বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা
সাম্প্রতিক

আসুন পিঁপড়ার কাছ থেকে আমরা বাঁচা-মরা শিখি!

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

আসুন পিঁপড়ার কাছ থেকে আমরা বাঁচা-মরা শিখি!

গল্প নয়, একটি বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা জার্নাল থেকে বলছি। পিঁপড়ারা নিজেদের মধ্যে

চুলোচুলি করার বদলে সবাই একাট্টা হয়ে নিজেদের ঘর সামলায়। কেউ যদি তাদের সেই ঘর দখলের চেষ্টা করে, তারা সবাই মিলেই তা রক্ষা করে। পিঁপড়ারা যে প্রতিকূল পরিবেশে থাকতে পারে, তার প্রধান কারণ একে অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা। নিজেদের মধ্যে যদি কোনো বিভেদ থাকে, দলাদলি থাকে, স্বার্থপর কোনো উদ্দেশ্য থাকে, সেসব সরিয়ে রেখে একযোগে কাজ করা এদের অভ্যাস। টিকে থাকার মতো কঠিন সমস্যা যখন তাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ায়, পিঁপড়ারা তখন এক হয় সবচেয়ে বেশি। এই তো কদিন আগে একটি আর্টিক্যাল পড়ছিলাম হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নামজাদা বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড উইলসনের।

বাংলাদেশের সামনে এখন টিকে থাকার মস্ত লড়াই ‘করোনা’। এর ওপর নির্ভর করছে আমাদের বাঁচা-মরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, অবিলম্বে প্রতিকারের ব্যবস্থা না নিলে পুরো বাংলাদেশই এক মহাদুর্যোগে নিক্ষিপ্ত হবে। আমি অবশ্য একটি নিবন্ধ প্রস্তুত করে রেখেছি যার নাম ‘বাংলাদেশের মৃত্যুকূপ’।

এত কিছুর পরও থেমে নেই পুকুর চুরি। ত্রাণ চোর ছোট হলে বাঁচা-মরার স্বাস্থ্য খাতে রয়েছে সমুদ্র চোর। চিকিৎসাসামগ্রী কেনায় ২২ কোটি টাকার গরমিলের ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এন-৯৫ মাস্কেও রয়েছে কেলেঙ্কারি। বিদেশ থেকে আমদানির কথা বলে দেশীয় কোম্পানি জেএমআই থেকে কেনা হয়েছে এন-৯৫ মাস্ক, যা আদতে এন-৯৫ নয়। চরম অব্যবস্থাপনার কারণে সংক্রমণের হার প্রতিদিন বাড়ছে। শুধুই কথামালা দিয়ে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে প্রতিদিন চলছে নানারকম তেলেসমাতি। অর্থ বিভাগ থেকে এখন পর্যন্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। পাঠক! এতক্ষণ যা বলছিলাম, এগুলো আমার কথা নয়। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর। এ নিয়ে খোদ দেশের বড়কর্তাও বিব্রত।

এত বড় সমস্যা, অথচ এ নিয়ে কর্তাব্যক্তিদের উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না। সরকার নামকাওয়াস্তে যা করছে সে বিষয়ে ব্যাখ্যায় গেলে হাতে হাত কড়া পরবে বৈকি? কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষাজনক, এ কথা বিশ্বব্যাংকসহ আরও অনেকেই বলেছে। তাই বলে এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে করেনার সমস্যা যখন আরও স্থায়ী হয়ে কাঁধের ওপর জুড়ে বসবে, অনায়াসে সে ভার ঝেড়ে ফেলতে পারব। এর জন্য যে প্রস্তুতি দরকার, আমাদের তা নেই। যদিও এমপি-মন্ত্রীরা ধান কাটার মহড়ায় ছবি তুলতে ব্যস্ত। বিভিন্ন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখনো এক-চতুর্থাংশ মানুষ খাদ্যাভাবের কারণে অপুষ্টিতে ভোগে। মৌসুমি খাদ্যাভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলে এখনো ব্যাপক খাদ্যাভাব ঘটে। আমরা সবাই ‘মঙ্গা’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত।

অন্য যে বড় সংকট এ মুহূর্তে না হলেও কিছুদিনের মধ্যে ভয়াবহ আকার নিতে পারে তা হলো বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা। আমাদের অর্থনীতির ১০ শতাংশ আসে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ থেকে। অথচ এ খাতে উপার্জন অব্যাহত থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নিজ দেশের গার্মেন্ট সেক্টরের কথা না হয় বাদই দিলাম।

ওপরের প্রতিটি সমস্যাই বাংলাদেশের জন্য কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। বাঁচা-মরার মতো সংকটাপন্ন অবস্থা যদি নাও হয়, এ কথায় কোনো ভুল নেই, সময় থাকতে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আগামী দিনের জীবনযাত্রার মান নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাবে। সমস্যা যেখানে এমন জটিল, বহুমুখী ও বিস্তৃত, তার মোকাবিলায় চাই সমপরিমাণ প্রস্তুতি, একাগ্রতা ও কাজের সমন্বয়। সঙ্গে সঙ্গে চাই রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি। একা কোনো দল বা কোনো নেতার পক্ষে এ কাজে সফল হওয়া অসম্ভব। এক দফা, একতরফা ক্ষমতায় থেকেও এসব সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। এই সাধারণ কথাটা যদি আমাদের নেতা-নেত্রীরা বোঝেন তাহলে আমরা সত্যি বর্তে যাই।

একে অন্যের সঙ্গে চুলোচুলি করুন ক্ষতি নেই, আমরা শুধু বলি দেশের স্বার্থটা মাথায় রেখে সে কাজ করুন। রাজা-রানী হতে চান, কিন্তু দেশটাই যদি সমস্যার আবর্তে তলিয়ে যায়, তাহলে শুধু কেদারাখানা পেয়ে কী লাভ হবে?

সমস্যা উত্তরণের জন্য পথ খুঁজতে আমার মতো ক্ষুদ্র লেখকদের পত্রিকার কলাম পড়তে হবে না। মোটা বই ঘাঁটারও প্রয়োজন নেই। শুধু চোখ খুলে দেখুন অতিক্ষুদ্র পিঁপড়া কীভাবে সবাই মিলে লড়াই করে বেঁচে আছে। পিঁপড়া যা পারে, আমরা কি তাও পারব না?

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর