সোমবার, ১৮ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

পরিপূর্ণ মানুষের বিদায়

নাহার মনিকা

আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কুমিল্লা বার্ডে ১৯৯২ সালে। স্যার নিরিবিলিতে লেখার কাজ নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি ছাত্রী মানুষ, দোভাষীর কাজ করছি  সুইস ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশনের কন্সালট্যান্ট অ্যানম্যারি হলেস্টইনের সঙ্গে। দলে আমরা দুজন নারী আর বাকিরা সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং এনজিও কর্মকর্তা। দিনের বেলা বিভিন্ন প্রজেক্ট দেখার পর বিকালে বার্ডের ডাইনিং হলে এককোণে বড় টেবিল দখল করে গ্লোবাল প্ল্যানিং নামের একটা বৈঠক শুরু করেন তারা। আমার তখন কিছু করার থাকে না।

ডাইনিং হলের আরেক কোণে একটা টেবিলে একা বসে খাওয়া এবং পড়ালেখা করেন আনিসুজ্জামান স্যার। আমাদের দলের সচিবরা স্যারকে দেখে ফিস ফিস করেন-‘ঐ যে প্রফেসর আনিসুজ্জামান’।

সেদিন আমি হাতে জয় গোস্বামীর ‘আলেয়া হৃদ’ নিয়ে পায়চারি করছি, স্যার ডেকে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন, কোন বিভাগে পড়ি, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের দু-একজনের খোঁজ নিলেন এবং দিলেন। 

তারপর যে কদিন সেখানে ছিলাম, প্রতিদিন বিকালে ফিরে চা খেয়ে স্যারের সঙ্গে গল্প হতো, অলিখিত গুরু-শিষ্যের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। স্যার কত কী নিয়ে যে গল্প বলেন- সাহিত্য, রাজনীতি, ইতিহাস, ধর্ম কিছুই বাদ যায় না। আমি বুঝে, না বুঝে প্রশ্ন করলে সহজ করে বুঝিয়ে দেন। তখন কবিতা লিখি। স্যার আমার কবিতা শুনে উৎসাহ দিলেন। এখন ভাবলে অবাক হই, ওই কমবয়েসী আমার কথাবার্তায় স্যার আমাকে একটিবারের জন্যও শুধরে দেননি, বা থামিয়ে দেননি। বরং হাসিমুখে শুনেছেন। টিউশনির বাইরে ছাত্রছাত্রীদের তখন খুব বেশি অন্য কাজ করার  সুযোগ ছিল না। আমাকে দোভাষীর কাজ করতে দেখে  প্রসংশা করেছেন। তার কথায়, আচরণে মোটেও ফুটে ওঠেনি যে তিনি জাতীয় ইতিহাসের চড়াই-উতরাইগুলো কত কাছ থেকে দেখেছেন, কত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী এবং দিকনির্দেশনার একজন সক্রিয় অংশীদার, অথচ সে কথাগুলোই বলতেন। নিজের সক্রিয় উপস্থিতিকে জানান না দিয়ে নির্মেদ ভঙ্গিতে যে অভিজ্ঞান বিতরণ করা যায়, সেটি যারা তাকে শুনেছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন।

কুমিল্লা থেকে ঢাকা ফেরার দিন স্যার নিজে থেকে তার বাসার ফোন নম্বর দিলেন, ফিরে গিয়ে যেন অবশ্যই যোগাযোগ করি। আর  একটা বই উপহার দিলেন। তপন রায় চৌধুরীর  ‘রোমন্থন অথবা ভীমরতি প্রাপ্তর পরচরিত চর্চা’। সেই থেকে আমি আরেকজন অসাধারণ লেখকের সঙ্গে পরিচিত হলাম, যার রসবোধ এবং ভাবগাম্ভীর্য দিয়ে মুগ্ধ আছি এখন পর্যন্ত। বেশ কিছুদিন পরে একদিন ফোন করলাম স্যারের বাসায়। স্যারের স্ত্রী ফোন ধরেই বললেন-‘তুমি এতদিন ফোন করনি কেন?’ স্যার কুমিল্লা থেকে ফিরে ভাবীকে আমার কথা বলেছেন। স্যারের বাসায় গেছি, তাদের দুজনের সঙ্গে কতগুলো মধুর আড্ডার স্মৃতি জমেছে। বিশ্ববিদ্যালয় হলে থাকি বলে ভাবী এবং স্যার দুজনেই খুব জোর করে খাওয়াতেন আমাকে।  

তারপর আমার চাকরি, বিদেশবাসের সূত্রে স্যারের সঙ্গে যোগাযোগহীনতায় পড়ে গেলাম।

এর প্রায় বছর বিশেক পরে স্যার মন্ট্রিয়ালে কনফারেন্সে এসেছেন। তাকে নিয়ে বাঙালি কমিউনিটি সংবর্ধনার আয়োজন করেছে, সে অনুষ্ঠানে তো যাবই, কিন্তু  দেখা হলে আমাকে কি চিনবেন? কত ব্যস্ত এবং বিরাট মানুষ! কিন্তু আমাকে অত্যাশ্চর্য করে দিয়ে স্যার এক পলক দেখেই আমাকে নাম ধাম সমেত চিনতে পারলেন। কুমিল্লা বার্ডের কথা বললেন। আমার তখন কালি ও কলমে দুটি গল্প ছাপা হয়েছে। স্যার এই পত্রিকার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা। সে গল্প দুটি তার চোখে পড়েছে! আমি তখন যুগপৎ তাজ্জব এবং লজ্জিত হচ্ছি। তীক্ষè স্মৃতিশক্তি তার!

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে কজন প্রিয় শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছি, আনিসুজ্জামান স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক না হয়েও তাদের অন্যতম একজন। স্যার কী লিখেছেন, তার গবেষণা, রাজনৈতিক ঘরানা, কেমন করে ভাষণ দিতেন এসব নিয়ে বলার কিছু নেই, সবাই জানেন। যতটা আধুনিক ও স্মার্ট হলে এক একজন করে মানুষকে প্রভাবিত করে একটা জাতির মানস উদ্দীপিত করা যায়, সেই আধুনিকতা তার ছিল।

ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের কারণে যেসব মানুষ দেশচ্যুত হয়, তাদের বেশিরভাগের পক্ষে ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে ওঠা সহজ থাকে না। কেউ কেউ সে পরিচয় ছাপিয়ে বড় মানুষ হয়ে ওঠেন তাদের কাজে, কথায়।  তাদেরই কেউ কেউ বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে হয়ে ওঠেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়। আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে এসে হয়ে ওঠেন আনিসুজ্জামান, হাসান আজিজুল হক।

আনিসুজ্জামান স্যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, বাঙালি জাতিসত্তার আধুনিক আকাক্সক্ষার সঙ্গে একাত্ম ছিলেন। মানুষের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষের মানুষ হিসেবে মানবিকতাকেই তার কাজে ও কথায় সবার ওপরে রেখেছেন। সত্যিকারের বড় মাপের মানুষেরা বোধহয় এমনি হয়। অগুনতি মানুষের ভিতরে আলো জ্বালাতে জ্বালাতে পুরো জাতির বাতিঘর হয়ে ওঠেন।

আমি দেশের বাইরে থাকা লোক, তাকে দেখিনি, আর দেখা পাওয়ার সুযোগ নেই। দেবেশ রায়ের লেখাগুলো আছে, বরিশালের যোগেন মন্ডল আমার বুকশেলফে জ্বল জ্বল করছে। সাইকেলে চেপে জোগেন ম-ল ক্ষেতের আল বেয়ে চলে যাচ্ছে কোথাও, অথবা ফিরে আসছে। তার লেখা থাকবে, পড়তে পাব, এটাই প্রাপ্তি।

স্যার আনিসুজ্জামান ও দেবেশ রায় দুজনেই পূর্ণ জীবন যাপন করে গেছেন। তাদের পক্ষে যতটা সম্ভব মানুষকে দিয়ে গেছেন। তাদের মৃত্যু মহান, সন্দেহ নেই। অনুশোচনা একটাই, সময়টা বড় অসময়, করোনার ক্রান্তিকালে তারা চলে গেলেন। চাইলেও তাদের প্রিয় ফুল নিয়ে শেষ বিদায়ে উপস্থিত হওয়া সম্ভব না। তারা ছিলেন, তাদের কাজ আছে। আমাদের মত অজস্র মানুষ ঘিরে তাদের অজুত কোটি স্মৃতি আছে, যা তাদের বাঁচিয়ে রাখবে।

লেখক : কানাডা প্রবাসী কবি ও গল্পকার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর