রবিবার, ৭ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের রোজনামচায় ৭ জুন, ১৯৬৬

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের রোজনামচায় ৭ জুন, ১৯৬৬

১৯৬৬ সালের ৭ জুন আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে; ইতিহাসে তার স্থান হয়েছে নিতান্ত দায়সারা গোছের। অথচ এই ৭ জুন ছিল বাঙালির ইতিহাসে একটি দিক পরিবর্তনের দিন- কারও কারও মতে স্বাধীনতার শপথের চূড়ান্ত দিন। বঙ্গবন্ধুর জীবনে তা ছিল ৬ দফারূপী স্বাধীনতা সেতু পারাপারের প্রথম ও সশস্ত্র প্রয়াস। বঙ্গবন্ধু ৮ মে ১৯৬৬ থেকে ৬ দফার কারণে কারায় নীত হলেন। আমরা দেখছি বঙ্গবন্ধু তার কারাগারের রোজনামচা লিখতে থাকেন ২ জুন ১৯৬৬ সালে এবং প্রথম দিনের লেখাতেই ছয় দফা দিবস বা ৭ জুন প্রসঙ্গ এসেছে। তিনি লিখেছেন, ‘ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম রাতে কয়েকজন গ্রেফতার হয়ে এসেছে। বুঝতে বাকি রইলো না আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের নিয়ে এসেছে, ৭ জুনের হরতাল বানচাল করার জন্য।’ বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে কিন্তু তারই নির্দেশে দিবসটিকে ছয় দফা দিবস আখ্যায়িত করে তা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পালনের সিদ্ধান্ত নিলে আইয়ুব-মোনায়েম সরকার আওয়ামী লীগ দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার শুরু করে এবং একই সঙ্গে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, মাইক্রোফোনের অনুমতি না দেওয়াও চলছিল। বঙ্গবন্ধু একাকী জেলের কোণে সিপাহী বা কারারক্ষীদের কানাঘুষা, ইত্তেফাক, আজাদ ও অবজারভার পত্রিকা থেকে আসা সংবাদে যা পাচ্ছেন তাতেই উৎকন্ঠায় উদ্বেলিত প্রহর কাটাচ্ছেন। ১২-১৩ জনের আগমনের কথা শোনা গেল। পরে জানা গেল দুজন ছাড়া বাকি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বা ঢাকা শহরের শীর্ষ নেতা। ঢাকা জেলে সবচেয়ে খারাপ জায়গায় ১০ নম্বর সেলে যাদের রাখা হয়েছে তারা হলেন আবদুল মোমেন অ্যাডভোকেট, প্রচার সম্পাদক, আওয়ামী লীগ; ওবায়দুর রহমান, সাংস্কৃতিক সম্পাদক; হাফেজ মুছা, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি; মোস্তফা সরওয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি; শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, সহ-সভাপতি, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ; রাশেদ মোশাররফ, সহ-সম্পাদক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ; আওয়ামী লীগ কর্মী হারুনুর রশিদ ও জাকির হোসেন।

তিনি আরও লিখেছেন ‘ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় পুলিশ বাহিনী নিজেই দিনের বেলায় ৭ জুনের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে। ঢাকা ও অন্যান্য জায়গা তো করছেই।’ কাগজ পড়ে তিনি জেনেছেন ন্যাপের মশিউর রহমান যাদু মিয়া প্রকাশ্যে ছয় দফার বিপক্ষে নেমেছেন, সঙ্গে আসছেন তার নেতা মওলানা ভাসানী। রোজনামচায় তাদের স্বরূপটা তিনি খানিকটা তুলে ধরেছেন। ৭ জুন পালিত হবে বলে তিনি আশ^স্ত হলেন কেননা জনগণের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। মিজান চৌধুরী দলের হাল ধরায় তিনি আরও একটু আশ্বস্ত হলেন। পরদিন ৩ জুন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শামসুল হক সাহেব ও আওয়ামী লীগের সদস্য নন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধাচরণ করেছে জীবন ভরে, নাম আবদুল মাজেদ সর্দারকে জেলে আনা হলেও বিকাল গড়ানোর আগেই শেষোক্ত জনকে সংগত কারণেই ছেড়ে দেওয়া হলো।

খবরের কাগজে যৎসামান্য খবরাখবর যা আসছে তাও যেন পড়তে না পারা যায় তজ্জন্য কালি দিয়ে মুছে দেওয়া হয়েছে। ৩ তারিখে গভর্নর মোনায়েম খানের আজীবন গণবিরোধী অবস্থান ও দালালির প্রসঙ্গ নিয়ে তার কিছু তির্যক বক্তব্য আছে। 

৪ জুন জাতীয় পরিষদে ‘সরকারি গোপন তথ্য সংশোধনী বিল’ আনা হয়েছে, যা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে বলে বঙ্গবন্ধু আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সে তারিখে তিনি লিখেছেন “ইত্তেফাক দেখে মনে হলো ৭ জুনের হরতাল সম্বন্ধে কোনো সংবাদ ছাপাতে পারবে না বলে সরকার হুমকি দিয়েছে। কিছুদিন আগে আরও হুকুম দিয়েছিল ‘এক অংশ অন্য অংশকে শোষণ করেছে এটা লিখতে পারবা না’। ছাত্রদের কোনো নিউজ ছাপতে পারবা না। আবার এই যে হুকুম দিলাম সে খবরও ছাপাতে পারবা না। এতদসত্ত্বে, বঙ্গবন্ধু আশ্বস্ত যে আওয়ামী লীগ কর্মীরা আর ছাত্র তরুণরা কাজ করে যেতেছে। বেপরোয়া গ্রেফতারের পরও ভেঙে পড়ে নাই দেখে ভালই লাগছে।”

৫ জুন তিনি লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেফতার করে চলেছে। আরও আটজন কর্মীকে গ্রেফতার করেছে বিভিন্ন জায়গায়। দমননীতি সমানে চালাইয়া যাচ্ছে সরকার; আওয়ামী লীগের কর্মীরা যথেষ্ট নির্যাতন ভোগ করেছে। ছয় দফা দাবি যখন তারা দেশের কাছে পেশ করেছে তখনই প্রস্তুত হয়ে গিয়াছে যে তাদের দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে হবে। এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়। জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সংগ্রাম। শেষের কথাগুলো তার শুধু মুখের বলা নয় মনের কথাও ছিল। তার ঘনিষ্ঠ কর্মীরা সেই ১৯৬১ সাল থেকেই জেনে নিয়েছে।’ ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টের ছায়াতলে তিনি স্বাধীনতার পথে চলেছেন এবং প্রয়োজনে সশস্ত্র পন্থায়, একই অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেন ‘যথেষ্ট নির্যাতনের পরেও আওয়ামী লীগ কর্মীরা দেশের আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নাই। তবুও পোস্টারগুলো পুলিশ দিয়ে তুলে ফেলা হচ্ছে। ছাপানো পোস্টার জোর করে নিয়ে যেতেছে সরকারি কর্মচারীদের দিয়ে।’

এই তারিখে তিনি মোনায়েম খানের আগের কিছু কুকীর্তি ও কুকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। মোনায়েম খান সে ব্যক্তি যিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি যতদিন গভর্নর (বঙ্গবন্ধুর ভাষায় সুবেদার) থাকবেন ততদিন মুজিবকে জেলে থাকতে হবে। একই দিনে তিনি লিখেছেন “কিছু সংখ্যক শ্রমিক নেতা যারা সত্যই শ্রমিকদের জন্য আন্দোলন করে তারাও নিশ্চয় সক্রিয় সমর্থন দেবে। এত গ্রেফতার করেও তাদের দমাইয়া দিতে পারে নাই। ৭ই জুন হরতালের জন্য তারা পথসভা ও মিছিল বের করেই চলেছে। পোস্টার ছিঁড়ে দিলেও নতুন পোস্টার লাগাইতেছে। প্যামফ্লেট বাহির করছে। সত্যই আমি এতটা আশা করতে পারিনি। ডায়েরিতে আরো উল্লেখ আছে ‘মাথার ভিতর শুধু ৭ই জুনের চিন্তা’।”  

৬ জুন লিখলেন ‘আগামীকাল ধর্মঘট, পূর্ব বাংলার জনগণকে আমি জানি। হরতাল তারা করবে। রাজবন্দীদের মুক্তি তারা চাইবে। ছয় দফা সমর্থন করবে।’

তিনি গোলমালের আশঙ্কা করছেন। একই দিনে আরও লিখলেন ‘ধরপাকড় চলছে সমানে, কর্মীদের গ্রেফতার করছে। যশোর আওয়ামী লীগ অফিস তল্লাশি করছে।’ এ সব ব্যাপারে প্রতিবাদ সপক্ষীয় মশিউর রহমান এবং গণধিকৃত একজনের নামও তিনি উল্লেখ করেছেন। আরও লিখেছেন ‘৯ জন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিও ধরপাকড়ের তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছে এবং তাদের মুক্তি দাবি করিয়াছেন। আওয়ামী লীগ, শ্রমিক, ছাত্র ও যুবকর্মীরা হরতালের সমর্থন করে পথসভা করেছে। মার্শাল শোভাযাত্রাও বের করেছে। শত অত্যাচার ও নির্যাতনেও কর্মীরা ভেঙে পড়ে নাই। আন্দোলন চালাইয়া চলেছে’। তিনি আরও জানান দিচ্ছেন যে ‘সরকার কর্মীদের বন্দী করেও অত্যাচার করেছে। ২৪ ঘণ্টা তালাবদ্ধ করে রেখেছে জেলের মধ্যে।’ এ কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন যে শীর্ষ নেতাদের ‘সি’ ক্লাস-এ রাখা হয়েছে। কতিপয় পত্রিকার সাহসী ভূমিকাকেও তিনি প্রশংসা করেছেন। তারপর এলো ৭ জুন, ১৯৬৬। দিনটি ছিল মঙ্গলবার।

 

৭ জুন সম্পর্কে তার লেখায় দেখা যাচ্ছে যে তিনি মোনায়েম যার কথাবার্তা নিয়ে উৎকন্ঠিত- গোলমালের গন্ধ পাচ্ছেন। লিখেছেন ‘কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে খবর আসলো দোকানপাট, গাড়ি, বাস, রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলেছে। এই সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাইতেছে।’ ‘আবার সংবাদ পাইলাম পুলিশ আনসার দিয়ে ঢাকা শহর ভরে দিয়েছে। আবার খবর এলো টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে। লাঠিচার্জ করছে সমস্ত ঢাকায়।’ কিছু লোক গ্রেফতার হয়ে জেলের অফিসে এসেছে তার মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চাই বেশি। রাস্তা থেকে ধরে এনেছে। ১২টার পর খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে। ‘জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয় দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তিস্বাধীনতা চায়, শ্রমিকদের ন্যায্যা দাবি, কৃষকের বাঁচার দাবি তারা চায়। এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যেই হয়ে গেল।’ ‘বিকালে শুনলাম গুলি হয়েছে, কিছু লোক মারা গেছে। অনেক লোক জখম হয়েছে, মেডিকেল হাসপাতালেও একজন মারা গেছে। ১৪৪ ধারা জারি না করেই গুলি চালানোর কথা তিনি শুনলেও কিছু পরে জানলেন ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে, মিটিং হতে পারবে না। কিছু জায়গায় টিয়ার গ্যাস মারছে সে খবর পাওয়া গেল।’ ‘বিকালে আরও বহু লোক গ্রেফতার হয়ে এলো। প্রত্যেককে কমবেশ এক মাস, দুই মাস সাজা ও জেল দেওয়া হয়েছে। নিরীহ মানুষকে সাজা ও জেল ভুগতে হলো। এবারে তিনি লিখলেন ‘সমস্ত দিনটা পাগলের মতোই কাটলো আমার’। তালাবদ্ধ হওয়ার আগে খবর পেলাম নারায়ণগঞ্জ, তেজগাঁও, কার্জন হল ও পুরনো ঢাকার কোথাও কোথাও গুলি হয়েছে। তাতে অনেক লোক মারা গেছে। সত্য মিথ্যা, গুজব ছড়িয়ে গেছে চারদিকে। আরও লিখলেন ‘তবে হরতাল যে সাফল্যজনকভাবে পালন করা হয়েছে সে কথা সকলেই বলছে। এমন হরতাল নাকি কোনো দিন হয় নাই। গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেছে।’ ‘শুধু পাইপই টানছি- যে এক টিন তামাক বাইরে ছয় দিনে খাইতাম, সে টিন এখন চার দিনে খেয়ে ফেলি। নানা ভাবনায় মনটা আমার অস্থির হয়ে রয়েছে’। দলের কর্মী, ছাত্ররা ও শ্রমিকরা যে আন্দোলন চালাইয়া যাইতেছে সে জন্য তিনি তৃপ্তির সঙ্গে সঙ্গে লিখলেন “আমি দিব্য চোখে দেখতে পেলাম ‘জয়’ আমাদের অবধারিত। কোনো শক্তি আমাদের দমাতে পারে না।” অনেক রাত হয়ে গেল, ঘুম তো আসে না। শুধু চিন্তা এসে পড়ে। এ এক মহাবিপদ। বই পড়ি, কাগজ উল্টাই, কিন্তু তাতে মন বসে না। তারপরই তিনি দৈনিক আজাদ, পাকিস্তান, অবজারভার ও মিজান চৌধুরী প্রদত্ত বিবৃতিটির প্রশংসা করলেন।

৮ জুন প্রায় তিনশত লোককে সকাল ৮টা পর্যন্ত জেলে আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয় বছর বয়স থেকে ৫০ বছরের লোকও আছে। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে মা মা করে কাঁদছে। সমস্ত দিন এদের কোনো খাবার বা আহতদের কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। কিছু সংখ্যক স্কুলের ছাত্রও আছে। দিনভরই লোক আনছিল অনেক। তাদের ভালো মন্দ উভয় প্রকার ব্যবহার করলেও বঙ্গবন্ধু নির্যাতনকারীদের হুমকি দিলেন। মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাদের বিভিন্ন মেয়াদের সাজাও দেওয়া হলো। অন্যত্র উল্লেখ করেছেন ‘এরা জেলে আসার পরে খবর এলো ভীষণ গোলাগুলি হয়েছে। অনেক লোক মারা গেছে তেজগাঁও ও নারায়ণগঞ্জে। সমস্ত ঢাকা শহরে টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে। লাঠিচার্জও করেছে। তেজগাঁওয়ে ও কার্জন হলে মানুষ মারা গেছে বলে তিনি জেনেছেন। নিজের মনের অবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবে ‘মেটের পীড়াপীড়িতে নাশতা খেতে বসেছিলাম, খেতে পারি নাই, দুপুরে ভাত খেতে বসেছি, একই অবস্থা।’ খবরের কাগজের জন্য দীর্ঘ সময় বসে যা পেলেন তা হলো প্রেস নোট যা ইত্তেফাক, আজাদ ও অবজারভার পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। ইত্তেফাক মাত্র চার পৃষ্ঠা। কোনো জেলার কোনো সংবাদ নাই। প্রতিবাদ দিবস ও হরতাল যে পুরোপুরি পালিত হয়েছে বিভিন্ন জেলায় সে সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ রইল না। নিজস্ব কোনো খবর ছাপাতে দেয়নি সরকার। তবে সরকারি প্রেস নোটেই স্বীকার করা হয়েছে পুলিশের গুলিতে দশ জন মারা গিয়েছে। আরও বলেছে, ‘আত্মরক্ষার জন্যই পুলিশ গুলিবর্ষণ করতে বাধ্য হয়।’ মৃতদের পরিবার-পরিজনের কি হবে এ কথা ভেবে বঙ্গবন্ধু ভীষণ ভেঙে পড়েছেন। কিছুতেই মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছিলেন না। সঙ্গে মন্তব্য জুড়ে দিয়েছেন। 

‘তবে এদের ত্যাগ বৃথা যাবে না। এই দেশের মানুষ তার ন্যায্যা অধিকার আদায় করবার জন্য যখন জীবন দিতে শিখেছে তখন জয় হবেই, কেবলমাত্র সময় সাপেক্ষ। শ্রমিকরা কারখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কৃষকরা কাজ বন্ধ করেছে। ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে। ছাত্ররা স্কুল-কলেজ ছেড়েছে, উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক শ্রেণি আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরিব জনসাধারণকে শোষণ করতে পারবে না। বিশেষ করে ৭ জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামগঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ফেটে পড়েছে, কোনো শাসকের চক্ষু রাঙানি তাদের দমাতে পারবে না।’

তিনি ভাষা আন্দোলনের জীবন দানকারীদের কথা স্মরণ করলেন এবং এবারের শহীদদের আত্মদান বৃথা যাবে না বলে আত্ম প্রত্যয়ী হয়ে তাদের জন্যে দু’হাত তুলে মোনাজাত ধরলেন। এবারে ‘মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দিব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাব। যা কপালে আছে তাই হবে। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে।’ ৮ জুনের বর্ণনা বেশ দীর্ঘ যাতে উল্লেখ আছে শত শত মানুষের গ্রেফতার, গ্রেফতারদের নির্যাতনের চিত্র, আহতদের দুরবস্থা, না খেয়ে রাখার করুণ দৃশ্য, মারপিটের কাহিনী, বিনা চিকিৎসায় আহতদের আর্তনাদ, হাকিম বাহাদূরের যথেচ্ছাচার, জেলখানার গুটিকয়েক কয়েদির দুর্ব্যবহার। সাধ্যমতো বঙ্গবন্ধু এসবের প্রতিবাদ করলেন। ৯ তারিখে সরকার স্বীকার করেছে যে আহতদের মধ্যে আরও একজন মারা গেছেন।

বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন তুলেছেন ‘১১ জন মারা গেছে না অনেক বেশি মারা গেছে?’ এ প্রশ্ন এদেশের মানুষও করেছে। এক বর্ণনায় হাজারখানেক নিহতের খবর এসেছে। এত বছর পর ছয় দফা দিবসের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আমাদের চাই। এর উৎস হতে পারে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাগারের রোজনামচা’। এ ছাড়া কিছু লেখালেখি তো এখানে সেখানে অনাদরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যেগুলোকে বিবেচনায় নিলে বাঙালির ইতিহাসের এই মহা তাৎপর্যময় দিবসের পূর্ণাঙ্গ চিত্র ফুটে উঠতে পারে।

লেখক : উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর