শনিবার, ১৬ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে কৃষিই হবে টিকে থাকার মূলমন্ত্র

শাইখ সিরাজ

করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে কৃষিই হবে টিকে থাকার মূলমন্ত্র

একটি দিন থেকে আরেকটি দিন হয়ে উঠছে আতঙ্কের। প্রতিদিন বাড়ছে কভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা। সব যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এর মাঝে ঈদ উপলক্ষে মার্কেটগুলো খুলে দেওয়ায় করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা আরও বেড়ে গেছে। শিশুদের সঙ্গে নিয়ে মার্কেটগুলোয় ঢল নেমেছে ক্রেতার। মানছে না স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্বের নেই বালাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার সেই কৌতুকটাই না সত্যি হয়! দেখা গেল সত্যি সত্যি বাজার করতে গিয়ে বাংলাদেশি জাতিটাই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল! বিলুপ্ত না হলেও ভয়াবহ রকমের সংকটের দিকে যে আমরা যাচ্ছি সে বিষয়ে নিশ্চয়ই কারও সন্দেহ নেই। ভিয়েতনাম যেভাবে করোনা মোকাবিলা করল, আমরা কেন সেভাবে পারলাম না? বেশ কিছু বিপণিবিতান সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা দোকান খুলবে না। তাদের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ। অন্য ব্যবসায়ীদের কাপড়ের দোকান কেন খুলতেই হবে? আর ক্রেতাদেরও কেন ঝুঁকি নিয়ে ঈদের শপিংয়ে যেতেই হবে। একটা ঈদ নতুন কাপড় ছাড়া উদ্যাপন করা কি খুব কঠিন হয়ে যাবে! এই সময়ে এসে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। বেড়েছে উৎসব, উদ্যাপন। কমেছে অভাব। ছেঁড়া জামা-কাপড় পরা মানুষ দেখা যায় না। প্রত্যেকের ঘরে অবশ্যই প্রচুর জামা-কাপড় রয়ে গেছে। পৃথিবীর এই সংকটময় মুহূর্তে নিজেদের জন্য নতুন পোশাক না কিনে, যে মানুষটি কাজ হারিয়েছে, যার ঘরে খাবার নেই, যার ওষুধ প্রয়োজন, সেই মানুষটির পাশে দাঁড়ানোই মনে করি আমার কর্তব্য। ধর্ম তো তাই বলে। দেশীয় ঐতিহ্য বহন করার স্লোগান দেওয়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের বিক্রয় কেন্দ্রগুলো খুলে দিয়েছে। সেসব দোকানে ভিড় জমে গেছে। এ অবস্থায় কীভাবে করোনার সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হবে? এসব প্রতিষ্ঠান তো এত দিন অনেক লাভ করেছে। গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে ২০ টাকা দিয়ে কিনে আনা পণ্য ২ হাজার টাকায় বিক্রি করেছে। এই কয়েকটা দিন সেই লাভের টাকা থেকে তারা কি পারত না তাদের কর্মচারী আর দরিদ্র গ্রামীণ মানুষকে স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে! মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলে এ কেমন সামাজিক বাণিজ্য?

পৃথিবীতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পাঁচ মাস অতিবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশে পার হয়েছে সোয়া দুই মাস। মানুষ আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা ও হতাশার ভিতর থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে উঠেছে। মাহে রমজানের প্রথম দুই দশক রহমত ও মাগফিরাতের অংশ পার করে এসেছি আমরা। পৃথিবীব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায় এই সময়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও রহমতের প্রার্থনায় মগ্ন আছে। মাহে রমজানের চলতি দিনগুলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র লাইলাতুল কদর রয়েছে এ দিনগুলোর মধ্যে। হাজার রাত অপেক্ষা উত্তম এই রাতেও বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিম প্রার্থনায় মগ্ন থাকবে মহামারী থেকে মুক্তির জন্য। আল্লাহ আমাদের এই কঠিন সময় থেকে মুক্তি দিন। একদিকে সংক্রমণের হার সীমিত রেখে মানুষের জীবন বাঁচানো, অন্যদিকে কার্যত স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া- এ নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার। অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে ইউরোপ-এশিয়ার অনেক দেশ শর্তসাপেক্ষে চলমান লকডাউন শিথিল করতে শুরু করেছে। তবে দেশগুলো খুব একটা ভালো অবস্থানে রয়েছে তা বলা যাবে না। মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে আসায় এসব দেশে কভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। ফলে জনস্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ আরও বাড়ছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মঙ্গলবার আমার কাছে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ১৯৯৫ সাল থেকে বর্তমান অবধি খাদ্য সরবরাহের তথ্য বিশ্লেষণ ও খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোর অতীতের অর্থনৈতিক প্রবণতা স্টাডি করে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা আশঙ্কা করছে, কভিড-১৯-এর কারণে মন্দা থেকে সৃষ্ট ক্ষুধার্তের তালিকায় লাখ লাখ মানুষ নতুন করে যুক্ত হতে পারে। গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বৈশ্বিক জিডিপি ৩.৩% বৃদ্ধির আভাস দিয়েছিল, কিন্তু এপ্রিলে এসে যখন বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য লকডাউনে, তখন এটি মাইনাস ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। অনেক দেশই তার অর্থনীতিতে তীব্র ধাক্কা খাবে এবং তা হবে সে দেশের জন্য বেদনাদায়ক এক অভিজ্ঞতা। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মনে করছে, এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষি হতে পারে রাষ্ট্রের অর্থনীতি সচল রাখার হাতিয়ার। ফলে রাষ্ট্রের উচিত হবে কৃষককে উজ্জীবিত রাখা। এ সংকটে কৃষককে যদি তার কৃষিকাজে যা প্রয়োজন তা পুরোপুরি মেটানো যায়, তবে তারা তার পরিবার, সমাজকে নিয়ে ভালো থাকবে এবং রাষ্ট্রের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

মহামারী ঠেকাতে সুস্বাস্থ্যই প্রথমে প্রত্যাশিত, সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর খাবার। আমাদের উচিত হবে দরিদ্র ও অপুষ্টিতে ভুগছে এমন জনগণের জন্য প্রকল্প নেওয়া, তাদের জন্য নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা, খাদ্য সঞ্চয় ও সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা।

করোনায় মানুষের সব কর্মক্ষেত্রে অচলাবস্থা দেখা গেলেও প্রাকৃতিক গতি ও শক্তির উৎকর্ষ অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ছে বলে গবেষকরা বলছেন। যানবাহন, কলকারখানা সীমিত চলাচলের করেণ বাতাসে দূষণ কমছে। প্রাকৃতিক প্রাণিকুল কিছুটা উচ্ছলতা পেয়েছে বলেও উদ্ভিদ ও প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন। আশার কথা, এর মধ্যে আমাদের বছরের সবচেয়ে বড় ফসল বোরো ধানের আশাব্যঞ্জক ফলন হয়েছে। যে জায়গাটিতে আমাদের শঙ্কা ছিল, সেই হাওরের ফসল কেটে ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছে। গত সোমবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাঠানো প্রেসনোটে বলা হয়েছে, হাওরের শতভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। এ ছাড়া সারা দেশে কাটা সম্পন্ন হয়েছে ৩৯ ভাগ। আজ পর্যন্ত তা ৫০ ভাগের বেশি সম্পন্ন হয়েছে বলে আশা করা যায়।

এই সময়ে কালবৈশাখীসহ ঝড়বৃষ্টিতে অন্যান্য বছর ফসলের যে ক্ষতি হয়, এবার তেমন ক্ষতি হয়নি। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি মাথায় রেখেই সতর্কতা মেনে কৃষক তার ফসলি খেতে কাজ করে চলেছে। এই সময়ে কৃষির গুরুত্ব সাধারণ কৃষকের মাঝেও সমানভাবে অনুভূত হচ্ছে।

করোনাভাইরাস ঠেকাতে চলমান অঘোষিত লকডাউনে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে গত পয়লা মে সরকার বিশেষ পারসেল ট্রেন চালু করে। শুরুতে তিনটি রুটে তিন জোড়া বিশেষ পারসেল ট্রেন পরিচালনা করা হয়। রুটগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকা, ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ-ঢাকা ও খুলনা-ঢাকা-খুলনা। এসব ট্রেনে করে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য যেমন শাকসবজি, খাদ্য ও পচনশীল সামগ্রী পরিবহন করা হচ্ছে। এর মধ্যে দু-একটি রুটে পরিবহন-উপযোগী কৃষিপণ্য না পেয়ে একটি রুটে ট্রেন চলা বন্ধও হয়ে গেছে। পরে ৯ মে পঞ্চগড় থেকে চালু হলো পণ্যবাহী ট্রেন স্পেশাল পারসেল এক্সপ্রেস। পঞ্চগড়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রেলওয়ে স্টেশনে ফিতা কেটে ও পতাকা উড়িয়ে এ ট্রেনের উদ্বোধন করেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম। এ বিষয়ে স্কাইপেতে মন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়। প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সরকার ২৪ মার্চ দেশব্যাপী সব যাত্রীবাহী ট্রেন চলা বন্ধ ঘোষণা করে। বলে রাখি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই কৃষিপণ্য পরিবহনের বিশেষায়িত ট্রেন সার্ভিস রয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কিছুদিন আগে সারা দেশেই শুকনা ও পচনশীল কৃষিপণ্য পরিবহন-উপযোগী বিশেষায়িত ট্রেন হিসেবে কিষাণ ট্রেন চালুর ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে তারা পৃথক ট্রেন নেটওয়ার্কও গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে।

কিন্তু স্থানীয় কৃষকের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝলাম, কৃষিপণ্য বহনের জন্য ট্রেন সার্ভিস চালু হলেও তার পরিকল্পিত কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। সাধারণত কৃষক খেত থেকে ফসল তোলে প্যাকেজিং করে, তাতে তার নাম লিখে রাখে। ট্রাক এসে বাড়ির সামনে বা খেত থেকে সেই প্যাকেট তুলে নেয়। বাজারে পণ্য বিক্রির পর নাম দেখে পণ্যের ওজন অনুযায়ী দাম পায়। এমন একটি সিস্টেম দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ট্রেনে কোথা থেকে পণ্য উঠবে, কোথায় নামবে, কীভাবে এটি চলছে এ বিষয়ে কৃষক তেমন কিছু জানে না। কৃষিপণ্য পরিবহনে বিশেষ ট্রেন চালুর ক্ষেত্রে চারটি প্রধান কৃষিপণ্য উৎপাদক অঞ্চলকে বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। প্রিয় পাঠক! আপনাদের অনেকেরই মনে থাকবে, ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন হৃদয়ে মাটি ও মানুষের যাত্রা হয়, তখন আমরা শুরুতেই যে কর্মপরিকল্পনা নিয়েছিলাম, তা হচ্ছে উৎপাদক-ভোক্তার মধ্যে পণ্যমূল্যের ব্যবধান কমিয়ে আনা। সেবারই প্রথম দর্শকের সামনে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছিল কৃষিপণ্যের বাজার পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র। একটি পণ্যের দাম হাতবদল হতে হতে কীভাবে ১০-২০ গুণ হয়ে যায়।

প্রায় এক দশক আগে রাজধানীর প্রসিদ্ধ একটি রিটেইল চেইন শপের সঙ্গে যৌথভাবে আমরা কৃষকের পণ্য সরাসরি বাজারজাত করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। উদ্যোগটির নাম ছিল ‘সবুজ সেতু’। সেটি অবশ্য নানা কারণেই বেশিদিন টেকেনি। পরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও উদ্যোগে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা সলিডারিডাড যশোর ও খুলনায় পৃথক দুটি ভিলেজ সুপার মার্কেটও গড়ে তোলে। এখনো নানাভাবে চেষ্টা চলছে কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে পণ্যমূল্যের ব্যবধান কমিয়ে আনার। অনেকে অনলাইনে বাণিজ্যিক আকারে এমন কাজ করছে। তিন বছর ধরে কৃষিপণ্য ন্যায্যমূল্যে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করছে একটি প্রতিষ্ঠান। এই করোনা পরিস্থিতিতেও কৃষকের পণ্য একটি নির্দিষ্টসংখ্যক ভোক্তার কাছে সঠিক দামে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ চলছে। প্রতিষ্ঠানটির নাম জি ফোর জি কৃষি গ্রুপ। গাজীপুরের বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানায় কর্মরত ১ হাজার ৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর হাতে করোনা পরিস্থিতিতে নিরাপদ খাদ্য তুলে দিতে তাদের এ প্রচেষ্টা। সরাসরি কৃষক এখানে তাদের পণ্য বিক্রি করে। কোনো মধ্যস্বত্বভোগী এখানে নেই।

নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখান থেকে পণ্য কেনে খুব খুশি। এ কার্যক্রমের পাশেই রয়েছে স্বাভাবিক বাজার, যেখানে কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনে অন্যরা বিক্রি করেন। তবে ওই বাজারে তেমন একটা ভিড় নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিমধ্যে এ বাজারের একটা ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে।

এবার আসা যাক বাজার পরিস্থিতিতে। কয়েক মাস আগে দেশে পিয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ১ কেজি পিয়াজের দাম পৌঁছে যায় ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। এখন অবশ্য পিয়াজের দাম বেশি নয়। এই করোনা পরিস্থিতিতে টিসিবি পিয়াজ বিক্রি করছে ২৫ টাকা কেজিতে। এতে সাধারণ স্বল্পায়ী ভোক্তা শ্রেণি উপকৃত হচ্ছে। কিন্তু পিয়াজ চাষিরা বলছে, সরকারি এ উদ্যোগের কারণে পিয়াজের বাজার পড়ে গেছে। এমনিতেই গত মার্চ থেকেই পিয়াজের বাজার নিম্নমুখী। কাক্সিক্ষত লাভ দূরে থাক, লোকসানের মুখে পড়েছে পিয়াজ চাষিরা। চাষিরা মনে করে, বাজার পরিস্থিতি ও কৃষিপণ্যের বাণিজ্যের বিষয়গুলোয় কৃষকের স্বার্থ আগে সংরক্ষণ করা উচিত। পণ্যের উৎপাদনমূল্য আগে বিবেচনা করে ন্যূনতম লাভ নিশ্চিত করে অতঃপর বাণিজ্যিক উদ্যোগ নেওয়া উচিত। তারা যদি কষ্টার্জিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পায়, তাহলে হতাশ হওয়ার যথেষ্ট কারণ থেকে যায়। উৎপাদন পরিস্থিতির ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

ভরা মৌসুমে দেশের অন্যতম পিয়াজ উৎপাদনকারী জেলা পাবনায় অব্যাহতভাবে কমছে পিয়াজের দাম। গত এক সপ্তাহে জেলার বড় পিয়াজের হাটে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে পিয়াজ। কৃষক বলছে, এ দামে তাদের টিকে থাকা কঠিন। এ বছর পাবনায় ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে পিয়াজ আবাদ হয়েছে। উৎপাদিত হয়েছে ৬ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন পিয়াজ। গত বছরও পিয়াজের ফলন ভালো ছিল কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষক সংরক্ষণ করতে না পারায় অর্ধেক পিয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। এতে পিয়াজের সংকট সৃষ্টি হয় ও বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। গবেষকরা হিসাব করে দেখেছেন, দেশে পিয়াজের উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ফারাক মাত্র ২ লাখ টনের। বছরে দেশে পিয়াজ হয় ২৩ লাখ টনের ওপরে। আর চাহিদা রয়েছে ২৪ থেকে ২৫ লাখ টনের। তার পরও শুধু নষ্ট হওয়ার কারণে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ টন পিয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। দেশে উৎপাদিত ৩০-৩৫ শতাংশ পিয়াজ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়। আমরা যদি এই সংরক্ষণের জায়গায় গুরুত্ব দিতে পারি, তাহলে আমাদের পিয়াজ আমদানি করতে হয় না।

এ বিষয়ে আমি কথা বলেছি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, কৃষকের ন্যূনতম লাভ যেন থাকে সে বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। পিয়াজের মৌসুমে বাইরের দেশ থেকে পিয়াজ আমদানি করায় এ দেশের কৃষক যে মূল্য পাচ্ছে না সে ব্যাপারটিও আমি তুলে ধরি। তিনি এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন।

করোনা পরিস্থিতির ভিতরেই দেশে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম চলছে। তা হলো পিয়াজ বীজের মৌসুম। পিয়াজ বীজ একটি অসাধারণ সৌন্দর্যময় ফসল। বাজারমূল্যের বিবেচনায় এটি বেশ অর্থকরী ফসল। ফরিদপুরের অম্বিকাপুর ইউনিয়নের গ্রামগুলো পিয়াজ বীজ উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। এখন বীজের খেতগুলোয় চলছে কালো সোনা খ্যাত পিয়াজ বীজ তোলা ও মাড়াইয়ের কাজ। এসব কাজে করোনা পরিস্থিতিতে এলাকার এক কৃষক আরেক কৃষকের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে।

এবার পিয়াজ বীজের উৎপাদন কম হয়েছে। গত বছর হয়েছিল ১৯ হাজার হেক্টরে। এবার হয়েছে ১৪ হাজার ১৫ হেক্টরে। এতে ধারণা করা যায়, আগামীবার পিয়াজ উৎপাদনের ওপর এর প্রভাব পড়বে। এ ক্ষেত্রে এখনই সরকারের উচিত কার্যকর প্রস্তুতি গ্রহণ; যাতে পিয়াজের উৎপাদন কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়। আরেকটি প্রসঙ্গে দৃষ্টি দিতে চাই। আর কয়েক দিনের মধ্যেই বাজারে উঠবে পাকা আম। করোনা পরিস্থিতিতে আমের আমেজ ভুলে আছে মানুষ। কিন্তু মৌসুমি ফলগুলো আমাদের পুষ্টি উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমের মৌসুমে মানুষ যাতে সঠিক সময়ে ভালো ও গাছপাকা আম পেতে পারে সেজন্য গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবার আরও সচেতনভাবে জাতভেদে গাছ থেকে আম পাড়ার সময়সূচি নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনাও করেছেন। আমিও ওই সভায় যুক্ত থেকে বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে মতামত রেখেছি।

করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি কত দিনে কমবে বা আমাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হবে তা বলা কঠিন। এখনো এ নিয়ে সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না গবেষক ও নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু যেভাবেই হোক, এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই আমাদের টিকে থাকতে হবে। আমাদের ফসল উৎপাদনের গতি স্বাভাবিক রাখতে হবে। ইতিমধ্যেই সারা দেশে আগামী মৌসুমের ফসল উৎপাদনে সহায়তা হিসেবে বিভিন্ন কৃষি উপকরণ বিতরণ শুরু হয়েছে। জোর দেওয়া হচ্ছে যার যতটুকু পরিসর আছে, সে পরিসরেই কৃষিকাজ করার জন্য। আশা করি, এ আহ্বানে সবাই সাড়া দেবেন। শহর-নগর-গ্রামে যে যেখানে আছেন, করোনার এই সময়ে নিজে ও পরিবার-পরিজন নিয়ে টিকে থাকার জন্য স্বল্পপরিসরে হলেও কৃষি উদ্যোগ নেওয়াটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ আমাদের সবার সহায় হোন।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর