বুধবার, ১৩ মে, ২০২০ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার রমজান

শেখ সালাহউদ্দিন আহমেদ

যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলাম দন্ডায়মান তার একটি রোজা। নামাজের পর জাকাতের স্থান, এর পরই রোজার স্থান। মানুষের দৈহিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নে এ মাসের রোজা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। সংযম, সহিষ্ণুতা ও আত্মশুদ্ধির অনন্য চেতনায় ভাস্বর মাহে রমজান। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মাসকে এক সুমহান মাস হিসেবে অভিহিত করেছেন। অন্যান্য মাস অপেক্ষা রমজানের শ্রেষ্ঠত্বের বড় কারণ, এ মাসেই বিশ্বমানবতার মুক্তিসনদ আল কোরআন নাজিল হয়।

কোরআনের সঙ্গে রমজানের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। কোরআনের আলোকে জীবন গঠনের একটা প্রশিক্ষণ হয় মাহে রমজানে। আত্মিক উন্নয়ন, পবিত্রতা অর্জন ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য রমজানের রোজার কোনো তুলনা হয় না। আল্লাহ আল কোরআনে বলছেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তা তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ তাকওয়া অর্থ সতর্ক, সংযত ও সাবধান থাকা। আল্লাহর ভয়ে, আখিরাতের জবাবদিহির ভয়ে সব ধরনের অন্যায়, অশ্লীলতা, পাপ ও অপরাধ থেকে দূরে থাকা। বলা বাহুল্য, তাকওয়ার গুণ মানুষকে সব ধরনের পাপাচার, অন্যায়, অপরাধ, অপকর্ম, অশ্লীলতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও দুষ্কৃতি থেকে মুক্ত রাখতে পারে। রোজা রেখে মিথ্যাচার, পরচর্চা, ক্রোধ, হিংসা, নিন্দা, অহংকার, আত্মগর্ব, কৃপণতা, চোগলখোরি ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রোজা রাখা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি মিথ্যাচার ও পাপকর্ম থেকে বিরত রইল না, ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হওয়া ছাড়া রোজা তার কোনো কাজেই এলো না।’ রোজা মানুষকে প্রকৃত আধ্যাত্মিক ও জাগতিক মানুষ হতে অনুপ্রাণিত করে, কার্যকরভাবে সহায়তা করে। আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, মানবদেহের মৃত কোষগুলো খেয়ে সুস্থ কোষগুলো সতেজ ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। রোজায় মানুষ দৈহিকভাবে অকল্পনীয় উপকার ও সুস্থতা লাভ করে। রোজা রাখা ব্যক্তিগত ইবাদত হলেও এর মর্ম অনেক গভীর ও ব্যাপক। নিজের চারপাশের পৃথিবীকে স্বস্তি দেওয়া, মানবতার প্রতি দায়িত্ব পালন, সবার অধিকার প্রদান ইত্যাদিই তাকওয়ার ফসল।

এবার এমন একসময় মাহে রমজান এসেছে, যখন বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব ভয়াবহ বিপদ ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন। মহামারী আকারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করছে। মানুষ যারপরনাই উদ্বিগ্ন, বিচলিত ও আতঙ্কিত। কার্যত সব দেশেই চলছে লকডাউন ও সামাজিক সঙ্গনিরোধ কার্যক্রম। আমাদের দেশ পুরোটা না হলেও অধিকাংশই লকডাউনের আওতাধীন। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করা হচ্ছে। দেশজুড়ে চলছে ছুটি। সবকিছুই বন্ধ। এমনকি মসজিদে ব্যাপকসংখ্যক মুসল্লি সমাবেশ ও জামাতে নামাজ আদায় রহিত করা হয়েছে। সৌদি আরবসহ বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্যবারের মতো এবার মাহে রমজানে সংগত কারণেই ইফতার, তারাবি ও তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে মসজিদে জড়ো হওয়া যাবে না। ইবাদত-বন্দেগি যা কিছু করার ঘরে বসেই করতে হবে। লকডাউন ও সামাজিক সঙ্গনিরোধ করোনা সংক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র পথ। ইসলাম এর মধ্যে আপত্তিকর কিছু দেখে না।

একটি হাদিসে আছে, ‘যারা নিজেদের সুরক্ষার জন্য ও অন্যদের রক্ষা করার জন্য ঘরে থাকে, তারা আল্লাহর সুরক্ষার অধীনে থাকে।’ মুসনাদে আহমাদ। কোথাও মহামারী দেখা দিলে সেখানে যাওয়া থেকে বিরত থাকা এবং সেখান থেকে কারও বাইরে না আসার ব্যাপারে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। কাজেই মাহে রমজানে ঘরে বসেই সব নামাজ, দোয়া-দরুদ, জিকির-আজকার, কালামে হাকিমের তিলাওয়াত ইত্যাদি করতে হবে। একে মহামহিম আল্লাহর ইচ্ছা হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে। আর একই সঙ্গে জাকাত, ফিতরা, দান-খয়রাত বেশি বেশি করতে হবে। করোনা কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন ও আর্থিকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি, এই বৈশাখে প্রকৃতি রুক্ষ-রুদ্র না হয়ে সহনশীল, মনোরম হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি, ঝিরঝিরে বাতাস, গাছে গাছে সবুজের বিস্তার, শোভাময় ফুলের সমাহার এক ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। রোজাদারদের জন্য এটা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। এ অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর প্রতি অশেষ প্রশংসা। তাঁর রহমত, দয়া ও করুণা আমরা একান্তভাবেই প্রত্যাশা করি। একই সঙ্গে আশ্রয় প্রার্থনা করি, করোনার যাবতীয় ক্ষতি ও ভয়াবহতা থেকে।

রমজানের শিক্ষা ধৈর্য ও সংযম। একে অন্যের প্রতি সম্প্রীতি, সমবেদনা ও সহমর্মিতা রমজানের মহান শিক্ষা। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে মুসলমানদের ওপর নানা দিক থেকে আক্রমণ আসছে। অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক হামলা, অপপ্রচার সব মিলিয়ে বিশ্ব মুসলিমকে এক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। অথচ শান্তির দূত মুসলমানরা মহান ইসলামের উদার ও মানবিক বার্তা নিয়ে বিশ্বময় এক ইতিবাচক সম্প্রদায় হিসেবে সুপ্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষা নিতে হবে সংযমের উৎকর্ষ থেকে।

যেমন হাদিসে এসেছে, রোজাদারের সঙ্গে কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে এলে সে যেন বলে দেয়, আমি রোজা রেখেছি। অর্থাৎ আমি তোমার কথার প্রতি-উত্তর দেব না। যে কোনো পরিস্থিতিতে উসকানিতে সাড়া না দিয়ে সংযম ও তাকওয়া রক্ষা করে চলাই রমজানের শিক্ষা।

লেখক : অ্যাডভোকেট

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও প্রেসিডেন্ট সাউথ এশিয়ান ল ইয়ার্স ফোরাম।

সর্বশেষ খবর