বুধবার, ১০ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

ক্রাইস্টচার্চের ‘মাসকিলার’ টারান্টের কি যাবজ্জীবন কারাদন্ড হবে?

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

ক্রাইস্টচার্চের ‘মাসকিলার’ টারান্টের কি যাবজ্জীবন কারাদন্ড হবে?

ব্রেন্টন টারান্টের কি যাবজ্জীবন কারাদন্ড হবে? যে কিনা মসজিদে ঢুকে ঠান্ডা মাথায় জুমার নামাজ আদায়রত ৫১ জন ধর্মপ্রাণ মানুষকে হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে আছেন নারী, পুরুষ ও শিশু, তার শাস্তি হবে শুধু যাবজ্জীবন কারাদন্ড! ৫১ জন ধর্মপ্রাণ মানুষ হত্যা ও অর্ধশত মানুষকে আহত করার অপরাধে তার তো কম করে হলেও ৫১ বার ফাঁসি হওয়া উচিত। নইলে কি বলা যাবে যে, ক্রাইস্টচার্চের ‘মাস কিলার’ টারান্ট তার অপরাধের ‘যথাযথ’ শাস্তি পেয়েছে? আর ওই নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার ব্যক্তিবর্গের আত্মীয়স্বজনের ন্যায়বিচারের আকাক্সক্ষাই বা পূরণ হবে কীভাবে?

২০১৯ সালের ১৫ মার্চ ২৯ বছর বয়স্ক অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ব্রেন্টন টারান্ট নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ৫১ জনকে হত্যা করে, হামলায় গুলিবিদ্ধ ও আহত হন কয়েকজন। ঘটনার পরপরই নিউজিল্যান্ড পুলিশের দুই অকুতোভয় সদস্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্রেন্টন টারান্টকে গ্রেফতার করেন। ২০১৯ সালের জুন মাসে নিউজিল্যান্ডের হাই কোর্টে টারান্টের বিরুদ্ধে ৫১ জনকে হত্যা, ৪০ জনকে হত্যাচেষ্টা ও একটি সন্ত্রাসী হামলা চালানোর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। ব্রেন্টন টারান্ট ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে আদালতের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি যখন চুপচাপ বসেছিলেন, টারান্টের  আইনজীবী তার পক্ষ থেকে অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন, যাতে হত্যাকান্ডের শিকার ব্যক্তিবর্গের উপস্থিত আত্মীয়স্বজন হতবাক হয়ে যান, কেউ কেউ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। কেননা, তারা ভেবেছিলেন, টারান্ট অভিযোগগুলো স্বীকার করে নেবেন। তাদের এ ভাবনার মূল কারণ ছিল এই যে, হত্যাকান্ডের স্বপক্ষে অকাট্য প্রমাণ আছে। উপরন্তু, সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনার সময় টারান্ট নিজেই সেটি তার ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করেছিলেন।

এ বছরের মে অথবা জুন মাসে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের নজিরবিহীন এই সন্ত্রাসী হামলা মামলার বিচার শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, গত ২৬ মার্চ বৃহস্পতিবার টারান্ট তার আগের অবস্থান পরিবর্তন করে তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ স্বীকার করে নেন। করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারীর কারণে নিউজিল্যান্ডে ঘোষিত চার সপ্তাহের লকডাউনের প্রথম দিনে টারান্ট আদালতের কাছে তার দোষ স্বীকার করেন। এজন্য শুনানির সময়ে কাউকে আদালতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি এবং টারান্ট ও তার আইনজীবী অকল্যান্ডের কারাগার থেকে ভিডিও লিংকের মাধ্যমে যুক্ত হন। শুধু দুই মসজিদের একজন প্রতিনিধিকে শুনানির সময়ে উপস্থিত থাকার অনুমতি প্রদান করা হয় যিনি হত্যাকান্ডের শিকার ব্যক্তিবর্গের প্রতিনিধিত্বও করেন।

নিউজিল্যান্ড হাই কোর্টের বিচারপতি ক্যামেরন মানডের বলেন, ‘এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, অভিযুক্ত (টারান্ট) যখন তার দোষ স্বীকার করলেন, তখন কভিড-১৯ নিষেধাজ্ঞার কারণে হত্যাকান্ডের শিকার ব্যক্তিবর্গের পরিবারের সদস্যদের আদালতে উপস্থিত থাকার অনুমতি প্রদান করা গেল না।’ বিচারপতি মানডের জানান, টারান্ট যেহেতু তার বিরুদ্ধে আনীত ৯২টি অভিযোগ স্বীকার করেছেন; সুতরাং তাকে কী শাস্তি দেওয়া হবে সেটি পরবর্তী একটি তারিখে নির্ধারণ করা হবে, এবং ততদিন পর্যন্ত টারান্ট হেফাজতে বন্দী থাকবেন। বিচারপতি আরও বলেন, ‘আদালতের স্বাভাবিক কর্মকান্ড আরম্ভ না হলে অপরাধীর দন্ড ঘোষণার কোনো ইচ্ছা আদালতের নেই। ওই সন্ত্রাসী হামলার শিকার ব্যক্তিবর্গের আত্মীয়স্বজন যখন সশরীরে আদালতে উপস্থিত থাকতে পারবেন, তখনই অপরাধীর দন্ড ঘোষণা করা হবে।’

বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অপরাধ প্রমাণ করতে হলে, একদিকে পুলিশ ও প্রসিকিউটরদের দীর্ঘ প্রস্তুতি, মেধা ও শ্রম যেত; অন্যদিকে হত্যাকান্ডের শিকার ৫১ জনের আত্মীয়স্বজন এবং হত্যা প্রচেষ্টার শিকার ব্যক্তিবর্গকে আদালতে এসে তাদের হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে হতো। প্রাথমিকভাবে অস্বীকার করলেও  মার্চ মাসে টারান্ট তার দোষ স্বীকার করায় এখন আদালতের কাজ সহজ হয়ে গেছে। 

এখন প্রশ্ন হলো, টারান্টকে কী দন্ড দেওয়া হবে? এ ব্যাপারে নিউজিল্যান্ড ল’ সোসাইটি ও অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির আইনের অধ্যাপক ক্রিস গ্লেডহিল বলেন, টারান্টকে প্যারোলবিহীন যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করার সম্ভাবনাই বেশি, যেটি কিনা নিউজিল্যান্ডের আইনে হত্যাকান্ডের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি। উল্লেখ্য, নিউজিল্যান্ডের দন্ড আইনে মৃত্যুদন্ডের বিধান নেই, ১৯৬১ সালেই দেশটি মৃত্যুদ- বিলুপ্ত করে দিয়েছে।

অধ্যাপক ক্রিস বলেন, তবে বিচারপতিকে প্যারোলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাবজ্জীবন কারাদন্ড শুরু হওয়ার পর ১৭ বছর অতিক্রান্ত না হলে টারান্ট যেন প্যারোলের জন্য আবেদন করতে না পারেন। তবে অধ্যাপক ক্রিস গ্লেডহিল বলেন, বিচারপতি চাইলে টারান্টকে আমৃত্যু যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করতে পারেন এবং সেক্ষেত্রে এটিই হবে নিউজিল্যান্ডের সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রথম প্যারোলবিহীন যাবজ্জীবন কারাদন্ড, যে দন্ডে অপরাধীকে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাগারেই থাকতে হবে। উল্লেখ্য, নিউজিল্যান্ডের আইনে হত্যাকান্ডের নৃশংসতা অনুযায়ী আদালত হত্যাকারীকে ১০ বছরের প্যারোলসহ যাবজ্জীবন বা ১৭ বছরের প্যারোলসহ যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিতে পারেন; আর সেক্ষেত্রে ১০ অথবা ১৭ বছর কারাদন্ড ভোগ করার পর অপরাধী প্যারোলের আবেদন করতে পারেন। তবে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইক্যাটোর আইনের অধ্যাপক আলেক্সজান্ডার গিলেসপি বলেন, বিচারপতির এমনভাবে দন্ড প্রদান করা উচিত যেন ভয়ঙ্কর এই সন্ত্রাসী আবার প্রকাশ্য সমাজে ফিরে আসতে না পারেন।

এ পর্যন্ত মামলার কর্মকান্ড যত দূর অগ্রসর হয়েছে, নিউজিল্যান্ড ল’ সোসাইটি ও আইনের অধ্যাপকবৃন্দ যে মতামত দিয়েছেন, তাতে করে এ কথা বলা যায় যে, টারান্টকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডই প্রদান করা হবে, যেটি নিউজিল্যান্ডের আইনে হত্যাকান্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ৫১ জনের হত্যা, ৪০ জনের হত্যাপ্রচেষ্টা ও একটি সন্ত্রাসী হামলা- এই ৯২টি অপরাধের শাস্তি কি শুধু যাবজ্জীবন কারাদন্ড? এতে কি ন্যায়বিচারের আকাক্সক্ষা পূরণ হবে? বাংলাদেশের নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে; এ দেশে বিদ্যমান দন্ড আইন ও প্রচলিত ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থার ‘লেনস’ দিয়ে বিচার করলে যে কেউ বলবেন যে, ন্যায়বিচারের আকাক্সক্ষা পূরণ হবে না।

অপরাধ, শাস্তি, ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশের গড়পড়তা মানুষের যে ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি; তাতে যে কেউ বলে বসবেন, একজন সন্ত্রাসী মসজিদের মধ্যে ঢুকে পাখির মতো গুলি করে এতগুলো মানুষ মেরে ফেলল, আর আপনি বলছেন, তাকে শুধু যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হবে? আপনারা, মানে আইনের অধ্যাপকরা কি আমাদের সঙ্গে তামাশা করছেন? টারান্টের মতো একজন ‘মাস কিলার’কে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হলে অপরাধ ও সন্ত্রাস তো আরও বেড়ে যাবে! তাই নয় কি? যে সব দেশে এখনো মৃত্যুদন্ড বহাল আছে, যে সব রাষ্ট্রের নাগরিকরা এখনো ‘রক্তের বদলা রক্ত’ নীতিতে বিশ্বাসী; যে সব দেশের ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থা এখনো ‘অপরাধ-শাস্তি’র মান থেকে ‘অপরাধ-সংশোধন-পুনর্বাসন’-এর মানে উন্নীত হয়নি; তাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল বা তাদের বোঝানোও মুশকিল যে, যাবজ্জীবন কারাদ-ও পর্যাপ্ত শাস্তি হতে পারে। মনে রাখতে হবে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ১৪২টি দেশ মৃত্যুদন্ড রহিত করেছে। আমরা সেই নগণ্যসংখ্যক রাষ্ট্রের একটি যেখানকার দন্ড আইনে এখনো মৃত্যুদন্ড বহাল আছে, অথচ বিশে^র দুই-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রের আইন ও চর্চায় এখন মৃত্যুদ- বলে কিছু নেই।

দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সমাপ্তির পর ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালে জার্মান ও জাপানের যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালের পর থেকে জাতিসংঘ কর্তৃক গঠিত কোনো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, বা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্যও কাউকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেনি। ২০০২ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠিত আইসিসি বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সংবিধিতেও মৃত্যুদন্ডের বিধান রাখা হয়নি। মূলত উন্নত গণতান্ত্রিক দেশসমূহ, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো অপরাধীর দন্ডের ব্যাপারে কয়েক দশক আগেই নমনীয়, মানবিক ও সভ্য একটি মানদন্ড স্থাপন করেছে; যার প্রতিফলন হচ্ছে ১৪২টি দেশ কর্তৃক মৃত্যুদন্ড বিলোপ করা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সংবিধিতে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্যও মৃত্যুদন্ডের বিধান না রাখা।   

দন্ডের ক্ষেত্রে ‘নমনীয়, মানবিক ও সভ্য মান’ কাকে বলে, সেটি বোঝার ক্ষেত্রে নরওয়ের ‘মাস কিলার’ ব্রেইভিকের বিচার ও শাস্তির আলোচনাটি প্রাসঙ্গিক ও সহায়ক হবে বলে মনে করি। ২০১১ সালের জুলাই মাসে অ্যান্ডারস বেহরিং ব্রেইভিক নরওয়েতে গুলি করে ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ৭৭ যুবক-যুবতীকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং প্রায় ৩শ’ জনকে আহত করে। ১০ সপ্তাহ ধরে চলা বিচারের পরে ব্রেইভিককে ২১ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয় এবং এটিই হচ্ছে নরওয়ের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং বলাই বাহুল্য যে, নরওয়ের দন্ড আইনে মৃত্যুদন্ডের কোনো বিধান নেই। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, হত্যাকান্ডের শিকার ৭৭ জনের বাবা-মা ও ঘনিষ্ঠজনরা এবং নরওয়ের সাধারণ নাগরিকরা এতগুলো নৃশংস হত্যাকান্ডের জন্য ‘মাস কিলার’ ব্রেইভিকের মৃত্যুদন্ড দাবি করেননি। বরং তারা ব্রেইভিকের সুষ্ঠু বিচারে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং আদালত ব্রেইভিককে নরওয়ের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। নিউজিল্যান্ড ও নরওয়ের মতো একটি শান্তিপ্রিয় ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’, যেখানকার ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থা নমনীয়, মানবিক ও সভ্য বলে পরিচিত। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে নিউজিল্যান্ড মৃত্যুদন্ড বিলুপ্ত করে দিয়েছে। নিউজিল্যান্ডবাসী মনে করেন না যে, টারান্টকে মৃত্যুদন্ড দিতে হবে। ওখানকার মুসলিম কমিউনিটিসহ নিউজিল্যান্ডের সচেতন নাগরিকদের চাওয়া হচ্ছে, নৃশংস সন্ত্রাসী ব্রেন্টন টারান্টকে যেন দৃষ্টান্তমূলক ও নিউজিল্যান্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হয়। এতেই তাদের ন্যায়বিচারের আকাক্সক্ষা পূরণ হবে বলে তারা মনে করেন। তবে হ্যাঁ, দুই নৃশংস ‘মাস কিলার’ টারান্ট ও ব্রেইভিকের ব্যাপারে বিচারক, রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারক ও সচেতন মানুষের মধ্যে যে প্রবল উৎকণ্ঠাটি আছে; সেটি হচ্ছে কারাদন্ড শেষ হওয়ার পর অথবা প্যারোলে কারাগারের বাইরে এসে তারা যেন আবার এমন নজিরবিহীন নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি করতে না পারে। আর নরওয়ে ও নিউজিল্যান্ডের আইনের শাসন ও ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থা এতটাই মজবুত যে, সে আশঙ্কা নেই বললেই চলে।

                লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর