সোমবার, ১৮ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা প্রতিরোধে মাস্ক ব্যবহার নিয়ে বিভ্রান্তি নয়

ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

করোনা প্রতিরোধে মাস্ক ব্যবহার নিয়ে বিভ্রান্তি নয়

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মাস্ক ব্যবহারসহ বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আমার নাম ব্যবহার করে, কিংবা প্রকাশিত বক্তব্য বা লেখনীর অংশ বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে। তাই সীমিত সংখ্যক মানুষের মধ্যে তৈরি এই বিভ্রান্তি দূর করতে, মাস্ক বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণাকে পরিষ্কার করতে আজকের এই লেখা। প্রথমেই বলে রাখি আমি কখনই বলিনি যে, করোনা প্রতিরোধে ‘কারো’ই বা সবার মাস্ক পরিধান করার প্রয়োজন নেই। বরং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে কখন, কে এবং কীভাবে মাস্ক পরবেন সে বিষয়ে বারবার আলোচনা করেছি। এমতাবস্থায়, আমার মনে হয় করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে মাস্ক বিষয়ক যাবতীয় তথ্য আমাদের জেনে নেওয়া উচিত। যাতে করে আমরা বুঝতে পারি কোন তথ্য সঠিক এবং কোনটি ভুল।

বর্তমান বিশ্বে যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে একটি উল্লেখযোগ্য মানবসৃষ্ট জটিলতা বা সমস্যা হচ্ছে সঠিক তথ্যের পরিবর্তে নানা ধরনের ভুল তথ্য, ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য পরিবর্তন, কিংবা আংশিক তথ্য প্রকাশ, গুজব বা বিভ্রান্তি ছড়ানো। এক কথায় যাকে বলে তথ্য-বিভ্রাট। আর এই বিভ্রান্ত তথ্য ভাইরাসের চেয়ে দ্রুত ছড়ায়! ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের অবাধ বিচরণের কারণে এই তথ্য-বিভ্রাট কখনো কখনো উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে করা হয়, আবার কখনো বা বুঝে না বুঝে। অধিকাংশ সময় মানুষ বিচার-বিশ্লেষণ না করেই আঙ্গুলের একটা চাপেই তা অন্তর্জালের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় মহামারীর মতো। যার মাশুল গুনতে হয় সাধারণ মানুষকে, এসব ভ্রান্ত ধারণা বা নানা রকম ভুল তথ্যে বিভ্রান্ত হয়ে মানুষের জীবন হয় হুমকির সম্মুখীন। আর এই তথ্য-বিভ্রাট যদি কখনো পেশাজীবী বা দক্ষ মানুষ দ্বারা হয়, তাহলে তো কোনো কথায় নেই! মানুষ চোখ বুজে তা বিশ্বাস করে এবং তা ছড়িয়ে দিয়ে নিজের অজান্তেই সবার ক্ষতি সাধন করে। আসুন আনুষঙ্গিক কথা না বাড়িয়ে, মাস্ক বিষয়ে প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত খুঁটিনাটি বিষয়গুলো জেনে নিই।

বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের একেবারে শুরুর দিকে ১৪ মার্চ তারিখে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর স্বাস্থ্য পাতায় ‘করোনায় মাস্ক বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের প্রয়োজন আছে কি?’ শিরোনামের আমার একটি লেখার মাধ্যমে মাস্ক বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছিলাম এবং সেই দিকনির্দেশনাটি এরূপ : ‘প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে সুস্থ সাধারণ মানুষের মাস্ক ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এই ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না, বরং তা হাঁচি-কাশি এবং জীবাণুযুক্ত হাতের স্পর্শে বেশি বেশি ছাড়ায়। ভাইরাসগুলো বহনকারী ড্রপলেটগুলো তুলনামূলক ভারী। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে নির্গত ভাইরাস এক মিটারের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে না, বরং তা মাটিতে বা ঘরের মেঝেতে পড়ে যায়। তাই দেখা যায়, শুধু আক্রান্ত ব্যক্তির এক মিটারের মধ্যে কোনো মানুষ থাকলে তার মধ্যে করোনা ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে, অন্যথায় রোগ ছাড়ানোর ঝুঁকি নেই বললেই চলে। তাই গণহারে, রাস্তাঘাটে ঢালাও মাস্ক পরে চলাফেরার কোনো যুক্তিই নেই। বরং অন্যকে রক্ষার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরবেন আক্রান্ত ব্যক্তি। যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির মুখ বা নাক থেকে ভাইরাস বা জীবাণু অন্য মানুষে ছড়িয়ে না পড়ে। পাশাপাশি আক্রান্ত বা কোয়ারেন্টাইনে রাখা রোগীদের সেবাদানকারী ডাক্তার, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। তাছাড়া বিদেশফেরত যাদের বাড়িতে নিজেদের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা এবং তাদের সেবাদানকারী পরিবারের লোকজন এবং আশপাশের লোকজন শুধু একই ঘরে থাকার সময় মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন। তবে শুধু মাস্ক পরলেই হবে না, সেই সঙ্গে কিছু নিয়মও মানতে হবে। যেমন কিছুক্ষণ পরপর সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া অব্যাহত রাখতে হবে, নিয়মিত মাস্ক পরিবর্তন করতে হবে, ব্যবহারের পর মাস্ক যেখানে সেখানে না ফেলে ঢাকনিযুক্ত পাত্রে ফেলতে হবে এবং পরবর্তীতে তা পুড়িয়ে ফেলা ভালো।’ পরবর্তীতে বিভিন্ন লেখা ও গণমাধ্যম, প্রিন্ট মিডিয়ার সাক্ষাৎকারে এ তথ্যই আমরা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মানুষকে নির্দেশনা হিসেবে দিয়েছি। কারণ এই নির্দেশনায় যা বলা হয়েছিল, তা ২৯ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশনা বা গাইডলাইনের বাংলা রূপান্তর মাত্র। তবে সাধারণ মানুষের বোধগম্য করার জন্য, মানুষকে সহজে বোঝানোর জন্য এবং ওই প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের মধ্যে মাস্ক কেনা নিয়ে যে হুড়োহুড়ি চলছিল কিংবা যে প্যানিক বা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল সেই বিষয় মাথায় রেখে, অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলোকে গুছিয়ে উপস্থাপন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তখনকার গাইডলাইনের স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল যে, যাদের রোগ নেই অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একজন সুস্থ মানুষ যে বাইরে যায় না, ঘরে বসে থাকে তার কি মাস্ক পরে সারা দিন বসে থাকার দরকার আছে? আবার যাদের পরিবার-পরিজন কারও করোনা টেস্ট পজিটিভ না, সবাই ঘরে বসে আছেন, বাইরে যান না, পরিবারের লোকজনও কোনো রকম উপসর্গ নেই, তারাও কি সবাই সারক্ষণ বাড়িতে মাস্ক পরে থাকবেন? গাইডলাইনের কথা বাদ দেন, আপনার আমার সাধারণ জ্ঞানে কী মনে হয়? নিশ্চয় তার লাগার কথা না! এ জন্যই বলা হয়েছে, সবার সব সময় অর্থাৎ ঢালাও মাস্কের দরকার হবে না!

পরবর্তীতে ৬ এপ্রিল ২০২০, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশিকায় কিছু পরিবর্তন কিংবা আপডেট আনে। এই দ্বিতীয় এবং বর্তমান গাইডলাইনেও কিন্তু সুস্থ ব্যক্তির মাস্ক ব্যবহার করার কথা সরাসরি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেনি। বরং সুস্থ ব্যক্তির মাস্ক পরার বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট দেশ বা স্থানের বিভিন্ন বিষয় (যেমন : জনসংখ্যার ঘনত্ব, কত দ্রুততার সঙ্গে ভাইরাস ছড়াচ্ছে, মৃত্যুহার, মৃত্যু-ঝুঁকি, সামাজিক দূরত্ব কতটা মানা যাচ্ছে, কত মানুষ ঘরে থাকছেন, স্থানীয়ভাবে মাস্কের সরবরাহ, দাম ইত্যাদিসহ অনেকগুলো বিষয়) বিবেচনা করে স্থানীয় সংস্থা বা ওই দেশকে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতেই পারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে সুস্থ ব্যক্তির মাস্ক ব্যবহারের ব্যাপারে আগে সরাসরি না করেছিল কিংবা বর্তমানে সরাসরি কিছু বলেনি, তাহলে কেন সবার মাস্ক পরা প্রয়োজন? এই ক্ষেত্রে আমাদের যে বিষয়টি আমলে নিতে হয়েছে বা নিতে হবে, সেটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আরেকটি সংস্থা, সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন)। সিডিসির মতে, মাস্ক সবারই পরা উচিত। তার কারণ- প্রথমত, কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যে সব রোগীর রোগের কোনো লক্ষণ নেই অর্থাৎ লক্ষণবিহীন রোগীরাও কিন্তু রোগ ছড়াতে পারে। দ্বিতীয়ত, রোগীর সুপ্ত অবস্থার (ভাইরাস সংক্রমণ করার পর থেকে রোগের লক্ষণ প্রকাশ হওয়ার মধ্যবর্তী সময়) শেষের কয়েক দিনেও রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থাৎ লক্ষণবিহীন রোগী এবং রোগ প্রকাশের ঠিক পূর্বাবস্থায় থাকা রোগী- যাদের উভয়কে আপাতদৃষ্টিতে সুস্থই মনে হয়, তারা কিন্তু রোগ ছড়াতে পারে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে আমলে নিয়ে সিডিসি মাস্ক পরার জন্য সবাইকে পরামর্শ দিয়েছে। তবে মাস্ক পরতে বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মাস্ক আপনাকে কতটা প্রটেকশন দেবে সে ব্যাপারে প্রশ্ন থাকলেও, মাস্ক পরিহিত ব্যক্তির মুখ থেকে হাঁচি, কাশি বা থুথুর মাধ্যমে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা কমবে। তাই নিজের প্রতিরক্ষার চেয়ে অন্যকে রক্ষা করার জন্য অর্থাৎ রোগ ছড়ানো কমাতে বর্তমান সময়ে সবার মাস্ক ব্যবহার করা জরুরি। এখানে আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, সিডিসি সাধারণ মানুষের জন্য সার্জিক্যাল বা যেসব মাস্ক স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা পরেন, সে সব মাস্ক ব্যবহারের কথা বলেনি। বরং তারা সাধারণ কাপড়ে তৈরির মাস্কের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। এই মাস্ক ব্যবহারের পর নিয়মিত যদি নিজে সাবান পানিতে বা ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে নেওয়া যায়, তাহলে তাদের বক্তব্য অনুসারে এই মাস্ক দিয়ে রোগের বিস্তার সহজে রোধ করা সম্ভব।

উপরন্তু জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্যমতে, কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাস এখন মানুষের লালা থেকেও ছড়াতে পারে। আমাদের কথা বলার সময় অনেকেরই মুখ থেকে থুথু বা লালা নিঃসৃত হয়, আবার হাঁচি-কাশির সঙ্গেও এই রোগ ছড়ায়। তাই এই মাস্ক কাপড়ের তৈরি হলেও রোগ ছড়ানোর প্রতিরোধের বেশ ভালো কার্যকরী হতে পারে। তাই শুরুতে আমরা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সবার মাস্ক পরার পরিবর্তে শুধু রোগীদের কিংবা যারা স্বাস্থ্যসেবায় জড়িত বা যারা রোগীদের সংস্পর্শে আসছেন, তাদের মাস্ক ব্যবহার করার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলাম। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারা পরিবর্তিত হয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই সব মানুষের জন্যই যে মাস্ক দরকারি, সে ব্যাপারে প্রিন্ট মিডিয়া ও গণমাধ্যমে বারবার বলা হচ্ছে।

সুতরাং পরিশেষে, আমাদের মতো অধিক জনসংখ্যার দেশ, যেখানে আমরা সামাজিক দূরত্ব এবং লকডাউন নিজেরা নানা কারণে পুরোপুরি মেনে চলতে পারছি না, নিয়মিত হারে যেখানে নতুন রোগী পাওয়া যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ মানুষের সবার মাস্ক পরা উচিত। অন্তত কাপড়ের মাস্ক সবাই ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে জনসমাগম হওয়া স্থানগুলো যেমন হাটবাজার, রাস্তাঘাট, বাস-ট্রেনসহ অন্যান্য গণ-পরিবহনে কোনোভাবেই মাস্ক ছাড়া যাওয়া যাবে না। অধিকন্তু বয়স্ক মানুষ এবং যাদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ (যেমন : হার্ট, কিডনি ও লিভারের সমস্যা, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, ক্যান্সার) আছে, যারা নিয়মিত ডায়ালাইসিস করেন বা কেমো থেরাপি নেন, তাদের সবাইকে মাস্ক পরতে ভুললে কোনোভাবেই চলবে না। আবার মনে রাখতে হবে, শুধু মাস্ক পরলে হবে না, এই মাস্ক ব্যবহারের কিছু বিধি রয়েছে সেগুলো মেনে চলতে হবে। সঙ্গে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যেমন সাবান-পানি দিয়ে বারবার হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং যথাসম্ভব ঘরে থাকার বিষয়গুলো আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, জনগণের নাগরিক দায়িত্ব ও সচেতনতাই বড় রক্ষাকবচ। সর্বোপরি এসব ব্যাপারে বিভ্রান্তি তৈরির কোনো সুযোগ নেই। তাই সবার কাছে আমার আহ্বান, আসুন আমরা যেন কোনো কারণে কিংবা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে অথবা বুঝে-না বুঝে মাস্ক ব্যবহারসহ করোনা সম্পর্কিত অন্যান্য তথ্য নিয়ে অযথা বিভ্রান্তি তৈরি না করি। বরং সেই সময়টুকু ইতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়ে, মানুষের মধ্যে সঠিক তথ্যের বিস্তার করে, মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের কল্যাণে সবাই একসঙ্গে করোনা প্রতিরোধে কাজ করি।

                লেখক : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।

সর্বশেষ খবর