মঙ্গলবার, ১৯ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় শেক্সপিয়র, নিউটন ও অন্যান্য মহান ব্যক্তিরা

সাইফুর রহমান

করোনায় শেক্সপিয়র, নিউটন ও অন্যান্য মহান ব্যক্তিরা

এখন থেকে ৩৫৬ বছর পূর্বের কথা। ১৬৬৪ সালে ক্রিসমাস ঈভের প্রাক্কালে লন্ডন শহরে গুডওমেন ফিলিপ্স নামে এক ইংরেজ মহিলা তার নিজ গৃহে মৃত্যুবরণ করলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেল সেই ইংরেজ মহিলা আক্রান্ত হয়েছিলেন প্লেগে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটি সিলগালা করে দেওয়া হলো। প্লেগে আক্রান্ত মৃতের সদর দরজায় বড় বড় হরফে লিখে দেওয়া হলো ‘মহান ঈশ্বর আমাদের ওপর দয়া করুন। গুডওমেন ফিলিপ্স নামের এই মহিলাটি ব্যুবুনিক প্লেগে মারা গেছেন।’ ১৬৬৪ সালে প্লেগ রোগটির শুরু এভাবেই। পরবর্তী মাসগুলোতে মাত্র কিছু লোকেরই প্রাণহানি হলো প্লেগে। কিন্তু ১৬৬৫ সালের এপ্রিলের দিকে রোগটি মহামারী আকার ধারণ করল। গ্রীষ্মঋতু পুরুদস্তুর শুরু হতে না হতেই মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল দুই সহস্রাধিক এবং জুলাই নাগাদ মৃত্যুর এই মিছিল সংখ্যায় দাঁড়াল ৭ হাজার ৪৯৬। রোগটি শুরু হওয়ার পর থেকে ১৮ মাস পরে শুধুমাত্র লন্ডন শহরেই মৃতের সংখ্যা অবিশ্বাস রকম বেড়ে দাঁড়াল এক লাখে যা সংখ্যায় লন্ডন শহরের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ।

মহামারীটি শুষ্ক অরণ্যে দাবানলের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল লন্ডন শহরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে। অনিবার্যভাবে দাবানলের সেই ঢেউ এসে পড়ল অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ ও অন্য শহরগুলোতেও। ২৩ বছরের তারুণ্যে পরিপূর্ণ টকবগে যুবক আইজ্যাক নিউটন তখন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন গণিত নিয়ে। আচানক একদিন তার শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ঈষৎ বেশি হওয়ায় অবিলম্বে তিনি নির্দেশিত হলেন ক্যামব্রিজ ছেড়ে যেতে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আদেশের সঙ্গে সঙ্গে নিউটন চটজলদি সেখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেলেন তার পরিবারের মালিকানাধীন খামারবাড়ি লিঙ্কনশায়ারে। সেখানে নিউটনের বিস্তর অবসর কিন্তু অবসরে অযথা সময় নষ্ট করা কিংবা সময়ের স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মতো মানুষ মোটেও ছিলেন না তিনি। বিশাল বাড়িটির দক্ষিণমুখী জানালার গরাদের ফাঁক গলে সূর্যের আলো এসে খেলা করে ঘরের মেঝেতে। দীর্ঘ সময় ধরে একদৃষ্টিতে নিউটন তাকিয়ে থাকেন সেই আলোর দিকে। মনে মনে ভাবেন বাধা পেলে আলো কি বেঁকে যায়? কিংবা আলোর প্রকৃত রং-টাই বা কী?

মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে আস্ত একটি তত্ত্বের ভ্রুণ, নিউটনের মস্তিষ্কে কিন্তু সৃষ্টি হয়েছিল এই কোয়াটেন্টাইনে বসেই। ঠিক যেদিন গাছ থেকে আপেলটি মাটিতে পড়ল ঠিক সেদিনই নিউটনের চিন্তার গর্ভে মাধ্যাকর্ষণ নামক বিখ্যাত তত্ত্বটির বীজ অঙ্কুরোদগম হয়েছিল। সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারি এর কয়েক বছর পর নিউটন তাঁর এক বন্ধুকে যে চিঠিটা লিখেন সেই চিঠিটা থেকে। নিউটন তার বন্ধুকে লিখেন-কোয়ারেন্টাইনের দিনগুলোতে আমার কাছে অনেক সময় ছিল। তাই যেসব প্রশ্নের উত্তর তখনো পর্যন্ত পাইনি সেগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করি। মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে যে চিন্তাভাবনাগুলো মাথায় খেলা করছিল সেগুলোই পুনরায় ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম।

আইজ্যাক নিউটন/১৬৬৯

মজার বিষয় হচ্ছে মাধ্যাকর্ষণ বিষয়ে পরিপূর্ণ তত্ত্বটি নিউটন কিন্তু দিয়েছিলেন আরও ২০ বছর পর।

এ তো গেল আইজ্যাক নিউটনের কথা। শ্রুতকীর্ত ইংরেজ লেখক উইলিয়াম শেক্সপিয়রও কোয়ারেন্টাইনের অবসরে লিখেছেন অনেক কালজয়ী নাটক ও কবিতা। শেক্সপিয়রকে সম্ভবত সমগ্র সাহিত্যকর্মের তিন ভাগের একভাগ শুধু কোয়ারেন্টাইনে বসেই লিখতে হয়েছে। যদিও কিছুদিন আগে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’ শুধু ‘কিং লিয়ারের’ কথাই লিখেছে। পত্রিকাটি আমাদের জানাচ্ছে যে, শেক্সপিয়র কোয়ারেন্টাইনে বসে ‘কিং লিয়ার’ নাটকটি লিখেছিলেন। কিন্তু আমার ধারণা এক-তৃতীয়াংশ রচনা শেক্সপিয়রকে কোয়ারেন্টাইনে বসেই লিখতে হয়েছিল। আমার বক্তব্যের পিছনের কারণগুলো বলছি।

১৩০০ সালের পর থেকে মাঝে মাঝেই সে দেশের মানুষ প্লেগে আক্রান্ত হতো এবং এর ফলে বহু মানুষের মৃত্যু হতো। একরকম ভাবে বলা যায় শেক্সপিয়রের জন্মও হয়েছিল প্লেগ নামক এই দুর্দৈব মহামারীটির সময়ে। শেক্সপিয়রের জন্ম সম্ভবত ১৫৬৪ সালের ২৪ এপ্রিলের দু-এক দিন আগে। মনে করা হয়, তিনি ২২ কিংবা ২৩ এপ্রিল জন্মেছিলেন। কারণ ২৪ এপ্রিল যে তাকে স্ট্রাটফোর্টের একটি চার্চে ব্যাপটাইজ করা হয়েছিল সে প্রমাণ আছে। অন্যদিকে ১৫৬৩ সাল থেকে ১৫৬৫ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ মাত্র দুই বছরে ইংল্যান্ডজুড়ে ৮০ হাজার লোক শুধু প্লেগেই মারা গিয়েছিল। মৃত্যুবরণ করেছিলেন শেক্সপিয়রের অগুনতি আত্মীয়স্বজন। এডমন্ড নামে শেক্সপিয়রের ২৭ বছরের আপন সহোদর ও তিন সহোদরা, যথাক্রমে- জোয়ানা ও মার্গারেট-এ দুজন একেবারে শিশু অবস্থায় এবং অ্যান নামের সাত বছরের আরেকটি বোন মারা যায় প্লেগে। তবে শেক্সপিয়র বোধকরি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন তার নিজের পুত্র হ্যামনেট মারা যাওয়ার সময়। দুই কন্যা, এক পুত্র ও স্ত্রী অ্যান হিতওয়েকে নিয়ে শেক্সপিয়রের গোছানো সংসার। দুই কন্যা-সুজানা হল ও জুডিথ কুইনি, এক মাত্র পুত্র হ্যামনেট। ১৫৯৬ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে পুত্র হ্যামনেট মারা যায় প্লেগে। পরবর্তীকালে ‘হ্যামলেট’ নাটকটি শেক্সপিয়র তার পুত্র হ্যামনেটের নাম অনুসারেই যে রেখেছিলেন সেটা সহজেই অনুমেয়। প্লেগে যে শুধুমাত্র শেক্সপিয়রের আপন চার ভাই-বোন ও এক পুত্রই মৃত্যুবরণ করেছিলেন তা কিন্তু নয়। শেক্সপিয়র মারা যান ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল। ১৬১৭ সালের মে মাসে মারা যান তার ছয় মাসের এক নাতি, নাম শেক্সপিয়র কুইনি এবং আরও দুই নাতি যথাক্রমে ১৯ বছরের রিচার্ড কুইনি এবং ২০ বছরের থমাস কুইনি। উপরোক্ত মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেখে অনেকেই হয়তো চমকে উঠছেন!! ভাবছেন তাহলে শেক্সপিয়র বেঁচে গেলেন কীভাবে? চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস আমাদের জানাচ্ছে-হাঁড় কাঁপানো শীতের দেশের মানুষ হয়েও শিশুকাল থেকেই শেক্সপিয়র নাকি ছিলেন ভয়ানক রকম শীতকাতুরে। সেই জন্য সবসময় তিনি ফায়ার প্লেসের আশপাশে থাকতেন। আর রাতে ঘুমাতেনও সেই অগ্নিচুল্লির পাশে। সেজন্য ফ্লাইয়া নামক যে কীটগুলো প্লেগ ছড়ায় সেগুলো শেক্সপিয়রের ধারেকাছেও ভিড়তে পারেনি কখনো। উপরোক্ত হিসাব থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, যদি একটি পরিবারেই শুধু আটজন সদস্য মারা যায় প্লেগে তাহলে সে আমলে প্লেগ কতটা ভয়াবহ ছিল। ইতিহাস পর্যালোচনা করে সহজেই এটা অনুমান করা যায় যে, সে সময়কার ইংরেজ জনজীবন ছিল বেশ কিছুটা প্লেগময়। ছয় মাস থেকে কখনো কখনো দু-আড়াই বছর পর্যন্ত থাকতে হতো হোম কোয়ারেন্টাইনে। তবে শেক্সপিয়রের সাহিত্যকর্ম সৃষ্টির সময়টাতে প্লেগ সম্ভবত তিনবার বেশ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল সেটা-১৫৯৩, ১৬০৩ ও ১৬০৮ সালে। ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় এই সালগুলোতে লন্ডনের থিয়েটারগুলো সব বন্ধসহ লকডাউন করে দেওয়া হয়েছিল। ১৫৯২ সালের মাঝামাঝি প্লেগের কবলে পড়ে লন্ডনে প্রথম বারো মাসেই মারা যায় প্রায় এগারো হাজার লোক। এর ফলে ১৫৯৪-এ মে মাসে লন্ডনের থিয়েটারগুলোতে লাগাতার অভিনয় সম্ভব হয়নি। ১৫৯৩ সালে শেক্সপিয়র প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডনিস’, আর তার পরের বছর ‘দ্য রেপ অফ লুক্রিস’। এ দুটো লেখাই সম্ভবত শেক্সপিয়র গৃহে অন্তরীণ অবস্থায় লিখেছিলেন-প্রথমটা হালকা চালে বলা প্রেমকাহিনি, দ্বিতীয়টা চড়া সুরের নিষ্ঠুর গল্প। দুটো গল্পের সূত্রই শেক্সপিয়র ধার করেছিলেন প্রাতঃস্মরণীয় রোমান কবি ওভিদের (৪৩ খ্রিস্টপূর্ব-১৮ খ্রিস্টাব্দ) ‘মেটামর্ফোসেস’ থেকে। দুটো বই-ই উৎসর্গ করা হয়েছে বছর-কুড়ি বয়সের তরুণ আর্ল অফ সাউথহ্যাম্পটন হেনরি রোসলিকে। ‘ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডনিস’ এর আখ্যাপত্রে তাঁর নাম ছাপা হয়নি। স্ট্র্যাটফোর্ডের অধিবাসী রিচার্ড ফিল্ড লন্ডনে ছাপাখানা খুলেছিলেন। শেক্সপিয়রের প্রথম কয়েকটি বই ছাপা হয়েছিল রিচার্ড ফিল্ডের সহায়তায়।

শেক্সপিয়র সম্ভবত ‘ওথেলো’ নাটকটিও লিখেছিলেন গৃহবন্দী থাকাকালীন। কারণ ওথেলো প্রকাশিত হয় ১৬০৪ সালে। শেক্সপিয়রের শেষের দিককার একটি লেখা ‘চেম্বারলিন’ও সম্ভবত অনিচ্ছা নির্বাসনে বসেই লিখেছিলেন তিনি। প্লেগ নামক এই মহামারীর আতঙ্ক ও ভয় শেক্সপিয়রকে সম্ভবত সমস্ত জীবন ভীষণভাবে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। এ জন্যই বোধকরি প্লেগ নিয়ে তিনি কোনো সাহিত্য রচনা করার সাহস করেননি। তবে তিনি কৃতসিদ্ধ ইতালিয়ান লেখক বোক্কাচ্চ জিওভানি (১৩১৩-১৩৭৫) লিখিত ‘দি দেকামেরন’ পড়ে প্রাণিত হয়ে ‘চেম্বারলিন’, ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিশ’ এবং ‘অলওয়েল দ্যাট অ্যান্ডস্ ওয়েল’ নাটকগুলো লিখেছিলেন। বোক্কাচ্চ জিওভানির ‘দ্য দেকামেরন’ লেখাটিও মহামারী প্লেগকে কেন্দ্র করেই। ১৩৪৮ সালে ফ্লোরেন্স নগরীতে প্লেগ মহামারী আকারে দেখা দেয়। ‘দ্য দেকামেরনে’ মহামারী প্লেগ আক্রান্ত শহরের বাস্তব চিত্র এঁকেছেন বোক্কাচ্চ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে শুধুমাত্র শেক্সপিয়র কিংবা নিউটনই নয় কোয়ারেন্টাইন কিংবা এই অনিচ্ছা নির্বাসন কিছু সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে অনেকটা আশীর্বাদ বয়ে এনেছে তাঁদের জীবনে। যেমন ইংরেজ সাহিত্যের প্রথমদিককার লেখক জেফ্ররি চসার তার অবিস্মরণীয় লেখা ‘দ্য ক্যন্টারবারি  টেলস্’ও গৃহে অন্তরীণ অবস্থায় লিখেছেন। যদিও চসার সেই সময়টায় ভীষণভাবে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু কুষ্ঠ রোগ কিংবা প্লেগ কোনোটাই তাকে রুখতে পারেনি। আরেক প্রণম্য ইংরেজ লেখিকা মেরি শেলিও ভয়ানক শ্বাসকষ্ট ও শরীরে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্র লাগিয়ে লিখেছিলেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেস্টাইন’। অন্যদিকে খ্যাতিমান সমস্ত পৃথিবী পলিও রোগে আচ্ছন্ন ঠিক তখন ইংরেজ লেখিকা সিলভিয়া প্লাথ লিখেছিলেন ‘দ্য বেল জার’ ও লেখক উইলিয়াম কেনেডি লিখেছিলেন ‘আয়রনউইড’। এবার আইরিস লেখক জেমস্ জয়েসের কথা একটু বলি। আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনের ৭৫ শতাংশ লোক যখন সিফিলিসে আক্রান্ত ঠিক সেই সময়টায় ইংরেজি সাহিত্যের উচ্চমার্গীয় লেখক জেমস্ জয়েস নির্বিঘœচিত্তে বসে লিখেছিলেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ইউলিসিস’।

সিফিলিস প্রসঙ্গ যেহেতু এলোই সেহেতু শেক্সপিয়র সম্পর্কেও কিছু বলতে হয়। ২০১২ সালে আমেরিকার হার্বার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন জে রস নামে প্রসিদ্ধ এক চিকিৎসক একটি বই লেখেন, নাম-‘শেক্সপিয়র’স ট্রেমোর অ্যান্ড অরওয়েল’স ক্ফ। বাংলা করলে বইটির নামের মানে দাঁড়ায় ‘শেক্সপিয়রের আঁকাবাঁকা লেখা এবং অরওয়েলের কাশি’। রস নামের এই চিকিৎসক ভদ্রলোক শেক্সপিয়রের হাতের লেখা পরীক্ষা করে তাঁর বইটিতে লিখেছেন-শেক্সপিয়র নাকি সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কাঁপাকাঁপা হাতের আঁকাবাঁকা লেখাই নাকি এর যথেষ্ট প্রমাণ। ডক্টর রস আমাদের আরও জানাচ্ছেন শেক্সপিয়র যতটা না সিফিলিসে ভুগেছিলেন তার চেয়ে বেশি ভুগেছিলেন এর চিকিৎসাপত্র করতে গিয়ে। সত্যি সত্যি যদি শেক্সপিয়র সিফিলিসে ভুগে থাকেন তাহলে রস ঠিকই বলেছেন। কারণ সিফিলিস নামক ভয়াবহ রোগটি থেকে বাঁচতে সে যুগে মানুষ কী কী না করত। সিফিলিস নামের এই মহামারিটি দাপিয়ে বেড়িয়েছে প্রায় ছশ বছর। কে ভুগেননি সেই সময় এ রোগটিতে। ফ্রান্সের রাজা অষ্টম চার্লস, খ্রিস্টোফার কলম্বাস, হার্নেন কার্তেজ, লিও তয়েস্তয়, নিৎসে, বদলেয়ার, মোপাঁসা, জার্মান কবি হাইনরিক হাইনে, মুসোলিনী, হিটলার, লেনিন, বিখ্যাত ডাচ চিত্রকর র‌্যামব্রেন্ড। এ মুহূর্তে আমার এ নামগুলোই মনে পড়ছে। তবে খুঁজলে পাওয়া যাবে আরও কত কত নাম।

গী দ্য মোপাঁসা নাকি সিফিলিসের যন্ত্রণা নিয়েই লিখতেন। যখন মাথার যন্ত্রণা কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারতেন না তখন সে সময়কার প্রত্যক্ষ ফলপ্রদ ওষুধ হিসাবে কানের কাছে পাঁচটা জোঁক লাগিয়ে কলম নিয়ে বসতেন। মাঝে মাঝে মাথার যন্ত্রণায় চোখে কিছুই দেখতে পেতেন না। কিন্তু সিফিলিসের অল্প আক্রমণ নাকি লেখায় প্রেরণা দেয়। সিফিলিসের জীবাণু যখন ধীরে ধীরে মস্তিষ্কে উঠে আসে তখন জীবাণুর সুড়সুড়িতে মস্তিষ্ক নাকি উত্তেজিত হয়। কিছু সময়ের জন্য আশ্চর্য ক্ষমতা পায় কলম। যেমন পেয়েছিলেন হাইনরিথ হাইনে, বোদলেয়ার, নিৎসে। আর পঞ্চাশ বছর পর জন্মালে মোপাঁসার রোগ ধরা পড়ত। সেই সঙ্গে চিকিৎসাও নিশ্চয়ই হতো। তবে আমার ধারণা প্রকৃতি যতটা নেয় কোনো না কোনোভাবে আবার সে ক্ষতি পুষিয়ে দেয়। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মহামারীর মধ্যেই রচিত হয়েছিল বিখ্যাত কিছু সাহিত্য। ফ্রান্সে যখন ভয়াবহ কলেরা চলছে ঠিক তখন বরেণ্য ফরাসি লেখক আলবেয়ার ক্যামু লিখলেন তার সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’। স্পেনে ভয়াবহ ইনকুইজেশন কৃতকীর্ত লেখক মিগুয়েন সার্ভেন্টিস (১৫৪৭-১৬১৬) কে অনুপ্রাণিত করেছিল তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দনকিহতে’ লিখতে। আমেরিকায় ত্রিশের দশকে নিদারুণ মহামন্দার প্রেক্ষাপটে আমরা পেয়েছিলাম দুটো বিখ্যাত উপন্যাস। প্রথমটি জন স্টাইনবেকের ‘দ্য গ্রেপস অব র‌্যাথ’ আর দ্বিতীয়টি স্কট ফিটজেরান্ডের ‘দ্য গ্রেট গ্যটসবি’।

সেসব সম্মানিত পাঠক-পাঠিকাবৃন্দ কষ্টসহিষ্ণু হয়ে কিছুটা সময় নিয়ে এ লেখাটি পাঠ করলেন তাদেরকে মজার ও তথ্যসমৃদ্ধ একটি ঘটনা বলে লিখাটা শেষ করব। আমার ধারণা বিষয়টি অবশ্যই আপনাদের বিবিধ চিন্তার খোরাক জোগাবে। ‘হেনরি দি এইটথ্’ বোধহয় শেক্সপিয়রের শেষ নাটক। এই নাটকের যখন অভিনয় চলছিল তখন হঠাৎ আগুন লেগে গ্লোব থিয়েটার ভস্মীভূত হয়ে যায়। এটা ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দের কথা। এরপর থেকে শেক্সপিয়র অধিকাংশ সময় স্ট্র্যাটফোর্ডেই কাটাতেন। এপ্রিল মাসে সে সময়ের সুপ্রসিদ্ধ নাট্যকার বেন জনসন ও কবি মাইকেল ড্রেটন শেক্সপিয়রের অতিথি হয়েছিলেন স্ট্র্যাটফোর্ডে। রাতের ভোজ বাড়িতে শেষ করে পানভোজনের জন্য শেক্সপিয়র বন্ধুদের নিয়ে হানা দিয়েছিলেন কিছু দূরের এক শুড়িখানায়। পুরোনো দিনের গল্প করতে করতে তাঁদের ফিরতে রাত হয়েছিল। প্রচ-  ঠা-া লেগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন শেক্সপিয়র। সম্ভবত আক্রান্ত হয়েছিলেন নিউমোনিয়ায়। মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। শেক্সপিয়রের জন্মদিন ও মৃত্যুদিন বোধহয় একই। ২৩ এপ্রিল, ১৬১৬ সালে তিনি পরলোকগমন করেন। অনেকের মতে বাহান্ন বছর পূর্বে ঠিক ২৩ এপ্রিলই তাঁর জন্ম হয়েছিল। ৩১ মার্চ মঙ্গলবার বাংলাদেশের যমুনা টেলিভিশন ডক্টর রাবার্ট প্যারি নামে একজন আমেরিকান চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার প্রচার করে। ডক্টর প্যারি আমাদের জানাচ্ছেন যে, করোনা নামের এই ভাইরাসটির অস্তিত্ব নাকি এই পৃথিবীতে বহুকাল আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। মৃদু উপস্থিতির কারণে ভাইরাসটি কিছুটা ভিন্ন রূপধরে ছিল এতদিন। অল্প স্বল্প উপসর্গের কারণে এটার উপস্থিতি ছিল এতদিন অজানা। সময়ের সঙ্গে ভাইরাসটি এতদিন খাপ খাওয়াতে পারেনি মানবদেহে। এটি বাদুড়সহ অন্যান্য প্রাণীর দেহে বেঁচে ছিল দীর্ঘসময় ধরে। কিন্তু বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে কাবু করার পর্যাপ্ত শক্তি অর্জন করেছে বর্তমানের এই করোনা।

ডক্টর রবার্ট প্যারির ধারণা যদি সত্যি হয় অর্থাৎ করোনার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে যদি বহুকাল ধরে চলমান থাকে তাহলে শেক্সপিয়রও কি আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনায়? হলেও হতে পারে। উড়িয়ে দেওয়া যায় না কিছুই। কত অদ্ভুত ঘটনাই তো ঘটে এই পৃথিবীতে। কী বলেন আপনারা?

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

[email protected]

সর্বশেষ খবর