শনিবার, ১৩ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

স্বাস্থ্য-সুরক্ষার দায়িত্ব এখন নিজের কাঁধে

ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ

স্বাস্থ্য-সুরক্ষার দায়িত্ব এখন নিজের কাঁধে

করোনাভাইরাসকে সঙ্গে নিয়ে আমরা প্রায় ছয় মাস অতিবাহিত করতে যাচ্ছি। এ ছয় মাসে করোনা যেমনি বিশ্বব্যাপী ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে সংক্রমণের হার। প্রতিনিয়ত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাস আলিঙ্গন করে মৃত্যুর পথযাত্রী হচ্ছে। করোনা মানুষের মনে মৃত্যু ভয়ের সঞ্চার করেছে- এ কথা যেমন সত্য, তেমনি কিছু মানুষের কাছে তা ক্ষুধার ভয়কে হার মানাতে পারেনি, সেটিও নির্মম সত্য। তাই তো মানুষ আজ জীবিকার টানে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছে, করোনার চেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা তাদের কাছে বড় বেশি নির্মম! সরকারও বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে অনেক বিষয়ে নমনীয় সিদ্ধান্ত দিয়েছে। সেগুলো নিয়ে রয়েছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি। তবে সারা বিশ্বে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞগণ কিন্তু এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, হয়তো করোনাকে সঙ্গে নিয়ে ভবিষ্যতে পথ চলতে হবে, এ পৃথিবীর মানুষকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, হেপাটাইটিস-বি, সি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, রোটাভাইরাস, ডেঙ্গু এবং এইচআইভি ভাইরাস সবাই শুরুতে কমবেশি ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। এসব ভাইরাস কিন্তু পৃথিবী থেকে পুরোপুরি মুছে যায়নি, এখনো রয়েছে। কিন্তু আমাদের কিছু অভ্যাস, কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এই রোগের প্রকোপ কমিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হয়তো করোনার ক্ষেত্রেও এমনটি হবে, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আমাদের জীবনের অংশ করে নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এ ভাইরাসের ভ্যাকসিন নেই। কবে তৈরি হবে, সেটি নিশ্চিত করে বলা কঠিন। রাত পোহালে যদি ভ্যাকসিন পেয়ে যেতাম, এমন আশাবাদ আছে অনেকের মধ্যে। বাস্তবে যত আশা করি না কেন, এটা তৈরি হয়ে দেশে আসতে সময় লাগবে। তাই প্রতিকার ও প্রতিরোধই এ ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার উপায়। তাই যেকোনো মূল্যে নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন, আপনার এ স্বার্থপরতা অন্যকে সুরক্ষা দেবে। সচেতনতা এবং স্বাস্থ্য সতর্কতাগুলো শুধু নিজের জন্য নয়; নিজের পরিবার, নিজের প্রতিবেশী, সর্বোপরি সব মানুষের জন্য মেনে চলতে হবে এবং এ স্বাস্থ্যবিধিগুলোকে আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে নিতে হবে। একটা বিষয় কিন্তু সবার কাছেই পরিষ্কার, আপনি আক্রান্ত হলে চিকিৎসা পাওয়াটা কঠিন। কারণ, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের জনসংখ্যা বা প্রয়োজন অনুপাতে হাসপাতাল, বেড, ভেন্টিলেটর, ডাক্তার ও নার্স নেই। টাকা থাকলেও সুচিকিৎসা পাওয়ার নিশ্চয়তা অনেক ক্ষেত্রে নেই। যত ক্ষমতাধর হোক, যত অর্থবিত্তের মালিক হোক কিংবা যত বড়ই বিজ্ঞানী হোক- কারও কিন্তু এই অদৃশ্য ভয়ঙ্কর দানব থেকে নিস্তার নেই। একমাত্র সতর্কতাই সব নাগরিককে সুরক্ষা দিতে পারে। করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের প্রতি মুহূর্ত সতর্ক হতে হবে। যখন আমরা জীবিকার প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হচ্ছি, কর্মস্থলে যাচ্ছি, তখন আমার সতর্কতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সতর্কতা শুধু আমার নিজের জন্য নয়, আমাদের এক মুহূর্তের অসতর্কতার জন্য ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কেবল আমি করোনায় আক্রান্ত হব না, বরং আমার পরিবার, আমার কর্মস্থলের সহকর্মীরাও আক্রান্ত হতে পারে। কাজেই আমাদের প্রতি মুহূর্তে সতর্ক হতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যদি আমরা ভালো থাকি তাহলে আমাদের পরিবার এবং সমাজ ভালো থাকবে। কাজেই আমার সুস্থ থাকা শুধু আমার জন্য নয়, আমার পরিবারের জন্যও বটে।

ঘরে থাকার ব্যাপারে বলতে হয়, সরকার ঘরে থাকতে বলল কিনা, লকডাউন দিল কি না, এসব নিয়ে ভাবার সময় এখন নেই। যে পরিস্থিতির মধ্যে আমরা পড়েছি, তাতে নিজ দায়িত্বে নিজেকেই অবরুদ্ধ করতে হবে। এ সময়ে নিজের জীবনের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব অন্যের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। কিছু মানুষের যেমন ঘর থেকে না বেরিয়ে উপায় নেই, তেমনি এ কথাও সত্য একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর কিন্তু ঘর থেকে বাইরে বের হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অনেকেই হাটে-বাজারে, রাস্তাঘাটে এমনিই কোনো কাজ ছাড়া বেরিয়ে পড়েন। অনেকে আড্ডা দিতে বের হন, অনেকে চা খেতে বের হন। খানিকটা বলা যায় বিলাসিতায় আমরা অনেকেই ঘর থেকে বের হই, যা ভয়ঙ্কর। কারণ এটি অন্যের শুধু নয়, আপনার, আপনার পরিবারের জীবনকেও বিপদে ফেলছে। এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। আবার, মাস্ক পরার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের অনেকেই অবহেলা করছে। অনেকেই হয়তো সঙ্গে মাস্ক রাখছেন, কিন্তু পরছেন না। কেউ পরলেও হয়তো মাস্ক নামিয়ে কথা বলছেন, কেউ থুতনিতে নামিয়ে রাখছেন, এমনকি অনেককে মাথায় মাস্ক তুলে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। এর কোনোটিই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সিডিসির সর্বশেষ গাইডলাইন অনুসারে, সবার মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। বিশেষ করে আমাদের মতো অধিক জনসংখ্যার দেশ, যেখানে আমরা সামাজিক দূরত্ব এবং লকডাউন নিজেরা নানা কারণে পুরোপুরি মেনে চলতে পারছি না, নিয়মিত হারে যেখানে নতুন রোগী পাওয়া যাচ্ছে, মৃত্যুর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য, সেক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ মানুষের সবার মাস্ক পরা উচিত। অন্তত কাপড়ের তৈরি মাস্ক সবাইকে ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে জনসমাগম হওয়া স্থানগুলো যেমন হাটবাজার, রাস্তাঘাট, বাস-ট্রেনসহ অন্যান্য গণপরিবহনে কোনোভাবেই মাস্ক ছাড়া যাওয়া যাবে না। অধিকন্তু বয়স্ক মানুষ এবং যাদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ (যেমন : হার্ট, কিডনি ও লিভারের সমস্যা, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, ক্যান্সার) আছে, যারা নিয়মিত ডায়ালাইসিস করেন বা কেমো থেরাপি নেন, তাদের সবাইকে মাস্ক পরতে ভুললে কোনোভাবেই চলবে না। আবার মনে রাখতে হবে, শুধু মাস্ক পরলে হবে না, এ মাস্ক ব্যবহারের কিছু বিধি রয়েছে সেগুলো মেনে চলতে হবে। সঙ্গে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যেমন কিছুক্ষণ পরপর সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া অব্যাহত রাখতে হবে, নিয়মিত মাস্ক পরিবর্তন করতে হবে, ওয়ান-টাইম ব্যবহারের পর মাস্ক যেখানে-সেখানে না ফেলে ঢাকনাযুক্ত পাত্রে ফেলতে হবে এবং পরবর্তীতে তা পুড়িয়ে ফেলা ভালো আর কাপড়ের মাস্ক হলে ব্যবহারের পর তা সাবান পানিতে ধুয়ে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।

মৌসুমটা জ্বর-সর্দি-কাশির। এখন জ্বর হলে যেমন করোনার কথা মাথায় রাখতে হবে, তেমনি শরীর হালকা গরম-গরম মনে হচ্ছে (থার্মোমিটারে মাপলে জ্বর নেই), গলাটা খুস-খুস করলেই আতঙ্কিত হয়ে অযথা হসপিটাল বা ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি করা ঠিক হবে না। এই যে হসপিটালে ছোটাছুটি করছেন, শুরুতেই পরীক্ষার জন্য এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় দৌড়াচ্ছেন, মনে রাখতে হবে এসব জায়গায় কিন্তু অনেক করোনা রোগী রয়েছে, এতে বরং আপনার যদি করোনা না-ও হয়ে থাকে আপনার সংক্রমণের সুযোগ বাড়ে। এজন্য এরকম মৃদু উপসর্গ দেখা দিলে, প্রথমেই সরকার প্রদত্ত হট লাইনগুলো কিংবা বেসরকারিভাবে চালু হওয়া অসংখ্য টেলিমেডিসিনের সার্ভিসের মাধ্যমে যেকোনো একজন ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন। এ সময়ে স্বাভাবিক দু’একদিনের জ্বর সর্দি-কাশি কিন্তু আমরা বাড়িতে পর্যবেক্ষণ করতে পারি। সেক্ষেত্রে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ গ্রহণ না করাই ভালো।

সঙ্গে সঙ্গে গরম পানি খাওয়া, গরম পানির গড়গড়া করা, গরম পানির ভাপ নেওয়া, প্রচুর তরল জাতীয় খাবার খাওয়া ইত্যাদি সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। তবে বয়স্ক রোগী, যাদের ডায়াবেটিস, হার্ট, কিডনি বা লিভারের সমস্যা রয়েছে তারা এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি না নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। এখানে বলে রাখা ভালো, অনেকেই এরকম উপসর্গ দেখা দিলে এন্টিবায়োটিক, আইভারমেকটিন, হাইড্রোক্সি-ক্লোরোকুইন ইত্যাদি ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ ফার্মেসি থেকে কিনে খাচ্ছেন, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকে আবার এই ওষুধ এমনকি অক্সিজেন সিলিন্ডার বাসায় মজুদ করছেন তা ঠিক নয়। এতে ওষুধ ও অক্সিজেনের কৃত্রিম সংকট তৈরি হচ্ছে, যাদের প্রয়োজন তারা পাচ্ছেন না। আরেকটা বিষয় মনে রাখতে হবে, অক্সিজেন কিন্তু বাসায় দেওয়া ঠিক নয়, এখানে নানা রকম হিসাব-নিকাশ ও পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। একজন চিকিৎসকের উপস্থিতি ছাড়া তা সম্ভব নয়। মাত্রায় কম বা বেশি অক্সিজেন যেমন রোগীর ক্ষতিকর, তেমনি এসব অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটারও সম্ভাবনা থাকে। আর যদি করোনা হয়েই যায়, তবে ভয় না পেয়ে মনে রাখবেন আক্রান্ত প্রায় ৮০ ভাগ রোগী গুরুতর অবস্থায় হয় না। তারা মৃদু বা মাঝারি লক্ষণে ভোগেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার মৃদু থেকে মাঝারি উপসর্গযুক্ত রোগীরা কিন্তু বাসায় বা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিতে পারেন। এসব রোগীর চিকিৎসা টেলি-মেডিসিনের মাধ্যমেই দেওয়া সম্ভব। তবে এটিই মূল চিকিৎসা, তা নয়। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটি করতে হচ্ছে। এমন চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে হবে রোগীর উপসর্গ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকেই দেখা দিয়েছে কিনা। কারণ, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হলে চিকিৎসকের আর বেশি কিছু দেখার প্রয়োজন হয় না। রোগীর কী কী সমস্যা হচ্ছে তা রোগী নিজেই বুঝতে পারেন। ফলে টেলিফোনে রোগীর অবস্থা শুনেই চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরামর্শ, উপদেশ ও ওষুধ দিতে পারেন।

বাড়িতে বসে যারা চিকিৎসা নেবেন, তাদের আলাদা বা আইসোলেটেড থাকতে হবে। নিজের ও পরিবারের স্বার্থেই এটি করতে হবে, যাতে পরিবারের অন্য কেউ সংক্রমিত না হয়। এ সময় প্রচুর পানি ও তরলজাতীয় খাবার এবং কুসুম গরম পানি খেতে হবে। দিনে কয়েকবার গরম বাষ্পের ভাপ নিতে হবে। সামর্থ্য অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার, তাজা ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে। সম্ভব হলে একটু একটু করে ব্যায়াম করতে হবে। আর জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল ও সর্দি, কাশি, হাঁচি ইত্যাদি থাকলে অ্যান্টি হিস্টামিন ট্যাবলেট খেতে হবে। এ ছাড়া ভিটামিন-সি, জিংক ও ভিটামিন-ডি খাওয়া যেতে পারে। বাসায় বসে চিকিৎসা নেওয়ার সময় অবশ্যই নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। চিকিৎসক আশার বাণী শোনাবেন, অন্তত উপদেশ দেবেন। এ বিপদের সময় এটাও অনেক কিছু।

চারদিকে যে অবস্থা তাতে আপনার প্রতিবেশী কিংবা আপনার বাড়ির কারও করোনা আক্রান্ত হওয়া এখন খুবই সাধারণ ঘটনা। আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি, তার পরিবারের প্রতি কোনো ধরনের বৈরী বা অমানবিক আচরণ করবেন না। যথাসম্ভব তাদের সহযোগিতা করুন, যাতে তাদের বাড়ির বাইরে বের হওয়ার প্রয়োজন না হয়। আপনার সহযোগিতা শুধু তাদের জন্য নয়, তারা যদি বাড়িতে থাকতে পারেন তাহলে কিন্তু আপনার পরিবার, আপনিও সুরক্ষিত থাকবেন। সুতরাং আক্রান্ত রোগী এবং পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন।

আপনার চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা করোনার জন্য বুক চিতিয়ে ফ্রন্টলাইনে থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন, যেমন চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন, সাংবাদিক ভাইবোনসহ জরুরি সেবা প্রদানকারী পেশার লোকজন। তাদের সবাইকে সহযোগিতা করুন। কারণ তারা আপনার জন্য কাজ করতে গিয়ে নিজের জীবনকে ঝুঁঁকিতে ফেলছেন। এমনকি আপনারা যে ভাইরাস ভয় পাচ্ছেন, তারা নিজের শরীরে সেই করোনাকে গ্রহণ করছেন। সুতরাং তারা কাজ করতে গিয়ে যদি আক্রান্ত হন, তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করবেন না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এরকম ঘটনা কিন্তু আমরা প্রায়ই পেপার-পত্রিকা, টেলিভিশনে দেখতে পাচ্ছি- যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাদের মনোবল যদি ভেঙে যায়, তারা অনুৎসাহিত হবেন সুতরাং আপনার নিজের ভালোর জন্য হলেও এসব ফ্রন্টলাইনে যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন, তাদের সহযোগিতা করুন। সরকারের ভূমিকার মধ্যে চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মী, র‌্যাব-পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ সব নিরাপত্তাকর্মী এবং গণমাধ্যমকর্মীদের বিষয়টি আরও জোরদার করতে হবে। তাদের উৎসাহ দিতে হবে, সাহস জোগাতে হবে এবং মনোবল বজায় রাখতে হবে।

করোনা পরিস্থিতির মাঝেও দেখা যাচ্ছে, কিছু মানুষ অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় কিংবা উচ্চমূল্যে করোনা সংক্রান্ত জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। অক্সিজেন, মাস্ক, স্যানিটাইজার, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের দাম এখন আকাশচুম্বী। জানামতে এগুলোর সরবরাহের প্রাথমিক কিছু সংকট থাকলেও এখন কিন্তু সেই সংকট নেই। তারপরও একদল সুবিধাভোগী মানুষ এ জিনিসগুলোর সহজলভ্যতাকে দিন দিন আরও বেশি কঠিন করে তুলেছেন, যা হতাশাজনক। এ সময়ে মানবিক হওয়া উচিত, এ পণ্যগুলো কিন্তু অন্যের ক্ষেত্রে সহজলভ্য হলে, আমরা সবাই সুরক্ষিত হব। তাই যারা এরকম করছেন তাদের প্রতি আবেদন, জিনিসপত্রের দাম অযথা না বাড়িয়ে, কৃত্রিম সংকট তৈরি না করে স্বাস্থ্য-সুরক্ষার জিনিসপত্রগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে সহজলভ্য করার ব্যবস্থা করুন। আরও একটি দুঃখের বিষয়, চারদিকের বিভিন্ন ঘটনা দেখে মনে হয় ‘দুর্নীতি বোধহয় করোনার চেয়ে শক্তিশালী। না হলে এরকম জীবন সংহারকারী অবস্থায়, এখনো কতিপয় মানুষের দুর্নীতির ঘোড়া লাগামহীনভাবে ছুটে চলেছে। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে, এত সম্পদ জমিয়ে লাভ কী, যদি জীবনটাই না থাকে। সাধারণ মানুষকে বাঁচতে দিন, অন্তত এ সময়ে দয়া করে দুর্নীতি থেকে দূরে থাকুন এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করুন। প্রতিটি মানুষের প্রাপ্য তার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। মানুষের জীবন সংকটে দুর্নীতি করে মানুষের জীবনকে সংকটাপন্ন করলে, নিশ্চয়ই স্বয়ং আল্লাহ তাদের প্রতি খুশি নিশ্চয় হবেন না। সরকার অর্থনীতিকে সচল করার জন্য সীমিত আকারে এ সব কিছু চালু করেছে। এখানে আমাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। নাগরিক এবং সরকারের সমন্বয়ের মাধ্যমেই এখন করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। সরকার ও প্রশাসন নিজের মতো করে চেষ্টা করছে। সেখানে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাও হয়তো চলছে। আর ঠিক এ কারণেই এখন নাগরিকদের দায়িত্ব অনেক বেশি। নাগরিকরা যদি সচেতন থাকে এবং দায়িত্বের পরিচয় দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে তাহলে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। নাগরিক হিসেবে এখন আমাদের দায়িত্ব অনেক। এজন্য মাস্ক পরব, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখব, সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলব। জরুরি কাজে বাইরে গেলেও অযথা যেন ঘোরাফেরা না করি। কাজ শেষ করে যেন দ্রুত চলে আসি। আসুন আমরা রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত ও দোকানপাটে দূরত্ব বজায় রেখে চলি। গাদাগাদি করে ফেরি, গণপরিবহন বা যানবাহনে চলব না। এ স্বাস্থ্যবিধির সব আমরা যদি মেনে চলি, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের জীবন এবং জীবিকা একসঙ্গে চলা সম্ভব হবে। এ মহামারী থেকে কবে আমরা মুক্তি পাব, কেউ জানি না, করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করেই হয়তো বাঁচতে হবে।

পরিশেষে, আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হব না, ভীত-সন্ত্রস্ত হব না, মনোবল হারাব না, যারা যার মতো ধর্মচর্চা করব- এতে সবার মনোবল অটুট থাকবে। সর্বোপরি সবাই সচেতন হব, স্বাস্থ্যনীতি মেনে চলব এবং নাগরিক দয়িত্ব সঠিকভাবে পালন করব।

লেখক : প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।

 

সর্বশেষ খবর