বৃহস্পতিবার, ৪ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় প্রবীণদের উদ্বেগ বাড়ছে

তপন কুমার ঘোষ

করোনায় প্রবীণদের উদ্বেগ বাড়ছে

গেল ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে প্রথম শোনা গিয়েছিল, চীনে একটি নতুন ভাইরাস থাবা বসিয়েছে। তখন ঘুণাক্ষরেও বোঝা যায়নি যে, এই ভাইরাস এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে গোটা বিশ্বে এবং কেড়ে নেবে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ। করোনার মরণ নেই। করোনাকে নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’র পূর্বাভাসে এমনটিই বলা হচ্ছে। রোগ, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ সব ধরনের সংকট মোকাবিলা করেই পথচলার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘আপনার সুরক্ষা আপনার হাতে। আপনি সুরক্ষিত থাকলে আপনার পরিবার সুরক্ষিত থাকবে, প্রতিবেশী সুরক্ষিত থাকবে, দেশ সুরক্ষিত থাকবে।’ দেশে ক্রমেই বাড়ছে করোনা সংক্রমণের মাত্রা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতা ও সতর্কতা বাঁচার উপায়। নিজকে সুরক্ষিত রাখতে মাত্র কয়েকটি কাজ বিশেষজ্ঞরা বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। এক. সাবান দিয়ে বারবার হাত ধুতে হবে। দুই. বাইরে বের হলে মাস্ক পরতে হবে। তিন. ঘরের বাইরে বজায় রাখতে হবে সামাজিক দূরত্ব। চার. ঘরে ফিরেই জামা-কাপড়-জুতা ও মাস্ক জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পাঁচ. নিজকেও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এগুলো কি খুবই কঠিন? তবে ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো জনাকীর্ণ শহরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন বটে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে আমরা হামেশাই পরকে জ্ঞান দিচ্ছি। কিন্তু নিজেরা কাজগুলো ঠিকমতো করছি না। মাস্কটা গলায় ঝুলিয়ে রাখছি। কেউবা পকেটে রাখছি। সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কারণে-অকারণে ঘরের বাইরে ঘোরাফেরা করছি। পরকে উপদেশ দেওয়া সহজ কাজ। কিন্তু নিজে সেটা চর্চা করছি কিনা সেটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাদ আছে, ‘আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও’। লকডাউনের শর্ত মেনে নিজের প্রয়াত মাকেও শেষবারের মতো দেখতে যাননি নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট। শেখার আছে অনেক কিছু।

দেশে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন বয়স্করা। কারও ছেলেমেয়ে বিদেশে তো কারও অন্য শহরে। বয়স্কদের দেখার কেউ নেই। আশপাশের চেনা মানুষগুলো দিন দিন কেমন যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে! যেন ভিন্ গ্রহের বাসিন্দা। শঙ্কা জাগে, হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে কী হবে! অনেক জায়গায় নিকট আত্মীয়স্বজন করোনায় আক্রান্ত রোগী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ‘চাচা আপন পরান বাঁচা’ নীতি মেনে চলছেন। নড়াইলের কালিয়ায় স্বজনরা এগিয়ে না আসায় মৃত ব্যক্তির সৎকার করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে করোনা উপসর্গ নিয়ে এক বৃদ্ধের মৃত্যুর পর লাশ দাফনে স্থানীয়রা বাধা দেওয়ায় পুলিশের সহায়তায় লাশ দাফন করা হয়। উদাহরণ অনেক আছে। বিপদে পড়লে বন্ধু চেনা যায়। করোনায় মৃত্যুঝুঁকি তো আছেই। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বেশি করে ভাবাচ্ছে প্রবীণদের। দুশ্চিন্তায় কাটে সারা দিন। রাতে ঘুম নেই চোখে। দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায়। কোনো কিছুই ভালো লাগে না। অন্যদিকে, মা-বাবার জন্য উদ্বেগে প্রবাসী সন্তানরা। উদ্বিগ্ন হওয়ারই কথা। কিন্তু এ মুহূর্তে তাদের কিছুই করার নেই। ইচ্ছা থাকলেও এই দুঃসময়ে বৃদ্ধ মা-বাবার পাশে এসে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। সর্বত্র লকডাউন। বিমান উড়ান বন্ধ। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে শেষ দেখার সুযোগটুকুও হয়তো হবে না। এসব ভেবে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছে না তারা। ভবিতব্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে! করোনা আতঙ্কের মধ্যে প্রবাসীদের নতুন আতঙ্ক চাকরি হারানো। অবসরপ্রাপ্তদের জন্য বর্তমান সরকারের একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হচ্ছে, শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের মাসিক পেনশন পুনঃস্থাপন। এই সিদ্ধান্ত ১ জুলাই ২০১৭ থেকে কার্যকর হয়েছে। শতভাগ পেনশন সমর্পণের পর পনের বছর উত্তীর্ণ হলে জিপিএফ স্কিমভুক্ত অবসরপ্রাপ্তরা এই সুবিধা পাচ্ছেন। সরকারের এই  মানবিক সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হয়েছে সব মহলে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পনের বছরের এই সময়সীমা কমিয়ে আনার প্রস্তাব সরকারের বিবেচনাধীন আছে বলে শোনা যাচ্ছে।

করোনা-সংকটকালে প্রবীণদের জন্য নেই কোনো আর্থিক প্যাকেজ। উল্টো, আয় কমেছে সুদনির্ভর মানুষদের। ব্যাংকে মেয়াদি আমানতের (ফিক্সড ডিপোজিট) ওপর সুদহার কমে এখন সর্বোচ্চ ছয় শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির হারও ছয় শতাংশের কাছাকাছি। সুদের ওপর ক্ষেত্রমতে দশ বা পনের শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করা হয়। এছাড়াও আছে আবগারী শুল্ক আদায়। সব কিছু বিবেচনায় ব্যাংকে টাকা রাখা কতটা লাভজনক সে প্রশ্ন থাকছেই। বিনিয়োগের আরেকটি খাত হলো শেয়ারবাজার। এখানে বিনিয়োগ করে অনেকে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। অবসরপ্রাপ্তদের নিরাপদ বিনিয়োগের একমাত্র খাত হলো সঞ্চয়পত্র। সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার তুলনামূলক বেশি। সামাজিক নিরাপত্তার হাতিয়ার হিসেবে সঞ্চয়পত্রকে গণ্য করা হচ্ছে। ‘জাতীয় সঞ্চয় স্কিম অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ চালু করার ফলে সঞ্চয়পত্রে ‘কালো টাকা’ বিনিয়োগ বা বিনিয়োগ সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগে লাগাম টানা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। সঞ্চয়পত্র থেকেও আয় কমেছে গেল বছর থেকে । সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমেনি, তবে বেড়েছে উৎসে কর কর্তনের হার। উৎসে কর পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে এক লাফে দশ শতাংশ করায় সঞ্চয়পত্র থেকে নিট আয় কমেছে। এটা ভুলতে পারছেন না ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। অবসরপ্রাপ্তদের মধ্যে যাদের সঞ্চয়পত্র ছাড়া আয়ের আর কোনো উৎস নেই তারা পড়েছেন বিপাকে। আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করেছে তাদের। এবারের বাজেটে প্রবীণদের জন্য সুখবর আসবে, এই প্রত্যাশায় দিন গুনছেন তারা। 

লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড

সর্বশেষ খবর