শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

পবিত্র জুমাতুল বিদা ও আল কুদস দিবসের ভাবনা

মুফতি মুহাম্মাদ এহছানুল হক মুজাদ্দেদি

পবিত্র জুমাতুল বিদা ও আল কুদস দিবসের ভাবনা

রমজানের শেষ জুমা আমাদের দ্বারপ্রান্তে, এ জুমাকেই বলা হয় জুমাতুল বিদা। মুসলিম বিশ্বে এ দিবসটি পবিত্রতার সঙ্গে দোয়া-মুনাজাতের সঙ্গে প্রতি বছর পালিত হয়। এ দিবসকে আল কুদুস দিবসও বলা হয়। আল কুদুস দিবসের প্রেক্ষাপট : করোনাভাইরাসের এই মহামারী সারা বিশ্বকে থমকে দিয়েছে। মহামারীর আগে হানাহানি-মারামারির বিশ্বে মুসলিম উম্মাহর সামনে বহুমুখী সংকট কেবলই আবর্তিত হচ্ছিল। মুসলমানরা সারা বিশ্বে নানাভাবে নিগৃহীত ছিল। বিশ্বের দেশে দেশে তাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সত্য-মিথ্যা নানা অজুহাতে বিপর্যয়কর, বিধ্বংসী ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। বিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন অসংখ্য মুসলমানকে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছিল। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান, চীন, ভারত, মিয়ানমার সর্বত্র চলছিল মুসলিম নিগ্রহ। বাস্তবে তালিকা আরও দীর্ঘ ও সুবিস্তৃত। সেই সঙ্গে আছে মুসলমানদের আত্মপরিচয় হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা। আধুনিক বিশ্বের নানামুখী চিন্তাধারার প্রভাব, ইসলাম সম্পর্কে জানার সুযোগ কম থাকা এবং ইসলামবিরোধীদের অব্যাহত চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মুসলমানরা আজ নিজের দীন থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিভেদ, অনৈক্য ও অজ্ঞানতা। এ প্রেক্ষাপটে এবারও মাহে রমজানের শেষ শুক্রবার যথারীতি মুসলিম বিশ্বে পালিত হবে আন্তর্জাতিক আল কুদস দিবস। দীর্ঘদিন ধরে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের দখলে থাকা মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের দাবিতে প্রতি বছর রমজানের শেষ শুক্রবার জুমাতুল বিদা বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। কুদস অর্থ পবিত্র। ‘আল কুদস’ বলতে বোঝায় ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে অবস্থিত পবিত্র মসজিদ, যা মসজিদুল আকসা বা ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ নামে পরিচিত। হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর তাঁর ছেলে হজরত ইসহাক (আ.)-এর সন্তান হজরত ইয়াকুব (আ.) ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নামক স্থানে ‘আল আকসা’ মসজিদটি নির্মাণ করেন। এরপর তাঁর ছেলে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর বংশধর হজরত দাউদ (আ.)-এর সন্তান হজরত সুলাইমান (আ.) তা পুনর্নির্মাণ করেন। রমজানের শেষ শুক্রবার জেরুজালেম নগর প্রতিষ্ঠা করেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের ঘোষণার পর মুসলমানদের কাছে বায়তুল মুকাদ্দাস পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য হতে থাকে। আল কোরআনে বায়তুল মুকাদ্দাসকে পবিত্র ভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘স্মরণ কর, মুসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন, এতে তোমরা প্রবেশ কর এবং পশ্চাৎপসরণ কোরো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।’ সূরা আল মায়িদা, আয়াত ২১। বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কিবলা হিসেবে পরিচিত। হাদিসে আছে, ‘কাবা তথা মসজিদুল হারামে নামাজে ১ লাখ গুণ সওয়াব, মদিনা মসজিদে নববীতে নামাজে ৫০ হাজার গুণ সওয়াব, বায়তুল মুকাদ্দাসে নামাজে ২৫ হাজার গুণ সওয়াব।’ বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের কাছে সব সময় সম্মানিত। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিরাজ রজনিতে মসজিদুল হারাম তথা কাবা থেকে মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাস প্রথম সফর করেন, যা ইসরা নামে পরিচিত। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিরাজ গমনের সময় এ মসজিদে নামাজ আদায় করেন। এ এলাকা অসংখ্য নবী-রসুলের স্মৃতিবিজড়িত, এর আশপাশে অনেক নবী-রসুলের রওজা রয়েছে। এটি দীর্ঘকালের ওহি অবতরণের স্থল, ইসলামের কেন্দ্র এবং ইসলামী সংস্কৃতির চারণভূমি ও ইসলাম প্রচারের লালন ক্ষেত্র। এ পবিত্র ভূমির ভালোবাসা প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ের গভীরে আবেগে আপ্লুত। হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে ৬৩৮ সালে বায়তুল মুকাদ্দাস, জেরুজালেমসহ পুরো ফিলিস্তিন সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের অধিকারে আসে। ১০৯৬ সালে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা সিরিয়া ও ফিলিস্তিন জবরদখল করে নেয়। ১১৮৭ সালে মুসলিম বীর সিপাহসালার সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) পুনরায় জেরুজালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। এর পর থেকে খ্রিস্টান ও ইহুদি চক্র ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এ অসদুদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ইহুদিরা তৎকালীন তুরস্কের শাসক সুলতান আবদুল হামিদের কাছে ফিলিস্তিনে বসতির অনুমতি চায়; দূরদর্শী সুলতান তাদের এ দুরভিসন্ধিমূলক প্রস্তাবে রাজি হননি। ১৯১৭ সালে ইংরেজরা ফিলিস্তিনে অনুপ্রবেশ করে এবং ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে; অল্প সময়ের মধ্যে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে ইহুদির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের সঙ্গে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দাঙ্গা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। এ সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা অন্যায়ভাবে মুসলমানদের ফিলিস্তিন ভূমিকে মুসলমান ও ইহুদিদের মাঝে ভাগ করে দেয়। ফলে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে, বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে জায়নবাদী অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে মুসলমানদের প্রতি ইহুদিদের জুলুম, নির্যাতন ও অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে। ইসরায়েল ‘মসজিদুল আকসা’ জবরদখল করে নেয় ১৯৬৭ সালে। এর পর থেকে মুসলিমরা স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনা করে। ইসরায়েল নতুন নতুন মুসলিম এলাকা জবরদখল করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে এবং হত্যা, গুম চালিয়ে যাচ্ছে। ইহুদিদের ঘৃণ্য পরিকল্পনা সচেতন মুসলমানদের সংগ্রামী প্রতিরোধ আন্দোলনের মুখে পরিপূর্ণভাবে সফল হতে পারেনি। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ ফিলিস্তিনি মুসলিমদের এ প্রতিরোধ আন্দোলন সমর্থন করেছে।

লেখক : খতিব, মণিপুর বাইতুল আশরাফ (মাইকওয়ালা) জামে মসজিদ, মিরপুর, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর