সোমবার, ৮ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

মমতার করোনা জয়ের চ্যালেঞ্জ

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মমতার করোনা জয়ের চ্যালেঞ্জ

করোনা যখন অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও দ্রুত ছড়াচ্ছে ঠিক সেই সময় চলতি মাসের মাঝামাঝি কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে আছড়ে পড়ে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। কলকাতায় একাধিক প্রান্তে ৯০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়েছিল এই ঝড়। মমতা ব্যানার্জি এখন করোনা বা আম্ফানের দিকে যত না গুরুত্ব দিচ্ছে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ এবং টাকা রোজগারের ওপর। এমনকি করোনা আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলেও এখনো পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্রসচিব মুখ্যসচিবকে দিয়ে বলাচ্ছেন, এরা অন্য রোগে মারা গেছেন। নিজেও তাই বলেছেন প্রথম প্রথম। তার নির্বাচনী কৌশলী তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কলকাতাসহ জেলায় জেলায় গ্রামগঞ্জে পোস্টার, হোর্ডিং, প্লেক্স, ব্যানার দিয়ে আমি বাংলার গর্ব তা প্রচার করতে। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেসের ঘর ভেঙে বিজেপিতে যোগ দিয়ে বাজপেয়ি মন্ত্রিসভায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন। তখন তিনি সদর্পে বলেছিলেন মহাত্মা গান্ধী হত্যাকারী আরএসএস একটি সংগঠিত দল। জাতীয়তাবাদী সংগঠন। উত্তরে বহুদর্শী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ওরা বর্বর। ওরা বাবরি মসজিদ ভেঙেছে। ওরা খুন ছাড়া আর কিছুতে বিশ্বাস করে না। বিজেপিও মমতাকে ঘাঁটাচ্ছে না, তার অন্যতম কারণ ভোটব্যাংক। আগামী বছর মাঝামাঝি সময় পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হবে। দিল্লির একজন বাঙালি সাংবাদিকের মাধ্যমে অমিত শাহর সঙ্গে প্রতিদিনই তিনি অধিক রাতে সলাপরামর্শ করেন। তার একটাই উদ্দেশ্য বিরোধী কংগ্রেস ও সিপিএমকে খতম করা। সে জন্য তার প্রচুর টাকার দরকার। আম্ফানের পরের দিনই প্রধানমন্ত্রী উড়ে এসেছিলেন। আম্ফান মোকাবিলার জন্য তাকে ১১ হাজার কোটি টাকা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাঠিয়েও দেন। সেই সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্ত হাজার হাজার মানুষকে কীভাবে সাহায্য করা হবে তার প্রধান পরামর্শদাতা হলেন তার ভাতুষ্পুত্র অভিষেক ব্যানার্জি। এটা লুকানো কোনো খবর নয়। এটা গোটা বাংলার সব মানুষই এখন জেনে গেছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাতে কোনো গাছ কাটার ইলেকট্রিক করাত নেই এই খবর পেয়ে পাশের রাজ্য উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন আট্রনায়ক তার রাজ্য থেকে বিপর্যয় মোকাবিলায় বাহিনী পাঠান। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় ৯০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না আসা নিয়ে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে বঙ্গেশ্বরী আরও ক্ষেপে লাল হয়ে যান। দুই বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ বুলবুল ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। গত মাসেই কেন্দ্রীয় সরকার সে বাবদ ১০ হাজার কোটি টাকা পাঠিয়েছিল। তার মধ্যে কত টাকা খরচ হয়েছে, মোদি ও অমিত শাহর মতোই তিনি বলছেন, আমি কোনো হিসাব দেব না। অথচ বিপদের মধ্যে রয়েছেন রাজ্যের লাখো লাখো মানুষ। ৯৬ ঘন্টা ধরে দুর্গত এলাকার মানুষ খাবার, বিদ্যুৎ কিছুই পায়নি। সামরিক বাহিনী এবং উড়িষ্্যার বিশেষ বাহিনী না এলে এখনো পশ্চিমবঙ্গের অবস্থার উন্নতি হতো না। কারণ সে ক্ষমতা মমতা সরকারের হাতে নেই। উত্তেজিত বঙ্গেশ্বরী বিদ্যুৎ পানি না থাকার জন্য দায়ী করে কলকাতার ইলেকট্রিক সাপ্লাই করপোরেশনের ঘাড়ে যাবতীয় দায়িত্ব চাপিয়ে দেন। দিল্লির বিদ্যুৎমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রতিটি মানুষ জানেন, সিবিএসসি প্রধানমন্ত্রীর গোয়েন্দা এতই তার ঘনিষ্ঠ যে যখন মমতা ক্ষমতায় আসেননি, তখন মমতার আঁকা ছবি তিনি কোটি কোটি টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। এ ঘটনার মধ্যেই স্যার আশুতোষের বম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি চিত্তঘোষ মুখোপাধ্যায় এবং প্রাক্তন বিচারপতি শ্যামল সেনসহ আরও বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী ৯৬ ঘণ্টার বিদ্যুৎ না থাকার জন্য মমতাকে দায়ী করে বলেছিলেন, বম্বে, দিল্লি, চেন্নাইর মতো মেট্রো শহরে বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট বিক্রি হয় তিন টাকা। আর মমতার রাজ্যে তা বিক্রি হয় ৮ টাকায়। এ ব্যাপারে মমতা সঞ্জীবের গত ৯ বছরের  এক গোপন চুক্তি আছে। সে চুক্তি ফাঁস করে দিয়েছেন সন্ময় ব্যানার্জি। সন্ময় বলেছেন, ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতের দাম পশ্চিমবঙ্গে। বিচারপতিদের দাবি, অবিলম্বে ঘোষণা করা হোক বিদ্যুতের দাম নেওয়া হবে না। টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাবেক সহযোগী সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক তরুণ গাঙ্গুলী মনে করেন, মমতার চিন্তা-ভাবনা, বিদ্যাবুদ্ধিতে কোথাও একটা ফাঁক থেকে গেছে। সে কারণেই তিনি সমালোচনাকে ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন। যত দোষ নন্দঘোষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে থাকেন।

সাম্প্রতিককালে তার মেজাজ এতটাই উচ্চগ্রামে পৌঁছেছে যে সাংবাদিক বৈঠকে তিনি পুলিশকে ডেকে বলেন, ওমুক সাংবাদিককে নবান্নে ঢুকতে দিও না। শুধু এখানেই শেষ নয়। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় সংবাদ মাধ্যমের ওপর যেভাবে হামলা চালিয়েছিলেন মমতা তার থেকে অনেকটাই এগিয়ে গেছেন।

সিদ্ধার্থ শঙ্কর জরুরি অবস্থার সময় যে সাহস পাননি, মমতা তাই করে দেখিয়েছেন। আর এক বছর পর শতবর্ষে পা দেবে আনন্দবাজার পত্রিকা। বিধান রায়, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু যা করেননি, মমতা তাই করে দেখিয়েছেন। বিজ্ঞাপন বাবদ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে আনন্দবাজারের পাওনা প্রায় ১২০ কোটি টাকা। শনিবার (৩০ মে) আনন্দবাজারের সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়কে হেয়ারস্ট্রিট থানায় ডেকে নিয়ে ৬ ঘণ্টা জেরা করা হয়। পুলিশ ওই ৬ ঘণ্টা জেরাকালে অনির্বাণ বাবুকে কী বলেছেন, তা জানা যায়নি। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা পুলিশ তাকে প্রশ্ন করেছে করোনা ও আম্ফান নিয়ে দিদির এত সমালোচনা করছেন কেন? আনন্দবাজারের নীতি ছিল জনগণের স্বার্থে সত্য ঘটনা লিখবে। মমতার ধমকের কাছে আনন্দবাজার সিটিয়ে যাবে না। এটাই ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা। সিপিএমের ৩৪ বছরের রাজত্বকালে সংবাদপত্রে সমালোচনা করলে জ্যোতি বাবু কোনো দিন কোথাও সম্পাদককে ডেকে পাঠাননি। পশ্চিমবঙ্গের এই আপৎকালে সব কিছু ভুলে টাকার জন্য ছুটে চলেছেন মমতা। তার একমাত্র লক্ষ্য আগামী বছর ভোটে জিতে ক্ষমতা দখল করে রাখা। আর তার জন্য চাই কোটি কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহদের ধরে রেখে এবং কোটি কোটি টাকা খরচ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন? এ প্রশ্ন তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ থেকে বিশিষ্টজনরা।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর