শনিবার, ৬ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

লিবিয়ায় লঙ্কাকান্ড আমাদের দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

লিবিয়ায় লঙ্কাকান্ড আমাদের দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ

অনেক বছরের চেনা পৃথিবী হঠাৎ করেই যেন অচেনা হয়ে গেল। এক করোনায় সব কিছুই যেন ওলট-পালট করে দিল। মাকে জঙ্গলে রেখে আসা, স্বামীকে ঘরে ঢুকতে না দেওয়া, ভর্তি হতে না পেরে হাসপাতালের গেটে সন্তান প্রসব, অভিজাত হাসপাতালে অগ্নিকান্ডে অসহায় রোগীর করুণ মৃত্যু, দেশসেরা বিত্তশালীদের অঢেল সম্পদ আপনজনদের চিকিৎসায় কাজে না লাগার মতো দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত নয় এই দুই চোখ। অথচ পোড়া চোখে এ সবই দেখতে হলো, বৈরী বাতাসে শুনতে হলো কান্নার রোল আর দীর্ঘশ্বাস। দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মী, স্বনামধন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ, পরিবার, মিডিয়া মহল-সর্বত্র কেবল নীরব চোখের নোনাজল আর অজানা আশঙ্কা, সীমাহীন আতঙ্ক। আসন্ন মৃত্যু যেন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সবাইকে প্রতিনিয়ত অনেকের সামনেই প্রশ্ন করোনায় মৃত্যু; না হয় অনাহারে মৃত্যু, কোনটা বেছে নেবে? এমনি ধরনের হাজারো প্রশ্ন আগুনের ধোঁয়ার মতো কু-লী পাকিয়ে গ্রাস করছে গোটা সমাজ। অথচ বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষতার দিনেও কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না কেউ। একজন মার্কিন নাগরিক যদি কোথাও পণবন্দী বা আটক থাকে, তাকে উদ্ধারে শত শত সেনা আর ডজন ডজন সামরিক যান, জাহাজ বা বিমান পাঠাতে কুণ্ঠাবোধ করে না মার্কিন প্রশাসন। অথচ এক লাখেরও বেশি মার্কিনির মৃত্যুতে কেবল সৎকার করা ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারেনি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই দেশটি।

চারদিকে যখন এমনি প্রতিকূল পরিবেশ, ঠিক তখন ভূ-মধ্যসাগর তীরবর্তী উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া থেকে আসা দুঃসংবাদ শোকের জগতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। ভাগ্য ফেরানোর আশায় স্বপ্নের দেশ ইতালিতে যাওয়ার নেশায় লিবিয়ায় পৌঁছে ছিলেন বাংলাদেশের একদল তরুণ, যুবক, কারও সন্তান, কারও স্বামী, কারও ভাই কিংবা কারও বাবা। অথচ ভাগ্যেরই যেন নির্মম পরিহাস হয়ে আজ তাদের ২৬ জনের ঠিকানা ইতালির পরিবর্তে হয়ে যায় লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজাদাহর গোরস্থানে। দুঃখের বিষয় যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ার এই মফস্বল শহরে লাশ সংরক্ষণের এ পর্যন্ত ব্যবস্থা ছিল না। সুতরাং বাধ্য হয়েই এই হতভাগ্যদের কবর দেওয়া হয় স্থানীয় গোরস্থানে। ফলে শোকসন্তপ্ত পরিবারের শেষ চাওয়া, প্রিয়জনের মুখ শেষবারের মতো দেখা বা নিজ হাতে মাটি দেওয়ার ইচ্ছারও কবর রচিত হলো।

ঘটনার বিবরণ, মিডিয়ার সংবাদ এবং ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া আরেক ভাগ্য অন্বেষী সাইদুরের বর্ণনা মতে, তারা ৩৮ জন বাংলাদেশি ও আরও কিছু আফ্রিকান ইতালিতে যাওয়ার আশায় দালালদের দ্বারস্থ হয়। এই ৩৮ জন ছিল ঢাকা, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, যশোর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার বাসিন্দা। তারা প্রত্যেকে ন্যূনতম চার-পাঁচ লাখ টাকা তুলে দেন দালালদের হাতে নিরাপদে ইতালি পৌঁছার আশায়। যেভাবেই হোক, তারা লিবিয়া পৌঁছে অপেক্ষা করে সুযোগমতো ইতালিতে ঢোকার। এ সময় আন্তর্জাতিক দালালদের স্থানীয় দোসর তথা একদল লিবিয়া দস্যু তাদের আটক করে এবং প্রত্যেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। তাদের মধ্যে অনেকেই জীবনের শেষ সম্বল তথা বাবার ভিটা, মা বা স্ত্রীর গয়না, ঘরের গরু সব বিক্রি করে এমনকি চড়া সুদে টাকা ধার করেও দালালদের হাতে চার থেকে ১০ লাখ টাকা তুলে দেয়। তাই তাদের বা তাদের পরিবারের আর কোনো সাধ্য ছিল না টাকা জোগানোর কিন্তু দালাল চক্র বা দস্যুরা এসব কথায় কান দেওয়ার পাত্র নয়। ফলে তাদের ওপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন। সেই নির্যাতন আর নিষ্ঠুরতার কথা, ছবি ও ভিডিও পাঠানো হয় বাংলাদেশের স্বজনদের কাছে। ফলে পৃথিবীর দুই প্রান্তের অসহায় কিছু দিশাহারা মানুষ কেবলই কাঁদতে থাকে। রোজা, ইফতার, ঈদ, সবকিছুই তাদের কাছে ছিল মূল্যহীন।

নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং বন্দীদশা থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় দালাল ও দস্যুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বন্দী বাংলাদেশি ও আফ্রিকানরা। এদের মধ্যে দালাল ও দস্যুদের মূল হোতার ওপর একজন আফ্রিকান আক্রমণ চালালে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় সেই লিবীয় দালাল। এতে দ্রুতই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সমগ্র পরিবেশ। দালাল ও দস্যুদের বাকি অংশ তখন এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে বন্দীদের লক্ষ্য করে। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় ২৬ হতভাগ্য বাংলাদেশি আর আহত হয় ১১ জন, যাদের অন্তত ছয়জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বেশ কজন নিখোঁজ হওয়ার খবরও পাওয়া যায়, বাংলাদেশ সরকার লাশ ফেরত আনার উদ্যোগ নিলেও সংরক্ষণ সুবিধার অভাবে লাশের দুরবস্থা এবং ঘটনাস্থল থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে ত্রিপোলি পৌঁছানোর পথে লাশ লুট হওয়ার আশঙ্কায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ স্থানীয়ভাবেই লাশ দাফন করতে বাধ্য হয়। লিবিয়ার এই লঙ্কাকান্ড দেশের আর্থিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে পিএইচডি গবেষণার সময় যে বিষয়টি বারবার খুঁজে পেয়েছি, তা হলো পারস্পরিক আস্থাহীনতার সুযোগ গ্রহণ করে একটি কুচক্রী মহল সহজ-সরল মানুষগুলোকে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ অভিবাসনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একজন তরুণ বা যুবক চার থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ গেলে ভাগ্য ফিরবে বিশ্বাস করলেও একই পরিমাণ টাকা দেশে ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্প বা ব্যবসায় বিনিয়োগ করার সাহস পায় না। কারণ তার শিক্ষা থাকলেও নিজের ওপর সেই আস্থা নেই। পরিবারেরও আস্থা নেই সেই তরুণ বা যুবকের ওপর। এই পরিবারগুলো বিদেশ যাত্রার জন্য দালালের হাতে এই টাকা তুলে দিলেও নিজ সন্তানের হাতে কোনো পুঁজি দেওয়ার আস্থা পায় না। তাদের ভয় ‘টাকা নষ্ট করে ফেলবে’। ব্যাংক, এনজিও বা স্থানীয় সংগঠন কাগজে-কলমে বা বিজ্ঞাপনে যাই বলুক বাস্তবে তারা একজন তরুণ বা যুবকের হাতে এই পরিমাণ টাকা দেওয়ার মতো আস্থা রাখতে পারে না। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিশেষত নীরব চাঁদাবাজি, অসম প্রতিযোগিতা, দেশীয় উৎপাদনের চেয়ে আমদানিতে মনোযোগ, আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব প্রভৃতি একজন তরুণ বা যুবক উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক করোনায় ভিটামিন সি’র চাহিদা আমদানি পুরনো মাল্টা বা মোসাম্বির চাহিদা অনেক বেড়ে যায়, অথচ দেশের কুষ্টিয়া, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙামাটি, পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন জেলায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র উদ্ভাবিত সুমিষ্ট মাল্টা উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে স্থানীয় কৃষকরা। তরুণ বা যুবসমাজকে ইচ্ছা করলে এই ধরনের উৎপাদনে সম্পৃক্ত করে আমদানি বন্ধ ও মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব। অথচ তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। একইভাবে আদা, রসুন, পিয়াজ, গাজর ও মসলা উৎপাদনে তরুণ ও যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করলে অনেকেই হয়তো দালালের হাতে সর্বস্ব তুলে দিয়েও এভাবে প্রাণ হারাত না। তরুণ সমাজকে নিজেদের ওপর আস্থা তৈরি আর রাষ্ট্র ও সমাজের তাদের ওপর আস্থা রাখা আজ সময়ের দাবি।

দালাল চক্রের পরিচয় গ্রামে-গঞ্জে সবাই জানে। শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তা জানে না। এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগের অভাবে কোনো প্রতিকার করে না। একটি করুণ ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। তারপর নতুন আরেকটি উপসর্গ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে উপেক্ষিত থাকে দালালদের বিরুদ্ধে প্রতিকার। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো বিদেশে টাকা পাঠায় না বা বিদেশে টাকা পাঠানোর নিয়ম জানে না। তারা টাকা তুলে দেয় এ দেশের একদল মানুষরূপী অমানুষের হাতে। এই অমানুষগুলোর ঠিকানা আছে, টেলিফোন আছে, সহায়-সম্পত্তি সবই আছে। অথচ আইনের ফাঁক গলিয়ে তারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রচলিত আইনের পরিবর্তন ঘটিয়ে দালালদের জামিন নামঞ্জুর, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং কঠোরতর শাস্তির বিধান করতে হবে। যার হাতে টাকা তুলে দিয়ে প্রিয়জনের মৃতদেহও পাওয়া যায় না, তাদের অপরাধ পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনের ক্ষেত্রে বিমানবন্দরের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশের অভিযোগ নতুন নয়। একটি তরুণ বা যুবক কেন লিবিয়া যাচ্ছে তা কী তাদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করে না? লিবিয়া এমনিতেই একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। সে দেশের প্রশাসন ও অর্থনীতি আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার লিবিয়া আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে যেতে নিষেধ করা হলেও কীভাবে একজন তরুণ বা যুবক এসব দেশের ভিসা পায় আর ভিসা পেলেও তাকে এমন মৃত্যুপুরীর দিকে যেতে দিতে হবে, তা ভাবতে হবে। দেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থাপনা হলো হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সরকারের বেতনভুক্ত সব গোয়েন্দা সংস্থা পৃথকভাবে এই বিমানবন্দরের প্রতিটি যাত্রীর ওপর তীক্ষè নজর রাখে। অথচ সবার চোখের সামনে দিয়ে একদল তরুণ বা যুবক লিবিয়ার মতো নরকে যাত্রা করে, তা মেনে নেওয়া যায় না। গ্রামের যে সহজ-সরল তরুণ যুবক বা নারী ঠিকমতো সভ্যসমাজে কথা বলতে ইতস্তত করে, যার চোখে-মুখে কেবল ভীত-সন্ত্রস্ত ভাব, তার পর্যটক বা টুরিস্ট ভিসা থাকলেও তাকে বিদেশে যাওয়ার ছাড়পত্র যা ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার যুক্তি নেই। যে বিদেশে শখের বসে ভ্রমণ করার ক্ষমতা রাখে, তার আয়কর বা ট্যাক্স প্রদানের মতো সক্ষমতা থাকাটাই যৌক্তিক। বিমানবন্দরে যদি এসব তথাকথিত পর্যটক বা টুরিস্টের আয়ের উৎস জানা ও আয়কর সনদ অনলাইনে দেখার পর ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়, তবে অনেকটাই কমে যাবে টুরিস্ট ভিসায় অবৈধ অভিবাসন। অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাঁটাতারে আটকে থাকা কিশোরী ফেলানীর মৃতদেহ স্থলপথে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনের বহিঃপ্রকাশ।

সাগরপথে মালয়েশিয়াগামী ট্রলারভর্তি নারী-পুরুষের ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা আর মাঝপথে বিকল ট্রলারে করুণ আর্তনাদ প্রশাসনের দুর্বলতারই এক অকাট্য দলিল। কারণ টাকার বিনিময়ে দালালদের হাত ধরেই চলে এই ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন। আর এই দালালদের প্রতিরোধে মূল ভূমিকা প্রশাসনের কাছেই প্রত্যাশিত। ভূ-মধ্যসাগর, থাইল্যান্ডের জঙ্গল বা উত্তপ্ত মরুভূমিতে অসহায় অভিবাসন প্রত্যাশীদের অর্ধমৃত অবস্থার খ-চিত্র আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের দুর্বলতাই প্রকাশ করে। আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন বা আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্যর্থ রাষ্ট্রের নাগরিকদের সঙ্গে একই নৌকায় বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশের নাগরিকদের ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন সম্পূর্ণ বেমানান। করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশে বেকারত্ব বাড়াবে বই কমবে না। আর সেই অপেক্ষায় ওতপেতে আছে নিষ্ঠুর দালাল চক্র। প্রশাসন, সমাজ ও মিডিয়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই এই অনৈতিক, অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন রুখতে পারে।

লেখক : কলামিস্ট, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অভিবাসন বিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর