্রদ্ধা রাখতে পারেনি।

আত্মতুষ্টি সব সময় ঘৃণা থেকে কয়েক পা দূরে অবস্থান করে। অতএব মিরাট থেকে একদল বিদ্রোহী ১৮৫৭ সালের ১১ মে সকাল ৮টায় দিল্লিতে লাল কেল্লার ফটকে উপনীত হওয়ার কমপক্ষে ছয় সপ্তাহ আগে গোটা বাজারে এ নিয়ে কানাঘুষা হলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সে সম্পর্কে কিছু জানতে পারেনি। চাঁদনী চকের গুজব কেন্দ্রে প্রকাশ্যে আলোচনা হয়েছে যে, ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মোগলদের সাহায্য করার জন্য রুশ ও পারসিকরা আসছে। ১৮৫৬ সালে আফগান সীমান্তের ওপারে হিরাত দখল করার পর পারসিকরা উপমহাদেশের দ্বারপ্রান্তে পা রাখার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু ব্রিটিশ বাহিনী মোহামমারা বন্দরে গোলাবর্ষণ করে যে চাপ সৃষ্টি করে তাতে পারসিকরা হিরাত থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। তা সত্ত্বেও বড় ধরনের একটি যুদ্ধের বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, যার বিবরণী অনুসারে ‘পারস্যের শাহ মোগল বাদশাহর অনুরোধে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে অর্থ ও সৈন্য পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’ শাহের এ-সংক্রান্ত ঘোষণা জুমা মসজিদের ফটকে টানিয়ে দেওয়া হয়, যেখান থেকে দেশীয়দের প্রিয়ভাজন এক খ্রিস্টান রিসালদারের কাছ থেকে জানার পর স্যার থিওফিলাস মেটক্যাফির নির্দেশে ঘোষণাটি তুলে ফেলা হয়। পারসিকরা আসছে- এমন খবরে মুসলমানদের মধ্যে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্যার থিওফিলাস মেটক্যাফি এ তথ্যকে কোনো ধরনের গুরুত্ব প্রদান করেননি। দ্বিতীয়ত আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায় যে, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর কলভিনের কাছে মুহাম্মদ দরবেশ নামে জনৈক ব্যক্তির লেখা একটি চিঠিতে বিদ্রোহের ছয় সপ্তাহ আগে পুরো পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছিল। এই সতর্কবাণীকেও এত গুরুত্বহীন বলে বিবেচনা করা হয়েছিল যে, যার কাছে তথ্য পাঠানো হয়েছিল তিনি এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর কোনো প্রয়োজন অনুভব করেননি। তৃতীয়ত দিল্লিতে ইউরোপীয়দের হত্যা করা হয়েছে বাদশাহর নির্দেশে, তাঁর পুত্র ও রাজ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য লোকজনের উপস্থিতিতে এবং হত্যা করছে ‘খাসবরদাররা’ অর্থাৎ বিশেষ দেহরক্ষীরা।

এ বিদ্রোহ চলাকালে রাশিয়ার জার সেন্ট পিটার্সবুর্গে ও পারস্যের শাহ তেহরানে অবস্থান করছিলেন। যিনি লাল কেল্লায় আসেন তাঁর নাম বখত খান, বেরেলির অষ্টম পদাতিক গোলন্দাজ বাহিনীর সুবেদার। চার দশক যাবৎ তিনি ব্রিটিশ প্রভুদের অধীনে ছিলেন। তাঁর বয়স তখন ষাট বছর, মোটাসোটা গড়নের এবং তিনিই হয়ে ওঠেন বিদ্রোহী সিপাহিদের নেতা। দলিলপত্রে তাঁকে ‘বিপুল বপুধারী’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ১৮৫৭ সালের সেই গ্রীষ্মে রাজনৈতিক উত্তাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বহু হৃদয়েই ফুটে উঠেছিল ঐশ্বর্যের ফুল। তখন যমুনা দাস নামে মুত্তারার যে শাসক ছিলেন তিনি লিখেন যে, তাঁর অধীনে ২ হাজার সৈন্য আছে এবং শাহি খাজাঞ্চিতে তিনি ১০ লাখ রুপি প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কামান, পদাতিক সৈন্য, অশ্বারোহী, গুলি ও বারুদ এবং কর্তৃত্বের সিলমোহর চেয়ে পাঠান। খাজাঞ্চিতে তাঁর অর্থ প্রেরণের প্রতিশ্রুতি ছিল ভুয়া। বাহাদুর শাহ জাফর তাঁর পুত্র মির্জা মোগলকে বলেন, ‘এই লোকটি কি বলতে চাইছে যে মাটির নিচে কোথাও লুকিয়ে রাখা ১০ লাখ রুপি খুঁড়ে তুলি অথবা সে কি এমন কোনো উৎসের কথা জানে যেখানে অর্থ লুকানো রয়েছে কিংবা এই অর্থের জন্য কি সে কাউকে লুণ্ঠন করতে চাইছে?’ খুরাজপুরার নওয়াব আমির আলী খান নগদ অর্থ প্রদানের কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি, কিন্তু তিনি একটি লক্ষ্যে উপনীত হতে চেয়েছিলেন। ১৮৫৭ সালের ১২ জুলাই তিনি এই মর্মে বাদশাহর কাছে দরখাস্ত করেন যে, তাঁকে যদি যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে তিনি ‘তিন দিনের মধ্যে শ্বেতচর্ম ও অন্ধকার ভাগ্যের অধিকারী লোকগুলোকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করবেন।’

যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা হলো, মোগল দরবার কত দ্রুততার সঙ্গে প্রশাসনের স্বাভাবিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল, যেন তরবারির একটি মাত্র আঘাতে অতীত পুনরায় জেগে উঠেছিল। দরখাস্তের পর দরখাস্ত আসতে থাকে লাল কেল্লায় এবং কেল্লা থেকে একটির পর একটি আদেশ জারি করা হতে থাকে, যা শেষ পর্যন্ত বাহাদুর শাহের বিচারে তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ প্রমাণ করার দলিলে পরিণত হয়। এসব দলিল দস্তাবেজ থেকে দেখা যায় যে, মোগল সিলমোহর ১৩০ দিনের জন্য পুনরায় রাজক্ষমতার কর্তৃত্ব অর্জন করেছিল। এ বিদ্রোহের মতো প্রচ- একটি ঝড়ের মাঝে অনেক দুর্বলতা এটিও প্রমাণ করে যে, ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল আসলে বিশৃঙ্খল ও ভঙ্গুর। বিদ্রোহের কোনো পূর্বপরিকল্পনা, কোনো কৌশল, কোনো আর্থিক সামর্থ্য এবং কোনো উপায়-উপকরণ ছিল না। বিদ্রোহীদের ছিল শুধু দুর্দমনীয় সাহস ও গভীর আস্থা। ২৭ মে যমুনা নদীর ওপর সেতুর মেরামত কাজের জন্য সেতুর তত্ত্বাবধায়ক চুনিলালকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করার জন্য ২৯ মে জেমস স্কিনারের দিল্লির বাসভবনকে ভূমি রাজস্ব আদায়ের দফতরে পরিণত করা হয়। ৫ জুন লুণ্ঠিত মালামালের মধ্য থেকে তিন বোতল স্পিরিট বাদশাহর পুরনো ভৃত্য কায়স্থ সম্প্রদায়ের লোকদের দিতে বলা হয়। কিন্তু বিদ্রোহের সূচনাকালে যে আশা ছিল ১৮ জুনের মধ্যে সে আশায় ফাটল ধরতে শুরু করে এবং বিদ্রোহীরা বিশৃঙ্খল আচরণ প্রদর্শন করতে শুরু করে। বাহাদুর শাহ জাফর তাঁর পুত্র মির্জা মোগলকে লিখেন, ‘সেনাবাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে রক্ষা করা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি অথবা লুণ্ঠন করা নয়। অতএব অবিলম্বে সেনাবাহিনীর অধিনায়কদের তাদের অধীন সৈন্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী কোনো কাজ করা অথবা অনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিরত করবে এবং দুশমন বাহিনীর আগমনের খবর যেহেতু ভ্রান্ত, সেজন্য বিশৃঙ্খল সৈন্যদের কেল্লায় রাখার প্রয়োজন নেই; বরং তাদের জন্য পাঁচ থেকে ছয় মাইল দূরে পরিখা নির্মাণ করা যেতে পারে, যেখানে তারা অবস্থান করবে।’

প্রথম দিকের, অর্থাৎ ১৮ মে নজফগড়ের দারোগা মৌলভি মোহাম্মদ জহুর আলীর এক দরখাস্তে একটি সমস্যার উল্লেখ দেখা যায়। তিনি তাঁর আওতাধীন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যয় করার জন্য অতি বিনয়ের সঙ্গে তহবিলের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁকে পাঠানোর মতো তহবিল শাহি খাজাঞ্চিতে ছিল না। যেসব সিদ্ধান্তের সঙ্গে আর্থিক ব্যয়ের প্রশ্ন জড়িত ছিল না সেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ছিল সহজ। বাহাদুর শাহ জাফর ২৪ জুন জুমা-উদ-দীন খানকে একটি সংবাদপত্র চালু করার জন্য অনুমতি প্রদান করেন। বকরি ঈদের সময় বাদশাহ হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার লক্ষ্যে গরু কোরবানি নিষিদ্ধ করে এক ফরমান জারি করেন। কারণ, এ ধরনের সময় প্ররোচনাকারীরা সক্রিয় থাকে। তিনি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নির্ণয় করতে অস্বীকৃতি জানান। মোগল সম্রাট আকবর রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি না করার যে নীতি অবলম্বন করেছিলেন বাহাদুর শাহ জাফরও তা বজায় রাখার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। ২৭ জুন বিদ্রোহী বাহিনীর জন্য সুখবরের একটি দিন ছিল যখন শেও দাস পাঠক ও নারায়ণ সিং নামে ৪৬তম নেটিভ ইনফেন্ট্রি রেজিমেন্টের দুজন সিপাহি ১৬২টি ভেড়া ও বকরি নিয়ে আসে। তারা দাবি করেন, এ প্রাণীগুলোকে আনার চেষ্টায় পাঁচজন ইউরোপীয় সৈন্য নিহত হয়েছে।

কিন্তু যুদ্ধ ক্ষেত্রের চেয়ে বিদ্রোহ পরিচালনায় অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে বড় সমস্যা ছিল। ১৯ জুন জয়সিংপুর ও শাহগঞ্জের প্রশাসক চান্দ খান ও গুলাব খান অভিযোগ করেন, বিদ্রোহী সিপাহিরা দোকানিদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে তাদের মালামাল নিয়ে যাচ্ছে, বিপর্যস্ত লোকজনের বাড়িঘরে জবরদস্তিমূলক প্রবেশ করে তাদের বিছানাপত্র, হাঁড়িবাসন সবকিছু নিয়ে যাচ্ছে এবং আপত্তি করা হলে গুলি করে বা তরবারির আঘাতে তাদের আহত করছে। শিগগিরই মোগল শাহজাদাদেরও লুণ্ঠন কাজে অংশ নিতে দেখা গেল। দিল্লির দুজন ব্যবসায়ী যুগল কিশোর এবং শেও প্রসাদের যৌথ দরখাস্তে অভিযোগ করা হয়, কিছুসংখ্যক শাহজাদা তাদের বাড়ি লুণ্ঠন করেছেন। তারা বলেন, ‘সাম্রাজ্যের প্রজা ও দরিদ্রদের রক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শাহজাদারা যদি স্বয়ং লুণ্ঠনের কাজে অংশ নেন ও প্রজাসাধারণের ওপর অত্যাচার চালান, তাহলে প্রজাদের নিরাপত্তা আর কোথায় থাকে?’ তারা এমনকি শাহজাদাদের নাম মির্জা মোগল, মির্জা খিজির ইত্যাদি উল্লেখ করেন। ৪ জুলাই আহসানুল হক অভিযোগ করেন, ‘বাদশাহর আরেক পুত্র মির্জা আবুবকরও শেষ পর্যন্ত অনিয়ন্ত্রিত ও বেপরোয়াভাবে এ কাজে অবতীর্ণ হয়েছেন। অসদুদ্দেশে তিনি শাহজাদি ফারখুন্দা জামানির বাড়িতে প্রবেশ করে এমন আচরণ শুরু করেন যা মদ্যপানের কারণে ঘটেছে বলে ধারণা করা যেতে পারে।’ আহসানুল হক তাঁর অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, তিনি লুণ্ঠিত হয়েছেন এবং তাঁর ২ রুপি মূল্যের জায়নামাজ, ৭ রুপি মূল্যের বেনারসি ওড়না, ২০০ রুপির একটি ঘোড়া, ১০০ রুপির এক জোড়া বলদ ও ১৫ রুপি মূল্যের একটি তরবারি নিয়ে গেছে লুটেরারা।

১৭ জুলাইয়ের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল জনতা কাশ্মিরী গেটের আশপাশের দোকানগুলোয় প্রতিদিন লুটপাট চালাচ্ছিল। আগস্টের শেষ দিকে দিল্লি নগরীজুড়ে নৈরাজ্য বিরাজ করছিল। দুর্দশায় পতিত ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি নবী বখশ তাঁর এক দরখাস্তে উল্লেখ করেন, ‘বর্তমান নৈরাজ্যপূর্ণ পরিস্থিতিতে আপনার অধম দাসেরা চরম দুর্ভোগের শিকার এবং আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এত বিপুল যে কলকাতা, বেনারস, কানপুর, দিল্লি, আম্বালা অথবা লাহোর যেখানেই তা হোক না কেন, আমাদের সর্বস্ব ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের দোকানপাট সবই লুণ্ঠিত ও বিপর্যস্ত; অথচ এখনো আমাদের কাঁধের ওপর চেপে আছে আমাদের সাবেক ঋণের বোঝা। আমাদের অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, আমাদের পরিবার পরিচালনার ব্যয় সংকুলানের উপায় পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই। মির্জা মোগল সাহেব আমাদের কাছে ৫০ হাজার রুপি দাবি করেছেন। এ অর্থ আমরা কোথা থেকে দেব?’ পরবর্তী দলিলটি মির্জা মোগলের তরফ থেকেই এসেছে, যাতে তিনি কোনো রাখঢাক না করেই উল্লেখ করেছেন, ‘সিপাহিদের দৈনিক ভাতা পরিশোধ না করার পরিস্থিতিতে তাদের ক্ষুধার্ত অবস্থায় কাটানোর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।’ জরুরি ভিত্তিতে ঋণ সংগ্রহ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। ঋণ পাওয়া যাচ্ছিল না। অতএব, শিগগিরই বিদ্রোহী বাহিনীর আর অস্তিত্ব থাকবে না। এ কাহিনি দীর্ঘ নয় এবং নিশ্চিতভাবেই কাটছাঁট করে এ কথা বলা হয়নি। বাহাদুর শাহ জাফর ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার বহু আগেই নিজেদের লোকজনের কাছেই তিনি নিজের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছিলেন। আগস্টে দিল্লির উর্দু পত্রিকাগুলো আটোক এলাকা হয়ে পারসিক বাদশাহর আগমন নিয়ে রসিকতা করে লেখালেখি শুরু করেছিল। একটি সংবাদপত্রে লেখা হয়, ‘কিছু লোক আবার বলাবলি শুরু করেছে যে, পারসিক বাহিনী বোলান ও বিবি নাররি গিরিখাত হয়ে এসেছে এবং আমির দোস্ত মোহাম্মদ খান প্রফুল্ল চিত্তে তাঁর ভূখ- দিয়ে তাদের অবাধ আগমন নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু প্রচলিত হিন্দুস্তানি প্রবাদ অনুসারে “একজন ব্রাহ্মণ তখনই ভোজের কথা বিশ্বাস করেন যখন তিনি ভোজে অংশগ্রহণ করেন”। হিন্দুস্তানের লোকজন পারসিকদের আবির্ভাবের কথা তখনই বিশ্বাস করবে যখন তারা এর অকাট্য প্রমাণ পাবে। কিছু নিশ্চিত লক্ষণ দেখা গেলে তবু এ খবরকে কিছু মাত্রায় বিশ্বাস করা যেতে পারত।’ বিদ্রোহী সিপাহিদের মধ্যে যারা অধিকতর বাস্তববাদী, তারা রানী জিনাতমহল ও হেকিম আহসানউল্লাহ খানকে দোষারোপ করতে শুরু করে। যে কারণে তাদের বাড়ি লুণ্ঠিত হয়। খোজা মাহবুব আলী খানকেও তারা অভিযুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করার জন্য।

সিপাহিদের পক্ষ থেকে বাহাদুর শাহ জাফরকে অপসারণ করে মির্জা মোগলকে বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করার একটি গুরুতর উদ্যোগ ছিল। ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সব উদ্যোগের নিষ্পত্তি টেনে দেয় লাল কেল্লা দখল করার মধ্য দিয়ে। জাফর আশ্রয় নেন তাঁর পূর্বপুরুষ হুমায়ুনের সমাধিসৌধে। একটি সমাধিতে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে তাঁর মধ্যে একটি ভাবনা কাজ করেছে। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ যখন তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারে তখন তাঁর মাঝে আত্মসম্মান নিয়ে অনিবার্য ভাগ্যবরণের সাধ আর অবশিষ্ট ছিল না। ভগ্ন শরীর ও ৮২ বছর বয়স হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর জীবন ভিক্ষা করেন। অথচ ওই সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ বাহিনী তাঁর পুত্রদের হত্যা করে তাদের মৃতদেহ গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছিল। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে মির্জা মোগলের জীবনাবসান বরং অধিক মর্যাদাপূর্ণ ছিল। তাঁকে হত্যা করার আগে তিনি মুসলিম ও হিন্দুদের স্মরণ করতে বলেন যে ঐক্যবদ্ধ থাকলে তাদের পক্ষে কী অর্জন করা সম্ভব ছিল। বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর শুধু নিজের চামড়া রক্ষা করতে চেয়েছিলেন এবং ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁর জীবনের সবকিছু কেড়ে নিয়ে তাঁর চামড়া রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। যে চারটি অভিযোগে তাঁর বিচার সংঘটিত হয় প্রতিটিতেই তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অভিযোগগুলো ছিল- ব্রিটিশের পেনশনভোগী হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে স্বাধীন-সার্বভৌম ঘোষণা করা; ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা; ৪৯ জন ব্রিটিশ নারী ও শিশুকে হত্যার আদেশ প্রদান এবং বখত খানকে বিদ্রোহে উৎসাহিত করা।

বাহাদুর শাহ জাফরের বিচার শুরু হয় ১৮৫৮ সালের ২৭ জানুয়ারি, যা চলেছিল ২১ দিন ধরে। এ বিচার ছিল প্রকৃতপক্ষে এক বিশাল সাম্রাজ্যের মৃত্যুসংবাদ এবং এই ঐতিহাসিক ঘটনা এক মহান মুহূর্তে হতে পারত একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা এবং ব্যতিক্রমী এক রাজবংশের প্রতি চূড়ান্ত শ্রদ্ধা নিবেদনের ক্ষণ। কিন্তু এটি ছিল দুঃসহ এক বিষাদ। বিচার চলাকালে একটি সম্মানজনক কাজই তিনি করেছেন, তা ছিল আদালত কক্ষে মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়া। কখনো কখনো তিনি প্রতিবাদ করেছেন যে তাঁর অসহায় দুর্বল জীবনের ওপর যে নাটক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার কিছুই তিনি জানতেন না। এ কথা বলার মধ্য দিয়ে তিনি কিছুটা সততার পরিচয় দিয়ে থাকতেও পারেন। কিন্তু মিথ্যা কিছু পরই জলতরঙ্গের মতো আসতে থাকে। ব্রিটিশের পতন নিয়ে বিদ্রোহের প্রতিপক্ষ দেশীয় সিপাহিদের ‘বেইমান’ বলে অভিহিত করতে তিনি আত্মগ্লানি অনুভব করেননি এবং ইউরোপীয়দের হত্যার দায়ভার প্রশান্তভাবে চাপিয়ে দিয়েছেন তাঁর পুত্রদের ওপর। আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি আদালতে বলেছেন, ‘তারা আমার নাম ব্যবহার করেছে।’ এ ছাড়া তিনি বলেছেন, মির্জা মোগলকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগের জন্য তাঁকে বাধ্য করা হয়েছে।

একটি ক্ষেত্রে তিনি যথার্থই সততার পরিচয় দিয়েছিলেন। যখন তিনি আর পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিলেন না তখন কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকির মাজার, আজমির অথবা মক্কায় হজে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু ‘বিদ্রোহীরা আমাকে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি।’

বাহাদুর শাহ জাফরের বিরুদ্ধে মামলায় ডেপুটি জজ অ্যাডভোকেট জেনারেল মেজর এফ জে হ্যারিয়ট অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মামলার কাজ শেষ করেন। বিদ্রোহের অন্যতম একটি কারণ ছিল বন্দুকের গুলিতে শূকর ও গরুর চর্বি ব্যবহারের কারণে হিন্দু ও মুসলিম সিপাহিদের ক্ষোভ। কিন্তু ব্রিটিশ সাহেবদের খাওয়ার টেবিলে শূকর বা গরুর মাংস পরিবেশন করার ক্ষেত্রে তাদের কোনো সমস্যা ছিল না, কিংবা একই গুলি বন্দুকে ভরে তা ব্রিটিশের দিকে তাক করার ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলিম সিপাহিদের কোনো সমস্যা হয়নি। তাদের ধর্মীয় অনুভূতি যদি সত্যিকার অর্থেই এতটা আহত হয়ে থাকত তাহলে তারা বিদ্রোহের সহজ বিকল্প হিসেবে ব্রিটিশের চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে দরখাস্ত করার কথা ভাবেনি কেন? ইউরোপীয় সামরিক কমিশনের সামনে মেজর হ্যারিয়ট বলেছেন, ‘সব দিক বিচার-বিবেচনার পর আমার মনে হয়েছে যে, চর্বিযুক্ত গুলি ব্যবহারের চেয়েও গভীরতর ও জোরালো কোনো কারণে প্রায় একই সময়ে হিন্দুস্তানের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত বিদ্রোহের কম্পন অনুভূত হয়েছে; দেশীয় সিপাহিরা ইউরোপীয় অফিসারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে; নতুন অনেক ক্ষেত্রেই চর্বিযুক্ত গুলির কোনো উল্লেখই ছিল না। শুধু একটি প্ররোচনাই যে এমন প্রচন্ড ঘৃণার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে ঘটনার স্বাভাবিক প্রবাহে তা-ই মনে হয়।’ চর্বি একটি দৃশ্যত কারণ ছিল। প্রকৃত কারণ লুক্কায়িত ছিল বিদ্রোহের উত্তাল তরঙ্গের মাঝে। সেই কারণটি কি কোনোভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ? ১৮৫৮ সালের অক্টোবরে জিনাতমহল ও জওয়ান বখতকে নিয়ে তৈমুর বংশের শেষ উত্তরাধিকারী দিল্লি ত্যাগ করেন। কলকাতায় পৌঁছার পর তাদের একটি যুদ্ধজাহাজে তুলে রেঙ্গুনে (ইয়াঙ্গুন) নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে সাবেক মোগল বাদশাহ ১৮৬২ সালে ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু সব আশা-আকাক্সক্ষাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং তাঁর মৃত্যুর সাত বছর পর ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর নতুন আশার আলো জ্বালাতে জন্মগ্রহণ করেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।

লেখক : ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

 

[গতকাল অসর্তকতার কারণে অনুবাদকের নাম আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর বদলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ছাপা হওয়ায় আমরা দুঃখিত।          -বি.স]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর