বুধবার, ২০ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

রাজনৈতিক হীনমন্যতার অবসান চাই

খায়রুল কবীর খোকন

রাজনৈতিক হীনমন্যতার অবসান চাই

চীনের হুবেই প্রদেশের উহান নগরী থেকে ডিসেম্বরের (মতান্তরে অক্টোবরে) একেবারে শেষ প্রান্তে নভেল করোনাভাইরাস যা এখন ‘কভিড-১৯’ বিশ্বের ২১২টি বা তারও বেশি দেশকে মানে নর্থ পোল-সাউথ পোল প্রতি বর্গইঞ্চি ভূমি সন্ত্রাসের ভূমিতে, অবিরাম অশান্তির ভূমিতে পরিণত করে ছেড়েছে। বস্তুত, মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ রকম বেদনার দিনকাল মানুষ আর কখনো দেখেছে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিশ^ আজ কাঁপছে কভিড-১৯ সন্ত্রাসের হুমকিতে।

তা চীন যদি এই কভিড-১৯ লড়তে গিয়ে বিশ্বটাকে রক্ষার চেষ্টা করত তাহলে হয়তো এ দশা হতে পারত না বাকি বিশ্বের। চীন সময়মতো সমগ্র বিশ্বকে উহান ভাইরাস পরিস্থিতি জানায়নি, এবং তার নিজের যা দায়দায়িত্ব ছিল তা পালন করেনি। সে পারত শুধু হুবেই প্রদেশের মধ্যে এই কভিড-১৯ ভাইরাসটিকে আটকে দিতে। যাতে বিশ্বের অন্য কোনো দেশের নাগরিকের দেহে এ ভাইরাসটি সংক্রমণের মাধ্যমে ওভারসিজ ফ্লাই করতে না পারে। সে ব্যবস্থা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করার সুযোগ থাকলেও তা হয়নি। কিন্তু বেকুবপনা হোক আর মতলববাজির জন্যই হোক, চীন ভাইরাসটির সংক্রমণ নিয়ে নিদারুণ অবহেলা করেছে আর তার পরিণতি হচ্ছে বিশ্ব মানবসভ্যতা এখন ধ্বংসের মুখোমুখি।

এদিকে বাংলাদেশে এই কভিড-১৯ ভাইরাস এসেছে ইতালির প্রবাসী বাংলাদেশির শরীরে সংক্রমণের মাধ্যমে। ইতালি-প্রত্যাগত প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে (অন্তত ১৪ দিন প্লাস ১৪ দিন) রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় সারা দেশের মানুষকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। সরকার শক্ত অবস্থান নিলে তখন ওইসব ইতালি-প্রত্যাগত বাংলাদেশি নাগরিককে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা সম্ভব হতো। এর ফলে কভিড-সংক্রমণ একেবারেই সীমাবদ্ধ রাখার উদ্যোগ সফল হতে পারত। অবশ্য করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীর দেশগুলো থেকে আসা সব বাংলাদেশি নাগরিককে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা কঠিন হলেও অসম্ভব কাজ ছিল না, কিন্তু সরকারের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ধরনের তৎপরতায় সবকিছু ভেস্তে যায়। সারা দেশে বিদেশ-প্রত্যাগত অসংখ্য বাংলাদেশি ভাইরাস সংক্রমণ শরীরে বহন করে ছড়িয়ে পড়েন। তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনের নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা পালিত হয়েছে যৎসামান্যই। পরিণাম হয় তাই ভয়াবহ। এখন প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে তা হাজারের ঘরে পৌঁছেছে। প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা ২০-এর ওপরে উঠছে। মোট সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়েছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো, অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ১০ হাসপাতাল ঘুরেও একজন সাধারণ বা করোনা রোগী সময়মতো ভর্তি হতে পারছেন না, চিকিৎসাবঞ্চিত অবস্থায় মারা যাচ্ছেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলো এসব রোগীকে হাসপাতালের বারান্দায়ও তুলতে দেয়নি। কতটা নির্মমতা তা বলে বোঝানো যাবে না। ডাক্তার-কন্যার বাবা রাষ্ট্রের অতিরিক্ত সচিব হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে বাবাকে ভর্তি করতে পারেননি। শেষাবধি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে একটু জায়গা পেলেও একটা ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) পাননি। এ রকম অব্যবস্থাপনা সারা দেশে চলছে, সাধারণ বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা চেম্বার ছেড়ে পালিয়ে রয়েছেন। সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম একেবারে শূন্যের কোঠায় চলে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।

বিএনপি দায়িত্বশীল জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে মানুষের সহায়তায় কিছু পরামর্শ বা আবেদন-নিবেদন কার্যক্রম রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রদান অপরিহার্য মনে করে তৎপরতা চালাচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সরকারি দল কর্তৃক একেবারেই কোণঠাসা অবস্থানে রয়েছে। তার পরও একটা জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজের কিছুটা দায়িত্ব পালনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। অথচ সেসব প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপি মহাসচিব খুব সামান্যই অভিযোগ করে থাকেন। তিনি সাম্প্রতিককালে একবার করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় একটা জাতীয় পর্যায়ের শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব রেখেছিলেন। তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সমানে বিষোদ্গার করতে লাগলেন বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে। যে কোনো রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকলে ভুল করতে পারে। বিরোধী দলের দায়িত্ব হচ্ছে সেসব ভুল ধরিয়ে দেওয়া এবং সরকারি দলের নেতারা যাতে সঠিক পথে চলতে পারেন তাতে সহায়তাদান করা। তাতে তো হল্লা-চিল্লা করার কিছু নেই। অথচ উভয় মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতারা অশোভন আক্রমণ করে বিষোদ্গার করলেন। সারা দুনিয়া যেখানে কভিড-১৯ সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে দু-চারটি ব্যতিক্রম বাদে, সেখানে সরকারি দলের নেতারা বিএনপি নেতাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জোগাড় হচ্ছেন কেন? কেন এই হীনমন্যতা! আওয়ামী লীগ বা বিএনপি রাষ্ট্রীয় কোনো কর্মসূচি পালনকালে কোনো ভুল করতে পারবে না! কেন তা প্রতিপক্ষ বিরোধী দল সমালোচনা করতে পারবে না! বরং বলা যায়, সমালোচনা করা দরকার, এমনকি আত্মসমালোচনাও তো দরকার প্রতিটি ব্যক্তির ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকা- সঠিকভাবে পরিচালনার স্বার্থেই। বাংলাদেশের মতো একটা রাষ্ট্রে সরকার ব্যবস্থাপনা যে রাজনৈতিক দল পরিচালনা করে সেই পার্টি অবশ্যই একটা ভালো বা সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে ও তাদের দিয়ে রাষ্ট্র-কাজগুলো সমাধায় এগোতে থাকে। সেটা একটা রুটিন ব্যাপার। তবে তার একটা ধারাবাহিক তৎপরতার অংশ থাকে যা সরকারি দলের নেতাদের সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে যায় অবিরাম। ফলে আওয়ামী লীগ সরকারি দল হিসেবে বিরোধী দল বিএনপির চেয়ে অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থান লাভ করে নিজেদের দাপুটে অবস্থান অক্ষয় রাখার সুবিধা পেয়ে যায়। এখন ওবায়দুল কাদের বা ড. হাছান মাহমুদের মতো আওয়ামী লীগ নেতারা (এবং মন্ত্রীও বটে তারা) বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। সাধারণ গলাবাজিতেও তারা এগিয়ে।

মির্জা আলমগীর সাহেব করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় দক্ষ ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটা টাস্কফোর্স গঠনের যৌক্তিক ও চমৎকার প্রস্তাব দিয়ে উল্টো ভর্ৎসনার শিকারে পরিণত হন সরকারদলীয় সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রীর। এটা কেমন ধরনের হীনমন্যতার রাজনীতি! এই টাস্কফোর্স যে কোনো রাষ্ট্রে গঠন করা যেতে পারে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে, দুর্যোগে-মহাদুর্যোগে, জরুরি পরিস্থিতিতে। এ রকম একটা নিরীহ ও জনকল্যাণের প্রস্তাবে সরকারদলীয় নেতার গাত্রদাহ সৃষ্টি হওয়ার কারণ কী! আসলে তারা এক ধরনের হীনমন্যতার রাজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। সেখান থেকে বেরোনোর মতো উদারতা তাদের স্বভাব-চরিত্রে অর্জন করতে পারবেন না, কোনো দিন। তা না হলে কেন টাস্কফোর্স করার আবেদন নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা আলমগীর সাহেবের প্রস্তাবে এমন উষ্মা প্রকাশ করবেন ওবায়দুল কাদের সাহেব! এ ছাড়া বিএনপি মহাসচিব আর কী প্রস্তাব রাখতে পারতেন, তা কি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বুঝিয়ে দিতে পারেন দয়া করে। বরং কাদের সাহেবের উচিত ছিল বিএনপি মহাসচিবকে অভিনন্দন জানিয়ে বলা- আসুন ভাইসাহেব, আমরা একটা কার্যকর টাস্কফোর্স গঠন করে কভিড-১৯ লড়াইয়ে বিশেষ ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করি, যাতে একটা সফল রাষ্ট্রকার্য সবাই মিলে আমরা করতে পারি।

লেখক : যুগ্মমহাসচিব, বিএনপি।

সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর