শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

অদৃশ্য আঙ্গুলের টানে দেখি পুতুল মানুষ

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

অদৃশ্য আঙ্গুলের টানে দেখি পুতুল মানুষ

আমরা যা দেখি, যতটা দেখি তার পুরোটা কি কখনো দেখতে পাই? কিংবা তা কি আমাদের দেখানো হয়? অনেক ঘটনাই আমরা দেখি, পুলকিত হই, বিস্মিত হই। অনেকেই ভাবে ঘটনার একেকটা প্রাচীর ভেঙে তারা গভীরে ঢুকতে পেরেছে কিন্তু ঘটনার ভিতরেও তো ঘটনা থাকে, অতৃপ্তি থাকে। যা সারা জীবন অদেখা থেকে যায়। অদৃশ্য থেকে যায়। হয়তো এখান থেকেই সূত্রপাত ঘটে রহস্যের। মনে হয় বুঝেছি, বোঝা যায় না, মনে হয় ছুঁয়েছি, ছোঁয়া যায় না। পারা না পারার তীব্র মানসিক অস্থিরতায় পেন্ডুলামের কাঁটাটা দুলতে থাকে, ভাঙা-গড়ার দোলাচলে বিদ্রোহ করে পিপাসার্ত মন। তার পরও অদেখা ভুবন অদেখাই থেকে যায়। রেখে যায় কল্পনা, ধারণা আর বিশ্লেষণ। ছোটবেলায় দেখা পুতুলনাচকে আমরা বিনোদনের অনুসর্গ হিসেবে ভেবেছি। আমোদিত, আনন্দিত হয়েছি। সেটি বিষয়ভিত্তিক পুতুলনাচের নাট্য উপাদানের সরল প্রভাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত কঠিন বাস্তবতাকে সে সময় উপলব্ধি করা সম্ভব হয়নি। পুতুলনাচের নন্দিত ইতিহাস আছে, আছে উত্থান থেকে পতনের চিরায়ত বাস্তবতা। আনুমানিক ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশে পুতুলনাচ শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদের পাশে গড়ে ওঠা কৃষ্ণনগর গ্রামে বিপিন পাল নামে এক ব্যক্তি প্রথম এ পুতুলনাচের ধারণা দেন। তিনি সে সময়ের সামাজিক, পৌরাণিক কাহিনির ওপর ভিত্তি করে পুতুলনাচের আসর সাজাতেন। ক্রমান্বয়ে আরও অনেকে এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন। তাদের মধ্যে গিরীশ আচার্য্য, মোতারু মিয়া, ধন মিয়া, কালু মিয়া, মো. রাজ হোসেন, শরীফ মালদার প্রমুখ ব্যক্তির নাম উল্লেখযোগ্য। পর্দার অন্তরালে অদৃশ্য হাতের আঙ্গুলের মায়াবী কারুকাজে ৩ থেকে ৬টি সুতা ব্যবহার করে এসব শিল্পী তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী পুতুলগুলো নাচাতেন। এমনকি পুতুলের কথা বাস্তব বলে প্রমাণ করতে কণ্ঠের সঙ্গে তালপাতার বাঁশির সুরের জাদুকরী সমন্বয় ঘটানো হতো। রূপক অর্থে মানুষ যেন এখন অনেকটাই পুতুলের মতো। নিষ্প্রাণ, নিস্তব্ধ, নিয়ন্ত্রিত। মানুষের জীবন পুতুলনাচের মতোই। ওপর থেকে সুতার টানে এখন চলছে মানুষের জীবন। প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মানুষের স্বপ্ন, সম্ভাবনা ও বিশ্বাস। ব্যক্তিত্ব, আত্মশক্তি ও মানবিক মূল্যবোধ। কোথায় যেন পিছুটান। সব যেন লোকদেখানো অভিনয়। এ অভিনয় করতে করতে মানুষ তার নিজের ব্যক্তিসত্তা ও মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছে। প্রতিদিন নিজের অজ্ঞাতে কারও না কারও খেলার পুতুল আর ক্রীতদাসে পরিণত হচ্ছে। মানুষ যা সামনে বলছে, ভিতরে তা বিশ্বাস করছে না। সত্য মনের ভিতর চেপে রেখে অসত্যকে প্রচার করছে। অযৌক্তিক ও অসম্ভব ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস মানুষ আঁকড়ে ধরছে। প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক সক্রেটিস কখনো এমনটা ভাবেননি। তিনি প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস কোনো কিছুকেই বিনা প্রশ্নে বা যৌক্তিকতা ছাড়া গ্রহণ করেননি। জ্ঞানের আহরণে সব সময় তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। তাঁর মতে, জ্ঞান হচ্ছে আসলে জিজ্ঞাসা ও অন্বেষা। এই অসাধারণ চরিত্রের মানুষটি সব সময় বলতেন, মানুষ খুব আত্মবিশ্বাসী হয়ে ভাবে তারা সবকিছু জানে। আসলে তারা কতটুকু জানে, তাও তাদের ধারণায় নেই! সে সময়ের মানুষ সক্রেটিসকে সবচেয়ে জ্ঞানী বলত। এতে তিনি নিজে বিস্মিত হয়ে বলেছেন, আমাকে কেন লোকে জ্ঞানী বলে, আমি কতটুকুই বা জানি। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি অনেক মানুষকে প্রশ্ন করেছেন। বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও তার সমাধানের বিষয়ে নানাজনকে প্রশ্ন করেছেন। যাদের প্রশ্ন করেছেন, তারা সেই সমস্যার সমাধান তাদের মতো করে দিয়েছেন। দিন শেষে ভগ্নহৃদয়ে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এভাবে- ‘এতসব জ্ঞানীর সঙ্গে আমার যদি কোনো পার্থক্য থাকে তবে তা হলো আমি জানি যে আমি কিছুই জানি না; কিন্তু এরা জানে না যে এরা কিছু জানে না।’ এর মানেটা খুব পরিষ্কার। আমরা আসলে আমাদের নিজেদের কখনো খুঁজি না বরং অন্যদের খুঁজতে গিয়ে আমাদের নিজেদের হারিয়ে ফেলি। কখনো পক্ষপাতদুষ্ট হই, কখনো নিরপেক্ষ হই আবার কখনো নীতিমান সাজি। কিন্তু নিজের ভিতরের সত্তাকে টেনে বের করে এনে নিজেকে চেনাতে পারি না। কেন পারি না? হয়তো অদৃশ্য সুতার টান, অদৃশ্য লোভ, অদৃশ্য ক্ষমতার প্রভাব, অদৃশ্য মনোভাব। কিংবা অদৃশ্য অন্য কোনো নেতিবাচক চিন্তা ও বিশ্বাস।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র গ্রন্থ পরিচয়ে নিখাদ একটি সত্য কথা বলা হয়েছে এভাবে- পৃথিবীব এই বিরাট রঙ্গমঞ্চে মানুষ যেন শুধু পুতুল। কোনো অদৃশ্য হাতের সুতার টানাপড়েনে মানুষ নাচে, কাঁদে, কথা বলে। নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়া পথে তার জীবনের স্রোত বয়ে চলে না, মানুষের হাতে কাটা খালে তার গতি। সত্যিই, মানুষ খুব অসহায়। মানুষ নিজেই নিজেকে এই অদৃশ্য শক্তি দ্বারা প্রভাবিত করেছে, বন্দিত্ব গ্রহণ করেছে। এটা নেতিবাচক শক্তির প্রভাব, অশুভ শক্তির হাতে বন্দিত্ব। এতে মর্যাদা নেই, আছে মানুষের অপমান, ধ্বংস, হেরে যাওয়া আর পিছুটান। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হলো, অদৃশ্য আঙ্গুলে সুতার টানের থিওরিটা মানুষেরও তৈরি। একটার পর একটা ইটের গাঁথুনি দিয়ে যেমন সুউচ্চ দালান-কোঠার ভিত্তি গড়ে ওঠে, তেমন মানুষের ওপরে মানুষ তৈরি করে এই অদৃশ্য শক্তির সীমা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা হয়তো এখন মানুষও জানে না। মুখোশের আড়ালে মানুষ, বোঝা যায়, চেনা চেনা মনে হয় কিন্তু বলা যায় না, ধরা যায় না, কিছু করা যায় না। মানুষ এভাবেই মানুষে মানুষে বৈষম্য তৈরি করে। নিজের সৃজনশীল ও মুক্তচিন্তার জায়গা থেকে ছিটকে পড়ে নিজের মৌলিক অস্তিত্বকে হারায়।

কাদামাটির নরম মানুষটা আর মানুষ থাকে না, বিবেক হারায়, সততা হারায়, নৈতিকতা হারায়, বাকশক্তি হারায়। মানুষ মানুষ থাকে না, রাজার ওপর রাজা বানিয়ে মানুষ নিজের স্বকীয়তা হারায়, স্বপ্ন ও সম্ভাবনা থেকে ছিটকে পড়ে যায় নর্দমায়। যে নিজেকে রাজা ভাবে সেও তো আসলে রাজা নয়, তার ওপরেও রয়েছে অদৃশ্য আঙ্গুলে টানা সুতার শক্ত বন্ধন।

একটা ছোট দৃষ্টান্ত আনা যেতে পারে। আপনি আপনার নিজের চিন্তা ও বিবেচনা শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেবেন, কিন্তু নিতে পারছেন না। অনেক অদৃশ্য হাতের সুতার টান আপনাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দিচ্ছে না। আপনি শারীরিকভাবে বেঁচে থাকলেন কিন্তু এর ফলে আপনার আত্মার মৃত্যু হলো, মনের বিকাশ স্থবির হয়ে পড়ল। আপনি ঘুষ খাচ্ছেন, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করছেন, পেশিশক্তির উত্থান ঘটাচ্ছেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন, তোষামোদ আর টাকার জোরে পদ-পদবি কিনছেন, এটা করছেন, ওটা করছেন, যা করা উচিত নয় তাই করছেন। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলছেন আমার খুঁটির জোর আছে। এটা খুঁটির জোর নয়, অদৃশ্য সুতার টান, যা আপনাকে আপনি হয়ে উঠতে দিচ্ছে না। কারণ এই অদৃশ্য আঙ্গুলের টান আপনার ভিতর থেকে সত্যকে টেনে বের করে এনে আপনাকে মিথ্যা মুখোশ পরিয়েছে। সত্যকে নগ্ন করেছে।

ফরাসি একজন চিত্রকর জিনলেওন জেরোমের ১৮৮৬ সালে আঁকা বিখ্যাত একটি ছবি he truth is coming out of the well -এর বিষয়বস্তুকে এ প্রসঙ্গে টেনে আনা যায়। উনিশ শতকের একটি লোককথাকে ভিত্তি করে ছবিটি আঁকা হয়েছিল। গল্পটা ছিল এ রকম : একবার সত্য ও মিথ্যা পরস্পরের সঙ্গে দেখা করল কিছু বিষয় মীমাংসার তাগিদে। হাঁটতে হাঁটতে তারা চলে গেল একটা কুয়োর পাশে। মিথ্যা বলল, দেখ, কী পরিষ্কার জল। চল স্নান করি। বলাবাহুল্য, সত্য বিশ্বাস করেনি মিথ্যার কথা। নিজে পরখ করে দেখল। যখন দেখল কুয়োর জল সত্যিই পরিষ্কার তখন মিথ্যার প্রস্তাবে রাজি হলো। দুজনে পোশাক ছেড়ে নেমে পড়ল কুয়োয়। স্নানের মাঝপথে মিথ্যা কুয়ো থেকে উঠে এসে সত্যের পোশাক পরে পালিয়ে গেল। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর মিথ্যাকে ফিরতে না দেখে সত্য উঠে এলো কুয়ো থেকে। না, মিথ্যা তো কোথাও নেই, পোশাকও নেই। রাগে অন্ধ হয়ে সত্য বের হলো মিথ্যাকে খুঁজতে কিন্তু নগ্ন সত্যকে দেখে ছি ছি করল সভ্য মানুষ। এমনকি তেড়েও এলো অনেকে। সত্য অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের বোঝাতে না পেরে রাগে-দুঃখে অপমানে ফের কুয়োয় নেমে গেল। তার পর থেকে সত্যকে আর কখনো কেউ দেখেনি। যাকে দেখেছে কিংবা দেখছে সে সত্যের পোশাক পরা মিথ্যা। অদৃশ্য সুতার টান সত্যকে নির্বাসিত করেছে। মানুষকে দানব বানিয়েছে। এ অদৃশ্য সুতার টান লোকালয় পেরিয়ে আন্তর্জাতিক হয়েছে। মানুষ মানুষকে এভাবেই বিপন্ন করেছে, মানুষ তার নিজের নিজেকে হারিয়েছে। পড়ে আছে মন ও আত্মাবিহীন মানুষের কঙ্কাল। তার পরও রবীন্দ্র উপন্যাস সমগ্রের চতুর্থ অধ্যায়ের একচ্ছত্র লেখার ওপর বিশ্বাস রাখতে চাই- ‘গোড়াতেই জানা উচিত ছিল মানুষ বেশিক্ষণ পুতুলনাচ নাচতে পারে না। মানুষের স্বভাবকে হয়তো সংস্কার করতে পার, তাতে সময় লাগে। স্বভাবকে মেরে ফেলে মানুষকে পুতুল বানালে কাজ সহজ হয় মনে করা ভুল। মানুষকে আত্মশক্তির বৈচিত্র্যবান জীব মনে করলেই সত্য মনে করা হয়। আমাকে সেই জীব বলে শ্রদ্ধা যদি করতে তাহলে আমাকে দলে তোমার টানতে না, বুকে টানতে।’

লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও লেখক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর