শ্রী চৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩) প্রকৃত নাম বিশ্বম্ভর মিশ্র। কৃষ্ণ চৈতন্য নামেও তিনি পরিচিত। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ থেকে রূপান্তরিত এক ধর্মবেত্তা, যিনি তাঁর স্বকীয় ভক্তির মাধ্যমে বাংলা ও উড়িষ্যার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন। বৈষ্ণব বংশ পরম্পরার পঞ্চম পর্যায় অর্থাৎ গৌড়ীয় সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব তাঁর, যা বর্তমানে উত্তর ভারত ও বাংলাদেশের বৈষ্ণব সমাজের ধর্মজীবনে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।
চৈতন্যের জীবনের প্রথমার্ধ নদীয়া জেলার (পশ্চিমবঙ্গের) নবদ্বীপে অতিবাহিত হয়। সন্ন্যাস গ্রহণের পরে তিনি ভারতের সব তীর্থ ভ্রমণ করেন, তারপর ফিরে আসেন উড়িষ্যায়, যেখানে শুধু ব্রজ অঞ্চলে একটি সংক্ষিপ্ত সফর বাদ দিলে তাঁর জীবনের বাকি সময় স্থায়িভাবে কাটান। পুরীতে বাসকালে তিনি ক্রমশ জড়ো হওয়া বহু সংখ্যক পন্ডিত, গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী, এমনকি প্রজাপতি রাজা প্রতাপ রুদ্রের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। বাংলার ভক্তবৃন্দ তাঁকে ধরাধামে আবির্ভূত স্বয়ং ভগবান অর্থাৎ কৃষ্ণ হিসেবে জ্ঞান করে প্রতি বছর, তাঁর কাছে আসত। এ মাহাত্ম্যে তাঁর জীবনকাহিনি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে দুটি উদ্দেশ্য সম্পন্ন করেছে। প্রথমত, আধ্যাত্মিক উপস্থিতির মূর্ত প্রকাশরূপে এবং দ্বিতীয়ত, ভক্তির আদর্শ হিসেবে। কারণ, তাঁর শিক্ষা ও ব্যক্তিগত আদর্শই ধর্মতত্ত্ব ও ধর্মীয় আচারাদির মৌলিক নীতিসমূহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে এবং বর্তমানে সেগুলো গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে প্রাধান্য লাভ করেছে। ষোলো শতকে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় আড়াই লক্ষেরও বেশি চরণে রচিত পুঁথিগুলোতে তাঁর কর্মকা- লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এবং এসব বিবরণে বিধৃত ঐতিহ্য তাঁর জীবনের মূল রূপরেখার সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
নদীয়া জেলায় নবদ্বীপ শহরে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের (১৪০৭ শকাব্দ) ফাল্গুন মাসের (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) চন্দ্রগ্রহণের রাতে এক শুভ লগ্নে চৈতন্য জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জগন্নাথ মিশ্র সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণ গ্রাম থেকে আগত, আর তাঁর মা শচী ছিলেন নীলাম্বর চক্রবর্তী নামের এক সিলেটি ব্রাহ্মণের কন্যা। প্রথাগতভাবে চৈতন্য লালিত-পালিত হন।