শনিবার, ৬ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

বিবেক ও বিবেচনা জীবনের শক্তি

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

বিবেক ও বিবেচনা জীবনের শক্তি

পঞ্চইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সাধারণ জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। এই দুয়ের সমন্বয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞানের বিকাশ হলে মানুষের প্রজ্ঞা, আত্মজ্ঞান বা পান্ডিত্য লাভ হয়। পঞ্চইন্দ্রিয়ের বিকাশের জন্য তিনটি মৌলিক চাহিদার প্রয়োজন-পরিবেশ বা পরিপার্শ্বিকতা, পরিচর্যা এবং শিক্ষা। যদি পরিবেশের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখব সাধারণ জ্ঞান অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। অথবা অনেকগুলো বিষয়ের সমন্বয়ে গঠিত হয়। যেমন নিজের ঘরের পরিবেশ, স্কুলে শিক্ষক ও সহপাঠীর আচরণ, কর্মক্ষেত্রে সিনিয়রদের সহযোগিতা, সহানুভূতি এবং অধঃস্তনদের সম্মানজনক আচরণ, সুপারভাইজার নামক একশ্রেণির কর্মকর্তার অসংযত আচরণ অধঃস্তনদের স্নাুয়ুবিক চাপে রাখায় অনেকেই মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নৃশংস ঘটনা শিশুর মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হয়। বিপথগামী করে তোলে। কয়েক বছর আগে আমেরিকান একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, শুধু টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একটি ছেলে বা মেয়ে ১৮ বছর বয়স পূর্ণতা প্রাপ্তির আগে দুই লাখ নৃশংস ঘটনা অবলোকন করে, যা তাকে শুধু মানসিকভাবে অসুস্থ করে। কখনো কখনো বিপথগামী ও হিংস্র করে তোলে। পরিবারের সাংস্কৃতিক চিত্র, ধর্মীয় ঐতিহ্য, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সামাজিক পরিবেশ সর্বোপরি রাজনৈতিক আবহাওয়া এবং সামগ্রিকচিত্র একজন মানুষের মানবিকতা বিকাশে প্রচন্ড ভূমিকা রাখে। উপরোক্ত কারণগুলোয় যে কোনো একটার অসম প্রভাব মানুষের নৈতিকতা বিকাশের অন্তরায় হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে স্কুল শিক্ষকদের শিক্ষা অনন্তকাল স্নায়ুতন্ত্রে বহমান থাকে। এর প্রভাব কখনো মূল্যায়ন করা যায় না। পুষ্টি এবং পরিচর্যা ও পঞ্চইন্দ্রিয়কে প্রস্ফুটিত করতে বিশেষ জোরালো ভূমিকা রাখে। অপুষ্টি এবং অপরিচর্যায় শিশু ছোটবেলা থেকেই, অপুষ্টিজনিত রোগ রাতকানা, কানে কম শুনতে পাওয়া, রিকেট, হাড়ের গঠনে ব্যর্থতা, প্রোটিন স্বল্পতার রোগ-ব্যাধি সর্বোপরি মগজ বা স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশের ব্যর্থতা নিয়ে বাড়তে থাকে। আমাদের দৈহিক গঠনে যেমন খাদ্য দরকার, তেমনি মানসিক বিকাশের জন্য সুস্থ চিন্তার প্রয়োজন। সুস্থ চিন্তাই এখানে খাদ্য। আমরা যদি আমাদের দেহে অপুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করি এবং মনে খারাপ চিন্তা লালন করি তাহলে অবশ্যই আমরা অসুস্থ মন এবং দেহের অধিকারী হব। অপ্রিয় হলেও সত্য, সমাজে এখন ভেজাল খাবার এবং অসুস্থ চিন্তাধারার প্রবাহই বেশি হচ্ছে।

পরিবেশ সুন্দর রাখা, মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের জন্য উল্লিখিত উপাদানগুলো অতীব জরুরি। আর এদের সমন্বয়েই সৃষ্টি হয় সংস্কৃতি। সুস্থ সংস্কৃতির নজির হলো যখন আপনি কোনো পরিবার বা দোকানে যাবেন দেখবেন সেখানে সব সদস্যই ভদ্র, বন্ধুবৎসল। উল্টোতে গেলে পাবেন অভদ্র ও অনমনীয় ব্যবহার। কোনো কোনো বাসায় গেলে দেখবেন মা-বাবা, সন্তান, দাদা-দাদি খুবই ভদ্র, মার্জিত এবং বিবেচক। অন্য পরিবারে পাবেন ঠিক উল্টোটা। এমনকি যেসব দেশে সরকার এবং রাজনৈতিক পরিবেশ যখন সৎ থাকে, সেখানে জনগণ আইন মেনে চলে। আফ্রিকার যেসব দেশে সরকার এবং রাজনীতি কুলষিত সেখানে জনগণও অসৎ পথের আশ্রয় গ্রহণ করে। সেসব দেশে আইন হীনতা যখন আইন হয় তখন সৎ নাগরিক প্রতারক হতে বাধ্য হয়।

শিক্ষাও মানুষকে প্রচন্ডভাবে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন করে তুলতে পারে। শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক অথবা পারিবারিক হতে পারে। বর্তমান বিশ্বে আমরা তথ্য ও প্রযুক্তির সাগরে ডুবে যাচ্ছি কিন্তু জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দক্ষতার জন্য হাহাকার করছি। অথচ পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা জীবনকে লক্ষ্যভেদ করতে শেখায়। মানুষ কোন পরিবেশে ভালো বা খারাপভাবে বেড়ে ওঠে সেটাই তার মজ্জাগত হয়। এই অভ্যাস পরিবর্তনে মানুষের চরিত্র এবং মানসিক শান্তি প্রচন্ডভাবে বাধা দেয়। তাদের কাছে অভ্যাস পরিবর্তন অস্বস্তিদায়ক। অভ্যাস পরিবর্তনের ফলাফল ভালো হোক বা খারাপ হোক তা যন্ত্রণাদায়ক। অসুস্থ বা অসহায় পরিবেশটা অনেক সময় এত সুন্দরভাবে খাপ খাইয়ে নেয় নিজের জীবনের সঙ্গে, দেখা যায় সুন্দর, সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে সে খাপ খাওয়াতে পারে না। পরিবেশ সম্পর্কে  Charles Dickens -এর একটি বাস্তব গল্পে পড়েছিলাম। একজন অপরাধীকে তার অপরাধের জন্য দীর্ঘমেয়াদি জেল দেওয়া হলো। জেলে তাকে এক নির্জন অন্ধকূপে রাখা হলো। কারাদন্ড ভোগ শেষে মুক্তি পেয়ে যখন সে স্বচ্ছ দিবালোকে মুক্ত পৃথিবীতে বেরিয়ে এলো, কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে এত বিরক্তিকর অনুভব করল, তাকে অন্ধকূপে ফেরত নেওয়ার অনুরোধ জানাল। ইতিমধ্যে, হাতে শিকল এবং নির্জন জেল তার কাছে নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক হয়ে যায়। দীর্ঘ কারাবাসের কারণে সে কোনো অবস্থায় মুক্ত বায়ু, স্বচ্ছ দিবালোক, গাড়ি-ঘোড়া, জীবজন্তু এবং প্রচুর মানুষের সমারোহ সহ্য করতে পারেনি। অনেক সময় এ ধরনের অপরাধীরা পুনরায় অপরাধ করে শুধু জেলখানায় যাওয়ার জন্য। তাই শুধু জেলখানা বা সংশোধনাগারে পাঠিয়ে শাস্তিভোগ করতে দিলেই অপরাধী সংশোধিত হয় না। জেলখানাতে কয়েকদিকে বিভিন্ন ধরনের কাজ-কর্ম, সুযোগ-সুবিধা, আনন্দ-বিনোদন এমনকি মাঝে মাঝে কড়া পুলিশ প্রহরায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা পরিদর্শনের সুযোগ এবং মনস্তত্ত্ববিদগণের সাহায্যে তাদের মানসিক শক্তি প্রদান এবং দুর্বলতাগুলোর চিকিৎসা প্রদান অত্যাবশ্যক। অর্থাৎ পরিবেশ মানুষের দেহ ও মনের ওপর ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে অভ্যস্ত করে তোলে। স্নায়ুতন্ত্রের এবং হৃদয়ের ওপর, ভালো শিক্ষাচর্চা ও প্রশিক্ষণ মানুষকে চরিত্রবান তৈরি করতে পারে। দৃঢ় চরিত্র সাধারণত ভালো ব্যবহার দেওয়া নেওয়া এবং সুস্থ পরিবেশ এবং নিয়মানুবর্তিতার ওপর নির্ভরশীল। পঞ্চইন্দ্রিয়ের সুচর্চা এবং সাধারণ জ্ঞানের সৎ ব্যবহারই পারে শুধু বিবেকবান মানুষ তৈরি করতে। গঠনমূলক জ্ঞানের বিকাশ ঘটাতে। বিবেক ও বিবেচনা জীবনের শক্তি।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর