শনিবার, ৩০ মে, ২০২০ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে ও আইনি প্রতিকার

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে ও আইনি প্রতিকার

হাবিবুর রহমান (ছদ্মনাম) বাড়ি কুষ্টিয়া জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ফারহানার (ছদ্মনাম) সঙ্গে। ফারহানাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। ফারহানার বাড়ি যশোর জেলায়। ভালোই চলছিল তাদের দাম্পত্য জীবন। হঠাৎ এক ঝটিকা ঝড় এসে সবকিছু তছনছ করে দেয়। বিয়ের এক বছর পর হাবিবুর জানতে পারেন ফারহানার গ্রামের বাড়িতে আরেকটি স্বামী আছে। বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটে হাবিবুরের মাথায়। ফারহানার গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখেন সত্যিই ফারহানা তাদের পাশের গ্রামে শিমুল (ছদ্মনাম) নামে এক ছেলেকে তিন বছর আগে বিয়ে করেছিলেন। প্রতারণা করে সত্যকে আড়াল করে দ্বিতীয় বিয়ে করার অভিযোগে হাবিবুর তার স্ত্রীকে তালাক দেন। অপরদিকে যখন শিমুলও জানতে পারেন যে তার স্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আরেকটি বিয়ে করেছেন, তিনিও ফারহানার সঙ্গে বিয়ে বিচ্ছেদ করেন। একূল-ওকূল দুকূল হারিয়ে নিরুপায় ফারহানা ঢাকার ঠিকানা দেখিয়ে হাবিবুরের বিরুদ্ধে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে মামলা ঠুকে দেন। মামলাটি হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১-এর গ ধারায়/৩০ ধারায়। এ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা-মাতা, অভিভাবক অথবা স্বামীর পক্ষের কোনো ব্যক্তি যৌতুকের জন্য কোনো সাধারণ জখম করেন, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি সাধারণ জখম করার জন্য অনধিক তিন বছর কিন্তু অন্যূন এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। হাবিবুর আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন জানান। মামলার ধারাটি জামিন অযোগ্য হওয়ায় জামিনের আবেদনটি নামঞ্জুর হয়। এ মামলায় কয়েক দিন জেল খেটে তিন বছর ধরে কোর্টে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন হাবিবুর। স্বামী বা স্ত্রীর জীবদ্দশায় পুনরায় বিবাহ করা বিষয়ে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ৪৯৪ ধারায় বিস্তারিত বর্ণনা ও প্রতিকার রয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এক স্বামী বা এক স্ত্রী জীবিত থাকা সত্ত্বেও পুনরায় বিয়ে করেন, তাহলে দায়ী ব্যক্তি সাত বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে যে প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রীর জীবদ্দশায় বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, বিয়ের সময় পর্যন্ত সে স্বামী বা স্ত্রী যদি সাত বছর পর্যন্ত নিখোঁজ থাকেন এবং সেই ব্যক্তি বেঁচে আছেন বলে কোনো সংবাদ না পান, তাহলে এ ধারার আওতায় তিনি শাস্তিযোগ্য অপরাধী বলে গণ্য হবেন না। জামিনযোগ্য ধারার অপরাধ। যেহেতু ফারহানা প্রথম স্বামী বা বিবাহের বিষয় গোপন রেখে পুনরায় বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে, এক্ষেত্রে হাবিবুর ফারহানার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ৪৯৪ ধারায় মামলা করে প্রতিকার পেতে পারেন। যে ব্যক্তির সঙ্গে পরবর্তী বিবাহ হচ্ছে, তার কাছে পূর্ববর্তী বিবাহ গোপন করে তাকে বিবাহ করা বিষয়ে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ৪৯৫ ধারায় বিস্তারিত বর্ণনা আছে। এ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয় বা পরবর্তী বিয়ে করার সময় প্রথম বা পূর্ববর্তী বিয়ের তথ্য গোপন রাখেন, তা যদি দ্বিতীয় বিবাহিত ব্যক্তি জানতে পারেন, তাহলে অপরাধী ১০ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। তবে জামিনযোগ্য ধারার অপরাধ। উপরোক্ত আলোচনা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, ফারহানা প্রথম বিয়ের বিষয় গোপন করে এবং প্রথম বিবাহ বলবৎ থাকা অবস্থায় হাবিবুরকে দ্বিতীয় বিয়ে করে সে দণ্ডবিধি আইনের ৪৯৪/৪৯৫ ধারার অপরাধ করেছেন। ফারহানার বিরুদ্ধে এ ধারার অপরাধ প্রমাণ ও সাজা দেওয়ার জন্য দুটি দালিলিক প্রমাণই যথেষ্ট। প্রথমটি হচ্ছে ফারহানার প্রথম বিবাহের কাবিননামা আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর প্রথম স্বামী কর্তৃক তালাকের নোটিস। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে, আমেনা খাতুন গং বনাম মুনসী মিয়া মামলা যা ১২ ডিএলআর ৩০৯ পৃষ্ঠায় বর্ণিত রয়েছে। সিদ্ধান্তটি এমন যে, স্ত্রী দ্বিতীয়বার বিবাহ করায় তাকে সাজা দিতে হলে অভিযোগকারীর সঙ্গে প্রথম বিবাহটি বৈধভাবে হয়েছিল এরূপ প্রমাণ থাকা দরকার। সুতরাং এ ধারার অধীনে শাস্তি আরোপ করার আগে কোনো বৈধ বিবাহ ইতিমধ্যে যে সংঘটিত হয়েছে তা প্রমাণ করতে হবে। যেমন-১. অভিযুক্ত নারী বিবাহিত ছিল ২. বিবাহটি আইনানুগ এবং বৈধ পন্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৩. যার সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল, তিনি জীবিত ৪. অভিযুক্ত নারী অন্য কোনো ব্যক্তিকে বিবাহ করেছে ৫. শেষোক্ত বিবাহের সময় প্রথম বিবাহের তথ্য গোপন করেছিল। তবে প্রথম বিবাহটি বিচ্ছেদ হওয়ার পর দ্বিতীয়বার বিবাহ করলে কোনো অপরাধ হবে না। এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, স্ত্রী বিবাহ করলে এই ধারায় অপরাধ হবে। কিন্তু আমাদের দেশে স্বামী তার জীবদ্দশায় অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে। তাতে অপরাধ হয় না। তবে মুসলিম পারিবারিক অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১-এর ৬(৫) ধারা মতে স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত বিবাহ করলে অপরাধ হবে। মুসলিম শরিয়ত অনুসারে একসঙ্গে চারজন স্ত্রী রাখার বিধান বহাল আছে। পুরুষ একাধিক স্ত্রী রাখতে পারে। ফলে দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারাটি মুসলমান ও হিন্দু পুরুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। প্রসঙ্গত, হিন্দুদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আইন অনুযায়ী যে কোনো সংখ্যক বিবাহ করার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মেই বহুবিবাহের অনুমতি রয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু হিন্দু ও মুসলিম নারীদের ওপর প্রযোজ্য। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ সংবিধান অনুযায়ী ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং কোনো রকমের বৈষম্য ছাড়াই সবার আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।’  সেই সঙ্গে ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী-পুরুষ ভেদে অথবা জন্মস্থানের কারণে কারও প্রতি বৈষম্য নিষিদ্ধ  করা হয়েছে।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

Email:[email protected]

সর্বশেষ খবর