শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৯ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

ধনিক শ্রেণির ভূমিকা থাকা চাই

মোশাররফ হোসেন মুসা

ধনিক শ্রেণির ভূমিকা থাকা চাই

সামন্ত যুগে দেখা গেছে, কোনো কোনো জমিদার প্রজাদের কল্যাণে নিজ উদ্যোগে বড় বড় দিঘি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে দিতেন। তাদের এ উদার নৈতিক কর্মকা- দীর্ঘকাল আগে থেকেই চালু ছিল। কিন্তু সামন্ত শ্রেণির লোকেরা পরবর্তীতে তাদের পুঁজি শিল্পে বিনিয়োগ না করায় নিয়মতান্ত্রিক পথে এদেশে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা পায়নি। স্বাধীনতার পর নব্য ধনিক শ্রেণি গড়ে উঠে বটে; কিন্তু যথাযথ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালার অভাবে তাদের অর্থ জাতীয় পুঁজি হিসেবে বিকাশ লাভে ব্যর্থ হয়। অথচ সবার অংশগ্রহণ ছাড়া, বিশেষ করে ধনিক শ্রেণির অংশগ্রহণ ছাড়া একটি রাষ্ট্র কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠে না। বর্তমান মহামারীর সময়ে সবাই তাদের কাছে উদারনৈতিক পদক্ষেপ কামনা করে। বর্তমান ক্রান্তিকালে কিছু লোককে যেমনি সমাজকল্যাণমূলক কাজে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে, তেমনি কিছু অসাধু ব্যক্তিকে আর্থিক লাভালাভের স্বার্থে অমানবিক কাজ করতেও দেখা গেছে (যেমন জেএমআই নামক একটি কোম্পানি কর্তৃক নকল মাস্ক সরবরাহের ঘটনাটি আলোচিত হয়েছে)। তবে কয়েকজন শিল্পপতি রাষ্ট্রের কল্যাণে বিভিন্ন ফাউন্ডেশন গঠন করে সরকারকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপের উদ্যোগটি ব্যতিক্রম। সামাজিক কাজে তাদের কয়েকটি সংগঠন রয়েছে, যেমন- ১. বসুন্ধরা সামাজিক ফাউন্ডেশন ২. বসুন্ধরা টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (বিবিআই); ৩. বসুন্ধরা আদ-দ্বীন হাসপাতাল ও ৪. বসুন্ধরা চক্ষু হাসপাতাল। ইউরোপিয়ান দেশসমূহে রেনেসাঁস-পরবর্তী সময়ে গির্জাগুলোকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করা হয়। সেখানে গির্জা শুধু প্রার্থনার জায়গা নয়, তারা বিভিন্ন সেবামূলক কাজের মাধ্যমে ঈশ্বরপ্রাপ্তির নীতিকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে সবার প্রশংসা পাচ্ছেন। গির্জাগুলো ধনিক শ্রেণির সহযোগিতা ছাড়াও সরকার ও জনগণের সহযোগিতা পেয়ে থাকে। এবার করোনাকালে গির্জাগুলো গৃহহীনদের আশ্রয় ও খাদ্য দিয়েছে। এদেশের মসজিদগুলোর সেরকম সমাজকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করার সামর্র্থ্য গড়ে ওঠেনি। উন্নত বিশ্বের ধনিক শ্রেণির লোকেরা বহু বছর আগে থেকেই সরকারকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করে থাকে। তারা বিভিন্ন ফাউন্ডেশন গঠন করে সততার সঙ্গে শিক্ষা, চিকিৎসা, গবেষণার কাজে অর্থ ব্যয় করে যাচ্ছেন (যেমন- মিলিন্ডা-গেটস ফাউন্ডেশন, ফোর্ড ফাউন্ডেশন, ক্লিনটন ফাউন্ডেশন, বাফেট ফাউন্ডেশন, চার্লস ওয়ালেস ট্রাস্ট ইত্যাদি)। যতদূর জানা যায়, ভাষাসৈনিক গাজীউল হক ও নিউইয়র্ক প্রবাসী স্থানীয় সরকার গবেষক আবু তালেবের পরামর্শে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এস এম কিবরিয়া ফাউন্ডেশন খোলার অনুমতি দেন। ফাউন্ডেশন খোলা মানে শিল্পপতিরা তাদের লভ্যাংশের একটি অংশ সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করবেন। সরকার সেই লভ্যাংশের ওপর কোনো ট্যাক্স ধার্য করবে না। তারা সততার সঙ্গে সমাজের কল্যাণে টাকা ব্যয় করেন, তা নিশ্চয়তা সহকারে বলা যায় না। তবে ‘বসুন্ধরা গ্রুপ’ কভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে তাদের ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) ২ হাজার ১৩ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বসুন্ধরা গ্রুপ ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে, করোনা বিপর্যয় শেষ না হওয়া পর্যন্ত এবং সরকারের যতদিন ব্যবহারের প্রয়োজন হবে, ততদিন ব্যবহার করতে পারবে। তাছাড়া তারা পুলিশদের ইফতারি প্যাকেট এবং র‌্যাব, আনসার, বিজিবিকে মাস্ক ও পিপিই সরবরাহ করছে। আরেকটি শীর্ষ স্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ‘মিনিস্টার হাইটেক পার্ক ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড’ মাস্ক, জীবাণুনাশক যন্ত্র ও ভেন্টিলেটর উৎপাদন শুরু করেছে। তারা এগুলো  সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করবে। ওয়ালটন শিল্পপ্রতিষ্ঠানও একইভাবে ভেন্টিলেটর উৎপাদন শুরু করেছে। চট্টগ্রামের খান ফাউন্ডেশন (এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠান) ২০১৫ সালে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টিনন্দন আইন অনুষদ বিভাগ নির্মাণ করে দিয়েছে। তাছাড়া এ বছর চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েটে) পাঁচতলা বিশিষ্ট ছাত্রীহল নির্মাণ করে ছাত্রীদের দীর্ঘদিনের আবাসনের সমস্যাটি দূর করে দিয়েছে। একইভাবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন, ফারাজ আইয়াজ ফাউন্ডেশন, কুমুদিনী ট্রাস্ট, সুফি মিজান ফাউন্ডেশন, অমৃত লাল দে, আহছানিয়া মিশন, অনিরুদ্ধ বড়–য়া ফাউন্ডেশনসহ বহু সেবামূলক প্রতিষ্ঠান শিক্ষা, চিকিৎসা, শিল্প-সংগীতের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের দেশের করপোরেশনগুলোর ভোক্তা এ দেশেরই জনগণ। তাদের ব্যবসার সমৃদ্ধি ও মুনাফার পিছনে জনগণের অবদান রয়েছে। সুতরাং দেশের যে কোনো সংকটকালে কোম্পানিগুলো জনগণের কল্যাণে হাত বাড়িয়ে দিবে সেটাই কাম্য। সাম্প্রতিক সময়ে বসুন্ধরা গ্রুপসহ কয়েকটি কোম্পানির পরিচালক তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্বই পালন করেছেন, যা জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে গঠনমূলক ও কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। যদি শিল্পপতিরা এরকম উদারনৈতিক কর্মকা- চলমান রাখেন এবং সরকারও সুশাসনের ব্যবস্থা করেন, তাহলে সবাই এ দেশকে ‘নিজের দেশ’ এবং পরস্পরকে আত্মীয় মনে করে বসবাস করবে- তা আশা করা অতিরিক্ত           হবে না।

 

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।

ই-মেইল - [email protected]

সর্বশেষ খবর