শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

কোরআনে হাফেজদের দিকে তাকান

প্রফেসর ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

কোরআনে হাফেজদের দিকে তাকান

গোটা বিশ্ব করোনাভাইরাস নামক এক অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা করছে। বৈশ্বিক সংস্থাগুলো এটাকে অর্থনৈতিক মহামারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ থমকে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি ও সর্বস্তরের মানুষের মনকে চাঙ্গা রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী অনেক পরিকল্পনা এবং প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। সারা দেশের কয়েক কোটি মানুষের জন্য চালু করেছেন ত্রাণ তৎপরতা। করোনা সংকটে অন্যান্য কর্মহীন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রধানমন্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকিয়ে আছেন রমজানের বিশেষ আকর্ষণ আল্লাহর মেহমান কোরআনের হাফেজরা। কারণ মহামারী করোনা ঠেকাতে এবার মসজিদে খতমে তারাবি বন্ধ আছে। যদিও ৭ মে দুপুর থেকে মসজিদ উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। সে ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও করোনা প্রতিরোধের সব নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে যে করোনার ভয়ে তারাবি নামাজে মুসল্লির সমাগম খুব একটা হবে না। ফলে হাফেজদের বেকারই থাকতে হবে। অর্থাৎ কাজ নেই, বেতন নেই। ওপরে বর্ণিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায়ও তারা পড়ছে না। আবার কোরআনের হাফেজ হওয়ায় কারও কাছে লজ্জায় হাত পাততেও পারছে না। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে-না খেয়ে আছে তারা। এ অবস্থায় হাফেজদের জন্য একটি বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাচ্ছি।

বিভিন্ন তথ্যমতে, দেশে ১০ লক্ষাধিক কোরআনে হাফেজ আছে এবং মসজিদের সংখ্যা ৩ লাখের কাছাকাছি। রমজান এলে এসব হাফেজ মসজিদে খতম তারাবি পড়ায় এবং খুব সামান্যই সম্মানি পেয়ে থাকে। বড়জোর ১০, ২০, ৩০ হাজার টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও কম। তাও আবার শুধুই রমজান মাসের জন্য। সেই টাকা আবার আয় হয় মুসল্লিদের কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে। তারাবি নামাজ শেষে ইমাম সাহেব এসব হাফেজকে সাহায্য করার জন্য আহ্বান জানান। মুসল্লিরা ১০, ২০, ৩০ টাকা ছোট কাঠের বাক্সে রাখে। মাস শেষে ২৭ রমজান অর্থাৎ লাইলাতুল কদরে আখেরি মোনাজাতের পর মসজিদ কমিটির সভাপতির মাধ্যমে হাফেজ সাহেবদের ওই সম্মানিটুকু দেওয়া হয়। যদিও ইসলামের দৃষ্টিতে কোরআন খতমের বিনিময়ে টাকা নেওয়ার বিধান নেই। কিন্তু তাদেরও আছে সংসার, পরিবার- পরিজন। তবে এবার সেই সম্মানি পাওয়ার সুযোগটুকুও নেই। তাহলে ঈদের সময় কী কিনে দেবে তাদের সন্তানদের হাতে? দেখা গেছে, অধিকাংশ হাফেজই অত্যন্ত গরিব পরিবার থেকে এসেছে। দরিদ্র পিতা-মাতা যখন সন্তানদের সামান্য ভর্তি ও বেতনের টাকা দিয়ে নিজ এলাকার স্কুলে পড়ানোর সামর্থ্য থাকে না, তখনই দূরের কোথাও বিনামূল্যের মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেন। ছোট ছোট নিষ্পাপ ফেরেশতাতুল্য শিশুগুলো মা-বাবার আদরবঞ্চিত হয়ে দূরের ওই মাদ্রাসায় পড়ে থাকে। পবিত্র কোরআন মজিদে ১১৪টি সূরা ও ৬ হাজার ২৩৬টি আয়াত রয়েছে। হাফেজ হওয়ার এ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হতে সাধারণত তিন থেকে ছয় বছর লাগে। কোরআন মুখস্থের সঙ্গে সঙ্গে সঠিক উচ্চারণরীতিও শেখানো হয়। এভাবে তারা হয়ে ওঠে কোরআনের হাফেজ। এর পরই এরা গ্রামগঞ্জ, শহরে ছড়িয়ে পড়ে কাজের সন্ধানে। আর কাজ মানেই মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। অর্থাৎ সামান্য বেতনে ইমাম অথবা মুয়াজ্জিন হওয়া। অনেকে এটুকুও জোগাড় করতে না পারলে পাড়ায়-মহল্লায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে বাসায় গিয়ে আরবি এবং ইসলামী শিক্ষা তথা নামাজ, কালাম, দোয়া, দরুদ ইত্যাদি শেখানোর কাজটি করে। এ কাজটির পারিশ্রমিক আরও করুণ। এসব হাফেজও এখন দেশের উন্নয়নে অনেক ভূমিকা রাখছে। গণতান্ত্রিক ধারায় এখন অনেক কোরআনের হাফেজ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য হয়ে গ্রাম উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। গ্রামের লোকেরা সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক সময় এসব হাফেজ ও ইমামের শরণাপন্ন হয়। মসজিদভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষায় এদের ভূমিকা অনেক। সাধারণত এরা খুবই মেধাবী হয়। অত্যন্ত অল্প বয়সে পুরো কোরআন মুখস্থ করার প্রক্রিয়া তাদের স্মৃতিশক্তির বিকাশ ঘটায়। বিদেশেও তাদের অনেক সুনাম আছে। আন্তর্জাতিক কিরাত প্রতিযোগিতায় বিগত কয়েক বছর যাবৎ বাংলাদেশের খুদে হাফেজরা প্রথম স্থান অধিকার করে আসছে। অনেকেই স্কলারশিপ নিয়ে মক্কা, মদিনা, মিসরসহ আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করছে। প্রতি বছর রমজানে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে খুদে হাফেজদের কোরআন প্রতিযোগিতা দেখে সবাই মুগ্ধ হয়। দৈবচয়নের মাধ্যমে কোরআনের মধ্য থেকে ছোট্ট একটি আয়াত পড়ে মডারেটর। নিষ্পাপ ওই খুদে হাফেজ সেটা শুনেই সুরেলা কণ্ঠে তিলাওয়াত শুরু করে। টিভির সামনে বসা সারা বিশ্বের অগণিত রোজাদার তা শোনে, দেখে ও চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দুই হাত তুলে খুদে হাফেজদের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করে। আরবি ‘হাফিজ’ এর বাংলা প্রতিশব্দ রক্ষক। তবে হাফিজ বলতে বোঝানো হয় যার কোরআন ৩০ পাড়া মুখস্থ আছে। ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, কোরআনে হাফেজদের রব্বুল আলামিন বিশেষ সম্মানের সঙ্গে দেখছেন এবং দেখবেন। যেমন ১. তিনি নামাজের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাবেন ২. তিনি ফেরেশতাদের সঙ্গে আছেন এবং থাকবেন ৩. তাকে কিয়ামতের দিন সম্মানের মুকুট ও সম্মানের পোশাক প্রদান করা হবে ইত্যাদি। মুসলিম সমাজে হাফেজরা খুবই সম্মানিত। কিন্তু স্থায়ীভাবে কাজ বা চাকরির তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই তাদের জন্য আমাদের সমাজে। তাই আল্লাহর মেহমান এই হাফেজদের রমজান উপলক্ষে কিছুটা সম্মান করা উচিত। এ অবস্থায় পবিত্র ঈদের আগেই হাফেজরা এ ধরনের একটি আর্থিক সুযোগ পেলে বড়ই উপকৃত ও কৃতার্থ হবে। এভাবে খুশিমনে বাংলাদেশের সব হাফেজ যদি একসঙ্গে দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে দোয়া করে, নিশ্চয়ই আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠবে। দূর হবে করোনার তান্ডব, দূর হবে সব বালা-মুসিবত। কল্যাণ হবে দেশের, দেশের মানুষের, জননেত্রী, বিশ্বনেত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ইনশা আল্লাহ।

লেখক : পরিচালক (আইআইটি) এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর