শনিবার, ১৬ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

হচ্ছে, হবে’র এই দেশে

সৈয়দ বোরহান কবীর

হচ্ছে, হবে’র এই দেশে

রবিবার, মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার। সপ্তাহের এ তিনটি দিন এখন আমার আতঙ্কের নাম। ভোর ৬টা ৪০-এ ঘড়িতে অ্যালার্ম থাকে। রোজার দিনে সাহরি শেষ করে এত ভোরে ওঠা একটু কষ্টের বৈকি। কিন্তু সেই কষ্ট নয়, আমার আতঙ্কের ভোর শুরু হয় অন্য কারণে। ভোরে উঠেই কপালে হাত দিয়ে আগে নিজের শরীরের উত্তাপ মাপি। এরপর রেডি হয়ে ৭টার আগেই মাকে নিয়ে রওনা দিই একটি প্রাইভেট হাসপাতালের উদ্দেশে।

আমার মায়ের সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস হয়। ক্যান্সারের পর তার দুটো কিডনি বিকল আজ তিন বছর। ডায়ালাইসিস দিয়েই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা। হাসপাতালে যাওয়া আজকাল অগ্নিপরীক্ষার মতো, কিংবা তার চেয়েও ভয়ের কোনো ব্যাপার। মূল গেটের সামনে পিস্তলের মতো জ্বর মাপার যন্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন একজন গার্ড। আমরা তিনজন। আমি, মা আর শর্মী (যে মায়ের দেখভাল করে) যেন আসামি। আমাদের কপালে গুলি ছোড়ার মতো জ্বর মাপে। কোনো কারণে যদি মায়ের শরীরের উত্তাপ ৯৮.৪ ডিগ্রির বেশি হয় তাহলেই সর্বনাশ! আমাদের হাসপাতালে ঢুকতে দেবে না। দূর দূর করে খেদিয়ে বিদায় করে দেবে। ডায়ালাইসিস একজন রোগীর লাইফ সেভিং ট্রিটমেন্ট। এটা বন্ধ হলে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু তাতে কী? এই হাসপাতালসহ যে কটি হাসপাতালে এখন এই জরুরি সেবা দেওয়া হয় তাদের এক নিয়ম। জ্বর, শ্বাসকষ্ট, হাঁচি-কাশি, সর্দি থাকলে পত্রপাঠ বিদায়! তাহলে রোগী কী করবে? হাসপাতাল জানে না। মাকে তাই সারাক্ষণ জিজ্ঞাসা করি, প্রেসার কত, ব্লাড সুগার কত, কোনো সমস্যা আছে কিনা। এখন অন্য কোনো রোগ-শোক রাখা যাবে না। এখন কোনো চিকিৎসা নেই। এ রকম চলছে গত দুই মাস। এর মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচের মৃত্যুর শোকাবহ ঘটনা ঘটল। একদম মা’র মতো, সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস নিতেন। তিন বছর ধরে। শেষ দিন তাঁর শ্বাসকষ্ট হয়েছিল। ব্যস, বিতাড়িত হলেন হাসপাতাল থেকে। এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে ঘুরলেন। গৌতম আইচ প্রশাসনের একজন বড় কর্তা। তাঁর মেয়ে চিকিৎসক। মেয়ের আর্তনাদ শুনে নিজের অবস্থা কল্পনা করেছি। শিউরে উঠেছি। প্রশাসনের বড় কর্তার যদি এই হয়, তাহলে আমার মায়ের কী হবে? আমি তো এক ছাপোষা মধ্যবিত্ত। অথচ যে পরিবারগুলো ডায়ালাইসিস রোগী নিয়ে সংগ্রাম করেন তারা জানেন, ডায়ালাইসিস আর শ্বাসকষ্ট একই সূত্রে গাঁথা। চার ঘণ্টা ডায়ালাইসিসের সময় একজন রোগীর প্রেসার কমে যেতে পারে, তার সুগার কমতে পারে, শ^াসকষ্ট হতে পারে। প্রতিটির জন্য ডিউটি ডাক্তার তৎক্ষণাৎ কিছু ব্যবস্থা নেন। কিন্তু এখন করোনাকালে একজন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা রোগীর এসব কিছু থাকা চলবে না। পারলে তাকে দাঁত কেলিয়ে হাসতে হবে। ৮ মার্চ যখন দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হলো, তখন থেকে দেশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর এই অবস্থা। বহির্বিভাগ বন্ধ। কার্যত আমরা এক চিকিৎসাহীন রাষ্ট্রে প্রবেশ করেছি। এখন বুকে ব্যথা হওয়া অপরাধ, অ্যাজমা রোগী ভয়ঙ্কর। এগুলো হলে আপনি চিকিৎসা পাবেন না। পাগলের মতো এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরতে হবে। তারপর কাউকে বলেকয়ে ‘মৃত্যুপুরী’ কুয়েত মৈত্রী কিংবা কুর্মিটোলায় জায়গা পাবেন। সেখানে যদি আপনার অদম্য মনোবল থাকে তাহলে আপনি অলৌকিকভাবে ‘পুনর্জন্ম’ লাভ করবেন। অন্যথায় আপনার মৃত্যু কিছু অপেক্ষার প্রহর মাত্র। ডায়ালাইসিসের রোগীদের মনের জোর থাকলেও শরীরে জোর নেই। করোনা হাসপাতালে যাওয়া মানে, তার জীবনের যবনিকা।

অথচ আমাদের প্রাইভেট হাসপাতালগুলো যেন চিকিৎসাসেবা দেয় তা নিয়ে কত কথা শুনছি গত দুই মাসে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী একদিন ভিডিও কনফারেন্সে বললেন, ‘এটা একদম ঠিক না। আমরা ব্যাপারটা দেখছি।’ দুই দিন পর তিনি একটু অভিমান করলেন। বললেন, ‘চিকিৎসাসেবা না দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘এসব কী হচ্ছে?’ কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের মালিকরা বিত্তশালী। আর বিত্তশালী মানুষের জন্য এ দেশে কোনো আইন নেই। তারা যা খুশি তাই করতে পারেন। এর মধ্যে একদিন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বিপুল উত্তেজনা নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সে এলেন। এখানে একটু বলে রাখি, গত মার্চ থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভিডিও কনফারেন্সের প্রতি মানুষের ব্যাপক আগ্রহ। করোনা পরিস্থিতি জানতে মানুষ ওই সময়টা টিভির সামনে বসে থাকে। এ সুযোগটির সীমাহীন অপব্যবহার করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তাদের সব অপকর্মের সাফাই পাওয়ার প্ল্যাটফরম হিসেবে ওই সময়টাকে তারা প্রায়ই ব্যবহার করে। তো মহাপরিচালক হাঁপাচ্ছেন। উত্তেজিত। এর মধ্যে বলবার ‘হলো’ বললেন। উত্তেজনায় মানুষের মুদ্রাদোষ বাড়ে। তার পাশে, পরিপাটি এক সফেদ ভদ্রলোক স্যুট-টাই পরে আছেন। টিভিতেই দেখা যাচ্ছে, তার চুলগুলো নিজের না। চাষ করেছেন। ফলে তাকে ঠিক মাদাম তুসোর বানানো এক মূর্তি মনে হচ্ছিল। তার পাশে আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী। মহাপরিচালক বললেন, দেশের সব প্রাইভেট হাসপাতাল এখন থেকে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দেবে। এরপর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ভিন্ন পরিচয়ে উপস্থাপিত হলেন। তিনি নাকি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। মন্ত্রী হয়ে এসব থাকা যায় নাকি? একটু ভিরমি খেলাম। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ‘মহাভাগ্যবান’। রানা প্লাজা দুর্যোগের সময় নিয়তি তাকে পাদপ্রদীপে আনে। কারণ ওই দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে আর কোনো চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। তাই এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে গেল দুর্ঘটনায় আহতদের একমাত্র চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র। ব্যস, কোনো দিন ছাত্রলীগ না করে, একদিন পুলিশের লাঠির বাড়ি না খেয়ে, কোনো ত্যাগ স্বীকার না করে তিনি পেলেন রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্বের মতো, মন্ত্রিত্ব আর এমপির টিকিট। সে প্রসঙ্গে এখানে কথা বলতে চাই না। তবে বেসরকারি হাসপাতালের সাধারণ সম্পাদকের পর সভাপতি মোবিন খান, জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণের মতো করে বললেন, ‘সব হাসপাতাল এ মুহূর্ত থেকে সব চিকিৎসা দেবে।’ ইনি কে? ডাক্তার? না, ইনি একজন ‘ব্যবসায়ী’। কুটিরশিল্প থেকে একেবারে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ‘মালিক’। মারহাবা! তাহলে ‘হাসপাতাল’ ‘সেবা’ নয় ‘ব্যবসা’। কিন্তু সেই ঘোষণা আজও বাস্তবায়ন হলো না। অবশ্য এর মধ্যে ঘটনা ঘটল, লাইভে এসে জনগণ ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীর দুই পরিচয় জানায় মন্ত্রী মহোদয় বোধহয় একটু কুণ্ঠিত হলেন। তড়িঘড়ি করে পাঁচ তারকা হোটেলে বৈঠক ডাকা হলো। সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে ডা. এনামুর রহমান সরে দাঁড়ালেন। সরকার যখন সব ধরনের জমায়েত, সভা নিষিদ্ধ করেছে তখন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মালিকের এ বৈঠক সংক্রমণ ব্যাধি আইন অনুযায়ী অপরাধ কিনা সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সাধারণ সম্পাদকের যাই হোক দায়িত্বে এলেন ডা. আনোয়ার খান। যিনি কিছু দিন ধরেই বলছিলেন, তার হাসপাতালে খুব শিগগিরই করোনা রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হবে। কিন্তু শিগগিরই এখনো বর্তমান হয়নি। তার পরিচয়টা এজন্য দিলাম যে গৌতম আইচ ‘ল্যাবএইড’ থেকে গলাধাক্কা খেয়ে প্রথম যে হাসপাতালে গিয়েছিলেন তা হলো আনোয়ার খান হাসপাতাল। কিন্তু সেখান থেকেও তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বুঝুন তাহলে? লাইভে বললেন, সব চিকিৎসা দেওয়া হবে। বাস্তবে হাসপাতাল করোনামুক্ত রাখার কি নিবিড় চেষ্টা! এটা কি শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়? ক্ষমতা বলে কথা। তাই করোনাকালে অসুখ হলে রক্ষা নেই। কেউ আপনার চিকিৎসা করবে না। অবশেষে আপনাকে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে হবে। আমার ‘মা’কে নিয়েও সেই আতঙ্কে কাটে প্রতিটা দিন। আর ওই হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে গিয়ে মৃত্যু হলে আরও ‘ভয়ঙ্কর’ পরিস্থিতি। আত্মীয়স্বজনকে না জানিয়েই লাশ দাফন করা হবে। বলা হবে, আপনাকে ফোন করা হয়েছিল। আপনি ধরেননি। বাঃ, একবার ফোন না ধরলেই মৃতদেহ দাফন বা সৎকার করা যায়? মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু প্রতিটি মানুষের শেষ ইচ্ছা থাকে, তার মৃত্যু হোক শান্তিপূর্ণ, তার শেষকৃত্য হোক পবিত্র। এখন সেই সুযোগ নেই। হাসপাতালের চিকিৎসাহীনতায় আমার মায়ের মতো বয়ঃপ্রবীণরা এখন মৃত্যুর অপেক্ষায় মাত্র। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু দুই ভাবে হতে পারে। এক. আপনার টাকা আছে, কিন্তু ডাক্তাররা আপনাকে চিকিৎসা দেবে না। দুই. আপনার টাকা নেই আপনি চিকিৎসা নিতে অক্ষম। করোনা সংকটে আমরা দুই রকম সংকটেই পড়েছি। সপ্তাহে তিন দিন মনে হয় এখন বোধহয় যমদূতের মতো গার্ড পিস্তলের মতো জ্বর মাপার যন্ত্র দিয়ে গুলি করবে। আমার মাকে জানিয়ে দেবে, এই সুরম্য হাসপাতালে আপনি প্রবেশের অনুপযুক্ত। তারপর আমরা গৌতম আইচ এবং এ রকম অনেকের মতো এই হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরব। সবাই মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেবে। একসময় বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন আমার মা। যেমন প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন অনেক মানুষ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোনো সেমিনার কিংবা ভিডিও কনফারেন্সে এসে বলবেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালগুলো ঠিক কাজ করছে না। এটা হতে পারে না। তারা চিকিৎসা দিতে বাধ্য।’ ইদানীং অবশ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে আমার বিএনপি নেতাদের মতো মনে হয়। অনেকটা বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর মতো। ১৩ মে বুধবার সদ্য যোগ দেওয়া চিকিৎসকদের বরণ করে নেওয়ার অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি। বললেন, ‘দোকানপাট খুলে দেওয়ার ফলে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে।’ ও মা! এ কী কথা? করোনা সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির প্রধান তো তিনিই। তিনিই সরকারের মন্ত্রী। দোকান, গার্মেন্ট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সরকারের অংশ। সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্তের দায় তাঁর ওপরও বর্তায়। তিনি কি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন দোকান খোলা ঠিক হবে না? তিনি কি বলেছিলেন গার্মেন্ট খুললে সর্বনাশ হবে? সরকারের ভিতরে এসব কথা না বলে, প্রকাশ্যে এসব বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আসলে কী প্রমাণ করতে চান? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের ভিতর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে মতানৈক্য থাকতেই পারে। কিন্তু যখন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন সবাইকে ওই সিদ্ধান্তের পক্ষে দাঁড়াতে হয়। তা না হলে তা হয় শপথভঙ্গ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত আড়াই মাস শুধু হচ্ছে, হবে বলেছেন। পরিকল্পনা, উদ্যোগের গল্প শুনিয়েছেন। কিন্তু হাসপাতালগুলোয় মানুষ যেন ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা পায় তার ব্যবস্থাটি পর্যন্ত করতে পারেননি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দোষ দিয়ে লাভ কী। যদি কখনো তিনি হাসপাতালের স্বাভাবিক চিকিৎসার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতেও পারেন, তখন মানুষ অর্থের অভাবে চিকিৎসা নিতে পারবে না। আমরা সেই পথেই যাচ্ছি। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা তার এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, ‘একজন ক্যান্সার বা কিডনি রোগী কেবল একা ভোগেন না, তিনি তার পুরো পরিবারকে নিঃস্ব করে দেন।’ সরকার এবং রাষ্ট্র্র পরিচালনায় যারা জড়িত তারা কি জানেন, একজন ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা করাতে আমাদের মতো কত মানুষ প্রায় নিঃস্ব হয়েছে। তারা কি জানেন, সপ্তাহে তিনটি ডায়ালাইসিস করলে, মাসে সব মিলিয়ে কত খরচ হয়? ওই পরিবারগুলোর কোনো স্বপ্ন থাকে না, কোনো অর্থ থাকে না, ঋণগ্রস্ত, নিঃস্ব হয়ে যায়। একসময় সামর্থ্যহীন মানুষ অসহায় আত্মসমর্পণ করে। দেশের অন্তত ৬৭ ভাগ কিডনি রোগী মারা যান ডায়ালাইসিস করাতে অসমর্থ হওয়ার কারণে। যে অবস্থা চলছে, তাতে আমাদের মতো মধ্যবিত্তের মৃত্যু অনিবার্য। হয় হাসপাতাল চিকিৎসা দেবে না, অথবা আমরা আমাদের চিকিৎসার শেষ সামর্থ্যটুক হারিয়ে ফেলব। সরকার যে বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে তাতে মধ্যবিত্তের স্থান কোথায়? আমি খুঁজলাম। ৯২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার এই বিরাট অর্থ বণ্টনে, আমার কিংবা আমাদের মতো মানুষের জন্য এক টাকাও হিস্সা নেই। গার্মেন্ট মালিকরা ৫ হাজার কোটি টাকা পাচ্ছেন শ্রমিকের বেতনের জন্য। আমাদের মতো, ক্ষুদ্র, মাঝারি ছোটখাটো অফিস যারা চালাই, তাদের কর্মীদের বেতন কে দেবে? আমি জানি, সরকারের কেউ কেউ লাফিয়ে উঠবেন। বলবেন, ক্ষুদ্র, মাঝারি প্রতিষ্ঠানের জন্য ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। আমি ব্যাংকে ফোন করেছিলাম। ব্যাংক বলেছে, এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। (আবার সেই হবে, হচ্ছে) তবে, ব্যাংক এটাও জানিয়ে দিয়েছে, সেখানে বিজ্ঞাপনী সংস্থা, গণমাধ্যম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ সুবিধা দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ কী? ব্যাংক জানাল, এসব খাতে ব্যাংক কখনো ঋণ দেয় না। তা ছাড়া ৯২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বিলি বণ্টন করা হবে ব্যাংকি সেক্টরের মাধ্যমে। সে সেক্টরেই তো রয়েছে কিছু লুটেরা। যারা ইতিমধ্যে ব্যাংকিং খাত ধ্বংস করে দিয়েছে। ব্যাংকের টাকা লুট করে কানাডা, সিঙ্গাপুর, লন্ডনে বিত্তের পাহাড় গড়েছে। বাংলাদেশে ব্যাংক মালিকদের একটি বড় অংশই লুটেরা। তাই ওই প্রণোদনার টাকা বানরের পিঠা ভাগের মতো লুটেরারাই ভাগ-বাটোয়ারা করে নেবে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। আমাদের মতো অনেক মানুষ, এসব প্রণোদনার কানা সিকিও পাব না। এ দেশে সরকারি কিছু পেতে হলে ‘বিশেষ’ হতে হয়। সরকার সাবেক ভিলেন, ধনী গায়ক-গায়িকা, সেলিব্রেটি, পরিত্যক্ত রাজনীতিবিদদের চিকিৎসার জন্য লাখ লাখ টাকার চেক দেয়। ওই টাকা দিয়ে তারা বিদেশে বিশেষায়িত চিকিৎসা করান। অথচ বহু মানুষ টাকার অভাবে দেশেই চিকিৎসা করাতে পারে না। কারণ, তারা ‘বিশেষ’ নন। বিশেষ না হলে, রাষ্ট্রের প্রণোদনা পাওয়া যাবে না। বিশেষ না হলে চিকিৎসা বন্ধ হবে। বিশেষ না হলে আসলে আপনি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। নিজের কথায় ফিরে আসি। মধ্যবিত্তের ঘোড়ারোগ থাকে। করোনার সময় চারপাশে মানুষের হাহাকার। রাস্তায় বেরোলেই দেখা যায় কিছু মানুষ রাস্তার দুই পাশে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। একটা গাড়ি থামলে তারা ছুটে যায় কিছু সাহায্যের আসায়। দুই মাস প্রায় কর্মহীন। তার পরও মধ্যবিত্তের মানবিকতা জাগ্রত হলো। কিছু খাবার জোগাড়যন্ত্র করে, স্ত্রীকে নিয়ে বেরোলাম এক সন্ধ্যায়। সমাজে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে এই বোধ থেকে। সামান্য ওই সাহায্য নিতে মানুষ যেভাবে হুমড়ি খাচ্ছিল তাতে আমার প্রশ্ন জাগল, সরকার যে বলছে, এত এত ত্রাণ বিতরণ করছে, সেই ত্রাণ আসলে ঠিকঠাকমতো সব মানুষ পাচ্ছে তো? নাকি কিছু মানুষ বারবার পাচ্ছে, কেউ একবারও পাচ্ছে না? যাই হোক, সেই সন্ধ্যার একটা দৃশ্য আমার চোখে ফ্রেমের মতো বিঁধে আছে। কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছি না। গুলশানে একজন পঙ্গু মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ছাতা হাতে একজন। শার্ট-প্যান্ট পরা। দেখলে মনে হবে, এই মাত্র বোধহয় অফিস শেষ করে রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন। বাড়ি ফিরবেন। গাড়ি থেকে পঙ্গু মানুষটিকে আমরা যখন সাহায্যের প্যাকেটটা দিচ্ছিলাম তখন লোকটা আমার দিকে এগিয়ে এলো। লোকটার চোখ ছলছল করছে। আড়ষ্টতা তার শরীরজুড়ে। এ ধরনের সহায়তার জন্য তিনি অভ্যস্ত নন। আমাদের কাছে এসে বললেন ‘প্লিজ’।

তৎক্ষণাৎ তার হাতে একটা প্যাকেট দিলাম। কিন্তু মুহূর্তের জন্য আমার মনে হলো, ওই মানুষটি হয়তো আমি। কদিন পরে হয়তো এভাবে আমিও দাঁড়াব কোনো অচেনা ফুটপাথে একটু সাহায্যের জন্য। কিংবা ওই মানুষটিই বাংলাদেশ। অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। জানে না কী হবে তার আগামীকাল, অথবা কীভাবে হবে ভোর। কারণ, এই রাষ্ট্র কতিপয় মানুষের জন্য সবকিছু সঁপে দিয়েছে। আমাদের জন্য এ দেশ হলো কেবল দেখছি, হচ্ছে, হবে’র আশ্বাস, আর কিছু না।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর