মঙ্গলবার, ৯ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

সাংবাদিক সম্প্রদায় কেন বঞ্চনার শিকার

শামা ওবায়েদ

সাংবাদিক সম্প্রদায় কেন বঞ্চনার শিকার

গণমাধ্যম গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা। আজকের দিনে দুনিয়াজুড়ে জনমত ও শক্তিশালী সমাজ গঠন এবং তার আদল গড়তে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট দুই ধারার গণমাধ্যমের ভূমিকাই অনবদ্য। সাংবাদিকরা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক তোষণনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করেন এবং এগুলোর বিরুদ্ধে বিরামহীন প্রচার চালিয়ে থাকেন। মানবিক সংকট হোক, কভিড-১৯ এর মতো মহামারী হোক, বিশ্ব রাজনীতি হোক কিংবা বহুপক্ষীয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হোক; সর্বক্ষেত্রেই অসদাচরণের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ রক্ষার পর্যবেক্ষক হিসেবে ভূমিকা পালন করে গণমাধ্যম। একই সঙ্গে তৈরি করে জনসচেতনতা। বর্তমানে সারা দুনিয়ার সাংবাদিকরা দিন-রাত করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী কাভার করছেন। সেল্ফ-কোয়ারেন্টাইনে থেকে এসব ঘটনা কাভার করতে পারেন না তারা। আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই তারা মাঠে যাচ্ছেন। কভিড-১৯ কাভারের জন্য বিশ্বের সাংবাদিকদের জন্য বিস্তারিত পরামর্শ দিয়েছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)। এতে অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার আগে নেওয়া প্রস্তুতি, আক্রান্ত এলাকাতে গিয়ে সংক্রমিত না হওয়ার টিপস, ভ্রমণ পরিকল্পনা আর অ্যাসাইনমেন্ট পরবর্তী সতর্কতাও রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা আক্রান্ত হওয়া থেকে সুরক্ষা পাচ্ছেন খুব কম। বর্তমানে মানুষের বিশ্বাসযোগ্য এবং যাচাই করা খবর প্রয়োজন আর ভবিষ্যতে এর প্রয়োজনীয়তা আরও বাড়বে। বাংলাদেশ সরকারের অভিযোগ এই মহামারীর মধ্যে কেউ কেউ ‘গুজব’ ছড়াচ্ছে। এর যদি কোনো সত্যতা থেকে থাকে তাহলে সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে আরও বেশি শক্তিশালী এবং প্রস্তুত করে তুলতে হবে যাতে তারা মাঠে নামতে পারে এবং আরও নির্ভুল তথ্য এ দেশের মানুষের জন্য সংগ্রহ করতে পারে। এখন পর্যন্ত সারা দেশে কয়েকজন সম্পাদকসহ একশোরও বেশি সাংবাদিক কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকাতেই আক্রান্ত হয়েছেন ৮৯ জন। আক্রান্ত সাংবাদিকরা ৪৭টি জাতীয় ও আঞ্চলিক মিডিয়া হাউসের কর্মী। এর মধ্যে ২২টি সংবাদপত্র, ১৯টি টেলিভিশন চ্যানেল, চারটি নিউজ পোর্টাল, দুটি রেডিও চ্যানেল ও একটি বার্তা সংস্থা রয়েছে। কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত দুই সাংবাদিকের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে আর ২৪ সাংবাদিক পুরোপুরি সুস্থ হয়েছেন। গণমাধ্যমের জন্য করোনাভাইরাস কোনো একশো মিটারের দৌড় প্রতিযোগিতা নয় বরং একটা ম্যারাথন লড়াই। আর নিরাপদে শেষ সীমায় পৌঁছাতে হলে আমাদের সাংবাদিকদের সুস্থ এবং স্বাস্থ্যবান থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মানুষের আরও বেশি প্রকৃত রিপোর্টিং প্রাপ্য আর তার অর্থ হলো লেখক ও সম্প্রচারকারীদের আরও বেশি ঝুঁকি নিতে হবে। যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ের মতো তাদের সামনের কাতারেই যেতে হচ্ছে আর বাকি দুনিয়ার মতো তাদেরও ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের মতো ঝুঁকি নিতে হচ্ছে। বহু সময় দেখেছি আমাদের সাংবাদিকরা জালিয়াতি, ঘুষ, দুর্নীতি আর খুন উন্মোচনের মধ্য দিয়ে বহু মানুষের প্রাণ রক্ষা করেছেন, সে কারণে এই মারাত্মক সংকটের সময়ে তাদের সুরক্ষা দেওয়াটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। চীনে ভাইরাসটির সন্ধান পাওয়ার পর পর্যাপ্ত সময় আমরা পেয়েছি। অথচ এখনো আমরা আক্রান্তদের মধ্যে যাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও ব্যবস্থা যথাযথভাবে করতে পারিনি। অব্যবস্থাপনা আর সমন্বয়ের অভাব স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে। সাংবাদিক, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী এবং পুলিশ সদস্যদের মতো সামনের কাতারের কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ পরিকল্পনা এবং যথাযথ সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব। বলার অপেক্ষা রাখে না সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে থেকে সংবাদ-প্রতিবেদন রচনা করা যায় না। আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও রিপোর্টারদের বাইরে যাওয়ার দরকার হয়। স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, আইন প্রয়োগকারী এবং অন্য জরুরি কর্মীদের মতো সাংবাদিকরাও বাংলাদেশে কভিড-১৯ মহামারীর শুরু থেকেই সামনের কাতারে ছিলেন। ঢাকার অনেক গণমাধ্যমই সংবাদকক্ষের কর্মীদের বাসা থেকে কাজ করতে বলেছে কিন্তু রিপোর্টারদের ক্ষেত্রে তার কোনো সুযোগ নেই, মহামারী কাভার করতে তাদের মাঠে যেতেই হয়েছে। শুরু থেকেই সারা দেশে আমাদের সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান, রিপোর্টাররা পুরোপুরি অবহেলার শিকার হয়েছেন আর এখনো হয়ে চলেছেন। আমাদের নিবেদিত গণমাধ্যম পেশাজীবীরা যেভাবে অবহেলিত হয়েছেন তাতে আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। আমরা জানি এই মানুষগুলোর সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে জনমতের অবয়ব গঠন এবং প্রকৃত ঘটনা সামনে আনার সক্ষমতা এবং ক্ষমতা রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সময়ে আমাদের প্রিয় স্বদেশের সাংবাদিকরা সব সময়ই এগিয়ে এসেছেন আর অগ্রবর্তী ভূমিকা রেখেছেন। আমাদের রিপোর্টাররা কখনোই প্রকৃত তথ্য তুলে আনতে ব্যর্থ হননি, তা সে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হোক, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় হোক কিংবা যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা হোক। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেশের সাংবাদিক সমাজ চরম ঝুঁকি নিয়েছেন। ওই সময়ে তারা ঝুঁকি নিয়েই ইত্তেফাক, পূর্বদেশ, সংবাদ, আজাদ, মর্নিং নিউজ ও পাকিস্তান অবজারভারের মতো দৈনিকের পাতায় ওই আন্দোলনের কাভারেজ দিয়েছেন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে এবং সমালোচনা করে নিয়মিত ব্যানার হেডলাইন করেছে দৈনিক ‘দ্য পিউপিল’। মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলা যোদ্ধা ও সমর্থকদের সাহস জোগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সম্প্রচারকেন্দ্র ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। মুক্তিযোদ্ধারা যখন পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করেছে তখন লাখ লাখ মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন জিইয়ে রেখে অন্যরকম আরেক লড়াই করেছেন রেডিও স্টেশনের কর্মীরা। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচন কিংবা অন্য যেকোনো আঞ্চলিক নির্বাচনেও এ দেশের জনগণ দেখেছে আমাদের সাংবাদিকরা নিরলসভাবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ ও পরিবেশন করেন। এ মুহূর্তে আমরা ভিন্ন ধরনের এক যুদ্ধে আছি। সামাজিক পটভূমি, বর্ণ, ধর্মবিশ্বাস, সম্পদ কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ নির্বিশেষে সব মানুষই এখন বিপদে। সেই কারণে এ মুহূর্তে আমাদের টিকে থাকতে সত্যিকার তথ্য ও পরিসংখ্যান জরুরি। আর এগুলো যারা সামনে আনছে সেই সামনের কাতারের কর্মীদের অবশ্যই সুরক্ষার প্রয়োজন। দুঃখজনকভাবে এসব সামনের কাতারের কর্মীরা বহুবার তাদের গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টিংয়ের কারণে হয়রানির শিকার হয়েছেন। ফেক নিউজ ও ভুল তথ্য ঠেকাতে কার্যকর হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করতে ব্যবহার হচ্ছে। এটা কেবল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য হুমকি নয় বরং একই সঙ্গে এগুলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের হুমকি।

সজল ভুঁইয়ার কথাই ধরা যাক। নরসিংদী জেলার এই সাংবাদিক করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ে চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে একটি রিপোর্টিংয়ের কাজ করছিলেন। গত ২৩ এপ্রিল (২০২০) তিনি এক ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে ভাইরাস আক্রান্তদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চান। ওই সময়ে সজল ভুঁইয়াকে নৃশংসভাবে পেটান নাসির উদ্দিন খানের সমর্থকরা; পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ রকম ঘটনা আরও ঘটেছে। কভিড-১৯ সংক্রান্ত খবর সংগ্রহের সময় সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় ইতিমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সাংবাদিক সুরক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার (আরএসএফ)।

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কোনো রোগের মহামারী মোকাবিলার ক্ষেত্রে ২০১৯ সালের বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ। জবাবদিহিতা, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ভূমিকা ও কর্মকান্ডের স্পষ্ট বিবরণের অভাব, অনিয়ম এবং স্বাস্থ্য খাতে অপর্যাপ্ত প্রস্তুতির পাশাপাশি দুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামো মিলে বাংলাদেশের মহামারী পরিস্থিতি ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে। যদিও আমরা আশা এবং প্রার্থনা করি এই মহামারী আমাদের প্রিয় স্বদেশে যতটুকু ছড়িয়েছে তার চেয়ে আর বেশি ছড়াবে না। গণমাধ্যমের আরও বেশি সদস্য আক্রান্ত হওয়ার আগে আমাদের সবারই সম্মিলিতভাবে কাজ করা দরকার। জাতির চোখ-কান মিডিয়ার প্রতি আচরণ নিয়ে সব রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর সোচ্চার হওয়া দরকার। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সব সময়ই গণমাধ্যম কর্মীদের সামনের কাতারের কর্মী এবং সরকারের কাছে তাদের প্রতিটি সদস্যের সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর বারবার জোর ও পরামর্শ দিয়েছে।

ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশেও গণমাধ্যম কর্মীদের নিরাপত্তা, জীবনের ঝুঁকি ও আর্থিক বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। কিন্তু ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সরকারের নানা দায়িত্বশীল জায়গা থেকেও সহযোগিতা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকরা বলছেন, তারা এই সহযোগিতা পাননি। আমরা খুব দ্রুত সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাই। এ কথাও ভীষণ ঐতিহাসিক যে, বিশেষত মহামারীকালে দল-মত-নির্বিশেষে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের কর্মীদের মূল্যায়ন করা হোক। আর এই মূল্যায়ন যেন অবশ্যই নিরপেক্ষভাবে আঞ্জাম দেওয়া হয়।

              লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর